Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বই মেলায় যাবোনা, যাবো…


১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২১:৪৬

আমাদের সুভাষদার একটা অসাধারণ গুণ আছে। তিনি পুস্তকগত প্রাণ। নিজে বই পড়েন। অন্যকে বই পড়তে উদ্ধুদ্ধ করেন। নিজে বই কেনেন। অন্যকে কিনে দেন। একারণে তার প্রতি আমার একটা পক্ষপাতিত্ব আছে। সে পক্ষপাত যে আমি একা করি তা নয়। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান থেকে শুরু করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মত পÐিতদেরও দেখেছি তার প্রতি বিশেষদৃষ্টি রাখতে। তবে সুভাষদা ছাড়াও আরো অনেক মানুষ আছেন যারা আমাকে বই উপহার দেন। কখনো তাদের নিজের লেখা, কখনো অন্যের লেখা মানসম্মত বই। সাংবাদিক হওয়ার এই সুবিধা। প্রচুর বই-পত্রিকা-জার্নাল মুফতে পাওয়া যায়। তবে আমি আমার নিজের পছন্দের বইও কিনি। বিশেষকরে বিদেশ গেলে, হাওয়াইআড্ডাতে বইয়ের চোখ ধাঁধাঁনো দোকান দেখলে মাথা ঠিক থাকে না। কি চমৎকার উজ্জ্বল বাধাই, চকচকে ছাপা, মলাটে নজরকাঁড়া রঙিন ছবি হাতছানি দিয়ে ডাকে। বিদেশি বিমানপোতে আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি, প্রদর্শন প্রতিযোগিতায় মদের বোতল, চকলেট আর বই সমান সক্ষমতা সম্পন্ন। প্রকাশনা শিল্পের প্রযুক্তির আধুনিকতা যে এতে বড় ভূমিকা রেখেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্ত একটা বিষয় বুঝতে পারি, এই উৎকর্ষতাই অনেক বেশি মানুষকে বই পড়ার দিকে টানছে। সুভাষদার মত মানুষদের যদি পুশ ফ্যাক্টর বলি, তো এই বাহারী প্রকাশনা পুল ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করছে। আর এই পুশ-পুলের যুগল মিলনে বইয়ের বিক্রি ও পড়া যে বেড়েছে তাতে বোধহয় সন্দেহ করবে না কেউ।

বিজ্ঞাপন

ঢাকায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলে এক মাস। কলকাতার বই মেলা চলে আধমাস। বইমেলা বসে ত্রিপুরায়, দিল্লিতে, চেন্নাইতে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, প্যারিস আর সিডনির বইমেলার সৌরভও ইদানিং ঢাকায় বসে পাওয়া যায়। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের কোন বই যখনই আলোচনায় আসে ঢাকার রাস্তায় হকারের হাতে তার অনুলিপি পেতে খুব একটা দেরি হয় না। সেগুলোরও চেহারা বাহারী। এক হকারকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, তোমাদের এসব বই চলে? সে হেসে ফেললো, বললো, স্যার দৌড়োয়।

বিজ্ঞাপন

বইতো দৌড়োচ্ছে। কিন্তু সে দৌড়ের পাল্লা কত দূর! সমাজে কি বই পড়ার প্রভাব দেখতে পাচ্ছি? মাসব্যাপী বইমেলা। তার সাথে একুশের সুতীব্র চেতনার বিস্তার। স্বাধীনতার মাস মার্চ। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এটা সেটা আরো অনেক উপলক্ষ্য বছর জুড়ে। সব উপলক্ষ্যই চেতনা বিস্তারের না হোক নিদেনপক্ষে বিপণনের কাজটা করে। এর সাথে বই পড়ার যদি যোগ হয় তাহলে তো এক সুসভ্য জাতির উত্থানের লক্ষণ দেখা যাওয়ার কথা। কিন্তু তা কি দেখতে পাচ্ছি?

আমার তো মনে হয় না। ইতিহাসের একজন বড় লিপিকারকে যখন দেখি সুস্পষ্ট সত্য আর মিথ্যার মধ্যে ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি মিথ্যার দিকেই ঝুঁকে থাকেন তখন মনে হয় তিনি কোন ইতিহাসবেত্তা নন, একজন মিস্ত্রী মাত্র। অন্যের নির্দেশনা রূপায়নকারী দাস। রাজনীতিকরা যখন দুর্নীতি আর রাজনীতিকে এক করে ঘোলাজলে মাছ শিকার করতে চান অথবা গণতন্ত্র আর উন্নয়নকে একই পাল্লায় তুলে রাজনীতির নতুন অঙ্ক কষেন তখন মনে হয় গণমানুষের স্বার্থ আর সেবাপরায়ণতা অর্থে ক্ষমতাকে দেখতে তারা ভুলে গেছেন। বই পড়ে যাদের চিন্তার জট একটু খুলেছিলো, বাক-স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে যারা বুঝতে চাইছিলেন আসলেই সংবিধানে লেখা কথাগুলোর কোন প্রয়োগ আছে কিনা, তারা নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। বহু বছর আগে উচ্চারণ করা জীবনানন্দ দাশের সেই কথা, অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে কিম্বা শামসুর রাহমানের, উদ্ভট উঁটের পিঠে চলেছে স্বদেশ- এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। কে যেনো ফেসবুকে লিখেছে, আদিবাসীদের উপর অত্যাচার করে কার লাভ? কেউ জানেনা কার কি লাভ। কতদিনের লাভ। যে ভুখÐে গত শতকের ষাটের দশকে প্রগতিশীলতা এক উচ্চ আসন লাভ করেছিলো, সত্তরের দশকের শুরুতেই সেই পথ ধরে যে ভুখÐের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছিলো, যেখানে পচাত্তরের নির্মম-নিষ্ঠুর-জঘন্যতম ইতিহাসবিনাশী ঘটনার পরও নব্বই দশকের শুরুতেই স্বৈরাচারের পতন ঘটেছিলো এবং তিনজোটের রূপরেখায় মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খারই নবায়ন হয়েছিলো, যেখানে যুদ্ধাপরাধের বিচার এক অনন্য বাস্তবতা, সেখানে কি করে বইয়ের আলোকে ¤øান মনে হয়!

কিন্তু তাই তো হচ্ছে। কেন? জীবনান্দকেই আবার স্মরণ করতে হচ্ছে। সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি। সবাই যেমন কবি হতে পারে না। সবাই তেমন লেখকও হতে পারে না। সস্তা প্রযুক্তির কারণে, যা ইচ্ছে তাই দুই মলাটের ভেতর ছাপিয়ে বসিয়ে দিলেই সুপাঠ্য হয় না। হুমায়ুন আজাদের যে কবিতা আমাদের পাঠ্য থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, সেই বই কবিতাটাই আসল। যে বই ভয় দেখায়, যে বই রুচি তৈরি করে না, যে বই ভাবনাকে নাড়া দেয় না সে বই বই নয়। আমরা মলাটটাকে রঙিন করছি কিন্তু মনটাকে নয়। সেই বৈষ্ণব কবির মত বলতে হয়, মন না রাঙায়ে বসন রাঙালে যোগী। বসন রাঙানোর হয়তো দরকার আছে। কারণ ভেক না হলে ভিখ্ মেলে না। কিন্তু সে তো উপলক্ষ্য। লক্ষ্য মন রাঙানো। এত যে বইয়ের জোয়ার। সে জোয়ারে যদি মনের গাঙে পলি না পড়ে, চিন্তার রাজত্বে যদি পরিবর্তন না আসে, প্রকৃত জ্ঞানের যদি উন্মেষ না ঘটে তাহলে সে জোয়ার শেষ পর্যন্ত বন্যা হয়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বিশাল এই বইয়ের রাজত্বে ভালো লেখকের আসলেই অভাব। এবারের বই মেলায় সে অর্থে যদি মাত্র দশটা বই আসে তাহলেই মেলা ধন্য। কিন্তু তা আসবে বলে মনে হয় না।

বই বিক্রি হচ্ছে ভালোই। বাচ্চারা কিনছে মলাট আর রঙ দেখে। বড়জোর বইয়ের শিরোনাম দেখে। বড়রা কিনছে বাচ্চারা নাছোড়বান্দা বলে। পরিচিত লেখকেরটা না কিনলে মন খারাপ করবে তাই কোনদিন পড়া হবে না জেনেও কেউ কেউ বই কিনছেন। কেউ কিনছেন, কারণ, লেখক শক্তিশালী আমলা বা রাজনীতিক। তাকে তার দরকার। শুধু কিনছেন না। একবারে দু’ চারশ’ কপি কিনে বিলিও করছেন। লিখে, ছাপিয়ে, বিলি করে দেয়ার লোক আছে বলে কেউ কেউ ক্ষমতা হারানোর পরও লিখে চলেছেন। নিজেও জানেন না, মলাটের মাঝে আসলে কি লেখা আছে তার নামের আড়ালে। তবে যারা জানেন, তারা বেশিরভাগই ব্যর্থ প্রেমের উপন্যাসিক। দুর্ধর্ষ ছন্দ-শব্দের কাব্যকার। তুমি-আমি-আমি-তুমি, ঘর অন্ধকার, দিলাম হামি-এই একমাত্র বিষয়। শিশু সাহিত্য হলেই বিষয়বস্তু ভ’ত আর চুরি করা গোয়েন্দাগিরি। যাদের লেখায় কিছু মসলা আছে, তারা বেশিরভাগই নিজের পিএইচডির অভিসন্দর্ভটি ঘষেমেজে ছাপিয়েছেন। কিম্বা রিপোর্টারের ডাইরির বেরিয়েছে আগে-পিছে দু’একটা পৃষ্ঠা জুড়ে দিয়ে। দু’ একজন ইতিহাসবিদের সন্ধান মিলবে যারা দু’একটা বিতর্ক উস্কে দিয়ে প্রকাশকের ভাগ্যল²ীকে নিজের আঁচলে বাধতে চান। যারা খ্যাতির মধ্যগগনে বছরের সবচেয়ে পচা লেখাটা মেলার সুযোগে ছেড়ে দেবেন। দর্শন আর বিজ্ঞান সবচেয়ে অবহেলিত। এ সংক্রান্ত লেখা খুঁজতে দূরবীণ হাতে উঠতে হবে মেলার নিরাপত্তা মাঁচায়। আর খুঁজে পাওয়া যাবে সেই বহু বছরের অবিক্রিত ক্ল্যাসিকাল রচনাগুলো। মোটাদাগে এরকম এক পৌস্তকী জগত আর যাই করুক মানুষের মনের অর্গল খুলে দেয়ার মত ক্ষমতা রাখে না। তাই ঠিক করেছি এ বছর বই মেলা যাবো না। দেখিনা কি হয়।

নাহ্ । তাই হয় কখনো! বই মেলায় অবশ্যই যাবো। কিচ্ছু না পেলেও নতুন বইয়ের মলাট নাকে চেপে ধরে ছাপার কালির মাদকতাময় গন্ধ নেবো। উজ্জ্বল প্রজাপতির মত অজ¯্র বইয়ের মলাট দেখবো। লেখকদের আনন্দ কলতান শুনবো। হোলি আর্টিজানের রক্তহোলীর বিপরীতে সৃজনশীলতার তৃপ্তিভরা মুখ দেখবো। প্রেমিক-প্রেমিকা দেখবো। প্রকাশক দেখবো। চায়ের স্টল দেখবো। ধোঁয়া ওঠা চায়ে আড্ডার আভা দেখবো। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দেখবো। সবুজ গাছ দেখবো। রঙিন পোষ্টার দেখবো। ধুলো দেখবো। ধুলোমারা জলের কল দেখবো। পুলিশ দেখবো। কবি দেখবো। হকার দেখবো। বেকার দেখবো। উৎসব দেখবো। জীবন দেখবো। ও জীবন রে জীবন ছাড়িয়া যাস না মোকে, তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে মড়া কইব লোকে। শত নেতিবাচকতার কথা বললেও বইয়ের এই সচলতা আমাদের গোটা জীবনকে অচলতা থেকে বাঁচাচ্ছে প্রতিদিন। এ কথা না মেনে উপায় নেই।

সারাবাংলা/এমএম

[এই লেখার সকল মতামত লেখকের নিজস্ব]

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

সিনিয়র সাংবাদিক বদিউল আলম আর নেই
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৩১

সম্পর্কিত খবর