সাংবাদিকতা এখন আরও সহজ, সাশ্রয়ী ও সত্যনিষ্ঠ
৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ২৩:২৮
খুব করেই বলা হচ্ছে সাংবাদিকতা চর্চার ধরন পাল্টাতে হবে। পাল্টাচ্ছেও। দিন দিন নতুন কিছু এসে পুরাতনকে কেবল দুর্বল বা অকেজোই করে দিচ্ছে না, বলা চলে বাতিলই করে দিচ্ছে। এই পরিবর্তনের মাত্রা এতটাই বেশি যে আজ যা নতুন, কালই তা পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। এতে প্রায় সকলেই বলছেন, চ্যালেঞ্জটা বাড়ছে। কিন্তু সত্যিই কি চ্যালেঞ্জ বাড়ছে? নাকি সাংবাদিকতা আরও সহজ, আরও কম খরুচে, আরও দ্রুততর হয়েছে?
সাংবাদিকতাকে বলা হয়, দ্রুততার সাহিত্যকর্ম (লিটারেচার ইন আ হারি)। এই দ্রুততা শব্দটি বলা চলে তার সর্বোচ্চ গতি পেয়েছে বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতা চর্চায়। সে যাত্রাপথে সহায় হয়ে কিংবা আশীর্বাদ হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে নানাবিধ প্রযুক্তি। ফলে আমরা এখন যা করি, তা প্রযুক্তিনির্ভর। এই প্রযুক্তিকে অস্বীকার করার আর উপায় কারও নেই। ফলে পরিবর্তনের পথে আমাদের হাঁটতেই হবে।
তবে একটি কথা আমাদের অবশ্যই মানতে হবে, যা কিছুই করা হোক না কেন, সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা অক্ষুণ্ন রেখেই করতে হবে।
পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের যেকোনো ক্রান্তিকালে অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলেন। ফলে ক্ষতি হয়ে যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সাংবাদিকতা চর্চায় তথা খোদ সাংবাদিকতায় কিছু ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সেদিকটাতে দৃষ্টি দিতে হবে।
সাংবাদিকতা শব্দের সঙ্গেই এর নীতি-নৈতিকতার বিষয় সম্পর্কিত। আমরা যখনই সাংবাদিকতা শব্দটি উচ্চারণ করি তখন ধারণায় আসে মহান কোনো পেশার নাম উচ্চারিত হলো। তবে সে হয়তো অনেক আগের কথা। বরং সাংবাদিকতার চর্চায় নীতিবর্জনই এখন বেশি করে আলোচিত, যা থামানো প্রয়োজন। কিন্তু কিভাবে?
একটি কথা বলতেই হবে, এখন আর সাংবাদিকতা বা জার্নালিজম এই শব্দটি বললেই চলছে না। আপনি যদি ভালো কিছু করে থাকেন, কিংবা ভালো কিছু করতেও চান, তাহলে আপনাকে সাংবাকিতার সঙ্গে ভালো শব্দটিও জুড়ে দিতে হবে। বলতে হবে ‘গুড জার্নালিজম’। আর সম্ভবত অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন এই ‘গুড জার্নালিজম’র চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আর তার কারণও একটাই— ভালো সাংবাদিকতার অভাব রয়েছে বলেই এর চাহিদা কিংবা এর জন্য প্রত্যাশা বেড়েছে।
আলোচনা যখনই যেখানে হচ্ছে, তা হোক অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, দেশের ভেতরেই কোনো সেমিনার-আলোচনা সভায়, কিংবা দেশের বাইরেও কোনো ফোরামে— অনেকেই বলছেন, পরিস্থিতিটা ঠিক আমাদের অনুকূলে নেই।
তবে আমি ঠিক উল্টোটা ভাবি। শুরুতেই যে কথা বলেছি— আমার মনে হয়, সাংবাদিকতা আসলে অতীতে আর কোনোকালেই এখনকার মতো এত সহজ ও স্বল্প খরচে করা সম্ভব ছিল না। সাংবাদিকতা এখন অনেক বেশি সাশ্রয়ী। নানা ধরনের গ্যাজেট এখন আমাদের হাতে। হরেক রকম ডিভাইস, অনেক ধরনের সেবা। হার্ডওয়ার, সফটওয়্যার— দুই দিক থেকেই এই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা এখন সাংবাদিকতা চর্চায় হাতের কাছে এমন সব গ্যাজেট পেয়ে যাচ্ছি, অতীতে সাংবাদিকরা তা কল্পনাও করতে পারতেন না। এখানে আমাদের ব্যর্থতা একটাই— আমরা এই সব গ্যাজেটের ব্যবহার করতে পারছি না। কেউ কেউ তো আরও একটু পিছিয়ে থেকে এখনো এসব কিছুকে মেনেই নিতে পারছি না।
খুব সম্প্রতি কয়েকটি গ্যাজেটের কথা জানতে পেরেছি, যা দেখে নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকেছে। রয়েছে কিছু সফটওয়্যারও, যেগুলো রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো সহজ করে দিয়েছে সাংবাদিকতাকে।
ক্যামেরার কথাই ধরুন না। আমরা এখন এমনই এক বিশ্বে বাস করছি, যেখানে সারাক্ষণ প্রতিটি মানুষ হাতে একটি ক্যামেরা বহন করছেন। সুতরাং মিডিয়ার জন্য ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট সংগ্রহ এখন খুবই সহজ একটি কাজ। ফলে খবরের সঙ্গে ছবি কিংবা ভিডিও ক্লিপ দেওয়ার সুযোগটা এখন সবচেয়ে বেশি। আর সাংবাদিকতার তত্ত্বই তো বলে, ছবি হাজার শব্দের কথা বলে। ভিডিও নিয়ে তেমন কোনো প্রবাদ তৈরি হয়নি। প্রয়োজন ছিল না বলেই হয়নি। তবে এখন একটি কথা বলা হয়, ভিডিও ইজ এভরিথিং। অর্থাৎ ভিডিওটাই সব।
এই যে, ‘প্রিন্ট ইজ প্রুফ’ বলে যারা এতদিন গলা ফাটিয়েছেন, তারাও এখন বুঝতে পারছেন, সাংবাদিকতার মূল মর্মবাণী যেখানে গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা, সেখানে ছবি বা ভিডিওর চেয়ে বড় প্রমাণ হয়ে আর কিছুই দাঁড়াতে পারে না। সে কারণেই বলা, কাজটি সহজ হয়েছে। আরেকটু এগিয়ে বলা চলে, বিষয়টি সাংবাদিকতাকে আরও গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সাহায্য করেছে। এতে সমাজ ও মিডিয়া— দুই-ই সুবিধা পাচ্ছে।
এর সঙ্গে সঙ্গে তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করা এখন অত্যন্ত সহজ। একটি কথা এখন খুব বলা হচ্ছে— ফ্যাক্ট চেকিং। মানে তথ্য যা পেলেন, সেটা ভুল কি নির্ভুল, তা স্রেফ সফটওয়্যারে ফেলেই আপনি যাচাই করে নিতে পারেন। এতে আপনার শারিরীক খাটুনি লাগছে না। ঘুরতে হচ্ছে না দরজা থেকে দরজায়। ফলে ডেডলাইনের মধ্যে থেকেই আপনি চটজলদির সাহিত্য চর্চা করতে পারছেন। অতীতে আপনাকে কর্তৃপক্ষ তার প্রেসনোটে যা বলত, তার ওপরই ভরসা করতে হতো। এখন তা হচ্ছে না। আর যে বা যারা ঘটনার শিকার, তাদেরও খুব সহজেই হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছেন। শুধু যে তিনি বা তারা— তাও নয়, ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে, সেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত বা ঘটনাস্থলে যাতায়াতকারী ব্যক্তিও হয়ে উঠতে পারেন আপনার সংবাদকর্মী। একটি ছবি তুলে কিংবা ভিডিও করে আপনাকে তা পাঠাতে পারেন। বিষয়টি এক ক্লিকের ব্যাপার মাত্র। ফলে কোনো সংবাদের সংবাদ হতে হলে সত্যনিষ্ঠ হয়ে ওঠার যে নিশ্চয়তা প্রয়োজন, সেটিও এখন সহজ। অর্থাৎ সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা চর্চাও চাইলেই হাতের নাগালে নিয়ে আসা সম্ভব আগের চেয়ে অল্প আয়াসে।
ইউজার জেনারেটেড কনটেন্ট। গালভরা এই নামের ব্যবহারযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছেই। আর মূলধারার সাংবাদিকতায় তা বেশ জায়গাও করে নিচ্ছে। আর নাগরিক সাংবাদিকতা বা সিটিজেন জার্নালিজম শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে আরও অনেক আগে থেকেই।
এতে আরেকটি কাজ হচ্ছে। তা হচ্ছে— মূলধারার সাংবাদিকতার ওপর একটা চাপ। সাংবাদিকতার তথা খবর প্রকাশের যে একচেটিয়া সক্ষমতা সংবাদমাধ্যমের হাতেই ছিল, তা এখন আর নেই। খবর মিলছে। সর্বত্রই মিলছে। কাঠামোগত দিক থেকে, তথা দায়িত্বশীলতার দিক থেকে সেগুলো তেমন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না বটে, কিন্তু খবরের এই বিস্তৃতি মূলধারার ওপর চাপ তৈরি করতে পেরেছে ভালো করেই। ফলে সাংবাদিকতার আরও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি তৈরি হয়েছে।
দ্রুত খবর দেওয়ার কারণে ভুল খবর ছড়ানোর আশঙ্কা বেড়েছে বলে যারা মনে করছেন, তাদের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এর মধ্যেও যোগ্য সংবাদমাধ্যমগুলো কোনো ভুল না করেই এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে। প্রযুক্তিই সে পথ তৈরি করে দিচ্ছে।
ফলে ‘গুড জার্নালিজম’ চর্চার মধ্য দিয়ে পাঠকের কাছে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠতে পারছে। এতে ধীরে ধীরে হলেও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সারাবাংলা ডটনেট তেমনই একটি সংবাদমাধ্যম। দুই বছরের পথ চলায় পাঠকের মধ্যে যেটুকু আস্থা সারাবাংলা তৈরি করতে পেরেছে, সেটিই পরম পাওয়া ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
সারাবাংলার সকল পাঠককে জানাই দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
অনলাইন পোর্টাল ইউজার জেনারেটেড কনটেন্ট মাহমুদ মেনন খান সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা সাংবাদিকতা সাংবাদিকতা চর্চা সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ সারাবাংলা ডটনেট সিটিজেন জার্নালিজম