যারা তালিকাকে বিতর্কিত করেছে, তারা এ যুগের রাজাকার
১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৩:৪৮
৪৯তম বিজয় দিবসের ঠিক আগের দিন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী যখন রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করেন, তাৎক্ষণিকভাবে তাকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। একই অনুষ্ঠানে মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, আগামী ২৬ মার্চের আগে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। এর আগের দিন মানে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, আগামী ১৪ ডিসেম্বরের আগেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং রাজাকারদের তালিকা প্রকাশের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। যদিও অনেকে বলছেন, ৪৮ বছর পর এসব তালিকা করা অর্থহীন, জাতিকে বিভক্ত করার সামিল। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ইতিহাস বিকৃতিরোধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পক্ষ-বিপক্ষটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। সঠিক তালিকা থাকলে ভবিষ্যতে ইতিহাসের বিকৃতি করা সহজ হবে না। এই তালিকাগুলো আরো অনেক আগেই করে ফেলা উচিত ছিল। অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবে এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি। এখনই তালিকাগুলো করে ফেলার সময়। কারণ আগামী ২০ বছরের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীদের আর পাওয়া যাবে না। তবে রাজাকারের তালিকা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যে লেজেগোবরে অবস্থা করেছে, তা ম্লান করে দিয়েছে; জাতির বিজয় দিবসের আনন্দ। এখন তো মনে হচ্ছে, মাফ চাই, কোনো তালিকা দরকার নেই। ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলা।
প্রথম দফায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেন। তিনি জানিয়েছিলেন যাচাই-বাছাই করে ধাপে ধাপে আরও তালিকা প্রকাশ করা হবে। মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যারা ৭১ সালে রাজাকার, আলবদর, আল শামস বা স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিয়োগ পেয়েছিলেন এবং যেসব পুরোনো নথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত ছিল, সেটুকুই প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া যেসব দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যাবে, শুধু সেটুকু প্রকাশ করা হবে। কোনো তালিকা শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে প্রকাশ করা হবে না। অন্যায়ভাবে কেউ তালিকাভুক্ত হবে না’।
কিন্তু একদিনের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেল, তার আশ্বাসে ভরসা রাখার উপায় নেই। রাজাকারের তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম আছে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ১৭ জন তালিকাভূক্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম আছে তালিকায়। আছে ৩৮ জন নারী এবং ৯২ জন সংখ্যালঘুর নামও। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, পক্ষের অনেক মানুষের নাম এ তালিকাকে বিতর্কের চূড়ায় তুলেছে। দেশজুড়ে এখন ক্ষোভ, নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড়। যা হতে পারতো আনন্দের উপলক্ষ্য, তাই এখন মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে গভীর বেদনার ক্ষত তৈরি করেছে।
গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বরিশাল সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচন করেছিলেন বাসদ নেত্রী ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী।
জিততে না পারলেও তিনি নজর কেড়েছিলেন অনেকের। তার পিতা এডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নিয়মিত ভাতাও পান। তার নাম আছে রাজাকারের তালিকায়। শুধু তাই নয়, মনীষার ঠাকুরদা এডভোকেট সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে একাত্তরের ১২ আগস্ট পাকিস্তানী হানাদাররা বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তিনিও শহীদ এবং ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। রাজাকারের তালিকায় আছে শহীদ সুধীর কুমার চক্রবর্তীর স্ত্রী উষা রাণী চক্রবর্তীর নামও।
সিরাজগঞ্জের সবচেয়ে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের একজন ছিলেন লতিফ মির্জা। একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য লতিফ মির্জার নাম রাজাকারের তালিকায় দেখে তার পরিবার এখন লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না। তবে রাজাকারের তালিকায় থাকা যে নামটি গোটা জাতিকে চমকে দিয়েছে, তিনি হলেন এডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর। ৮৮ বছর বয়সেও যিনি যুদ্ধাপরাধীদের সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ আদালতের কাঠগড়ায় নিয়ে যাচ্ছেন, তিনিই যদি রাজাকার হন তাহলে গোটা প্রক্রিয়াটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। গোলাম আরিফ টিপু যদি রাজাকার হন, তাহলে যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রক্রিয়ায় তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, প্রশ্ন উঠবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে। আর যদি রাজাকার না হন, তাহলে রাজাকারের তালিকাটি প্রশ্নবিদ্ধ। তবে ইতিমধ্যেই তালিকাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। একুশে পদকপ্রাপ্ত গোলাম আরিফ টিপু রাজাকারের তালিকায় নিজের নাম দেখে ক্ষুব্ধ, লজ্জিত, মর্মাহত। তিনি প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম থাকার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। সংশোধন বা প্রয়োজনে রাজাকারের তালিকা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বললে, তার হৃদয়ে বেদনার যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়, নিছক দুঃখপ্রকাশেই কি তা প্রশমিত হবে?মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, প্রকাশিত তালিকাটি তারা করেননি, পাকিস্তান করেছে। পাকিস্তান সরকার যাদেরকে রাজাকার, আল বদর আল শামস হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকা নথি দেখে তা হুবহু প্রকাশ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, তাদের পাঠানো নথি যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকাশ করা হয়েছে। দুই মন্ত্রীর দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে মানতেই হবে রাজাকারের তালিকার মত একটি অতি স্পর্শকাতর বিষয় প্রকাশের ক্ষেত্রে চরম অদক্ষতা, খামখেয়ালীপনা এবং অবহেলা করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় তাড়াহুড়ো করা হয়েছে। ২০১৯ সালের বিজয় দিবসের আগেই রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে হবে, এমন কোনো দিব্যি তো কেউ দেয়নি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো নথিটি যাচাই-বাছাই করে, প্রয়োজনে মাঠ পর্যায়ের তদন্ত শেষেই সেটা প্রকাশ করা যেতো। পাঁচ বছর পর সঠিক তালিকা প্রকাশ করলেও কেউ আপত্তি করতো না।সবার আগে ব্রেকিং নিউজ দিতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মাঝে মধ্যেই ভুল নিউজ দিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তাড়াহুড়োয় তেমন একটি ছেলেমানুষি দেখা গেছে। কিন্তু টেলিভিশনের একটি ভুল ব্রেকিং নিউজ আর রাজাকারের ভুল তালিকা এক নয়। এই ভুল তালিকা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রক্ষার লড়াইয়ে একটি বড় কালো দাগ হয়ে থাকবে। এই তালিকা এখন বারবার স্বাধীনতাবিরোধীদের রেফারেন্স হবে। এই তালিকার ভুলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সত্যিকারের রাজাকাররাও নিজেদের বাঁচাবার চেষ্টা করবে। বড্ড ক্ষতি হয়ে গেল।
মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করাই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাজ। কিন্তু বেদনার সাথে বলতে হয়, এই মন্ত্রণালয় একসময় মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানি আর অপমানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র ছিল। বর্তমান মন্ত্রী তার অনেকটাই দূর করতে পেরেছিলেন। তার কাছ পর্যন্ত যেতে পারলে, মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। তবে রাজাকারদের ভুল তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দেবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিতর্ক রাজাকারের তালিকা নিয়েই প্রথম নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট নিয়েও অনেক তুঘলকি খবর শুনি। দেশে এখন দুই ধরনের মুক্তিযোদ্ধা আছে- মুক্তিযোদ্ধা এবং সার্টিফিকেটধারী ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তবে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটির সাথে ‘ভুয়া’ শব্দটি বসাতে আমার প্রবল আপত্তি। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা কোনো কিছু পাওয়ার আশায় তারা যুদ্ধ করেননি। দেশকে স্বাধীন করতে তারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন। যুদ্ধ করার সময় তারা ভাবেননি, কখনো তারা কোনো সুবিধা পাবেন। আজ যারা চাকরির সুবিধা, কোটা, ভাতা, প্লটের জন্য মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট জোগাড় করেছেন; তারা প্রতারক, জোচ্চোর। অনেক অমুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকারও নাকি জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন। এমনকি সচিবদের কেউ কেউও বাড়তি চাকরি করার আশায় জালিয়াতি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মূল কাজই হলো সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করা। কারা একাত্তরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল, কারা পাকিস্তানী হানাদারদের সহায়তা করেছে; তাদের নাম প্রকাশ করা। কিন্তু সে দায়িত্ব পালনে তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
রাজারদের তালিকার এই লেজেগোবরে অবস্থার জন্য স্রেফ অদক্ষতা, অবহেলা বা খামখেয়ালীকে দায়ী করতে মন সায় দিচ্ছে না। বারবার সন্দেহ হচ্ছে, সরকারের ভেতরের কেউ সরকারকে বিতর্কিত করতে, মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে, রাজাকারদের বাঁচিয়ে দিতে রাজাকারের তালিকার মধ্যে ইচ্ছা করে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঢুকিয়ে দেয়নি তো? মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দুঃখপ্রকাশ, তালিকা সংশোধন বা বাতিল করলেই হবে না। এই রকম একটি ভুল তালিকা দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য যারা দায়ী তাদের খুঁজে বের করতে হবে, তাদের শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু সেটার কোনো লক্ষণ নেই। বরং বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী লিখিত যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা রাজাকারদের তালিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের বেদনা, অপমান আরও বাড়াবে। লিখিত ব্যাখ্যায় মন্ত্রী দুঃখপ্রকাশ করলেও বলেছেন, তালিকায় ভুলভাবে যদি কারো নাম এসে থাকে, আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই অন্তে তাঁর/তাঁদের নাম বাদ দেয়া হবে। তার মানে রাজাকার নন, এটা এখন আপনাকে প্রমাণ করতে হবে। সকল কাগজপত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের আমলাদের পেছনে পেছনে ঘুরতে হবে। তারা তাচ্ছিল্য করে বলবে, যান অমুক কাগজ নিয়ে আসেন। সাবধান, কোনো কাগজ হারিয়ে গেলে কিন্তু আপনাকে সারাজীবন রাজাকারই থাকতে হবে। আচ্ছা, লতিফ মির্জার মত যারা মারা গেছেন, তারা কীভাবে আবেদন করবেন?
রাজাকারের তালিকা নিয়ে বিতর্কের কথা শুনে আমার স্ত্রী মুক্তি শিকদার বললেন, ‘যারা এটা করেছে, তারা এ যুগের রাজাকার। এ যুগের রাজাকারদের তালিকাও প্রকাশ করা হোক, শাস্তি দেয়া হোক।’