মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি
১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ২৩:৩২
প্রিয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী, সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে আপনার সুনাম আছে। ব্যক্তিগতভাবে আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কও সুদীর্ঘকালের। আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন জয়দেবপুরে, সেখান থেকে আপনার সূচনা এবং মুক্তিযুদ্ধের পূর্বলগ্নে যে প্রতিরোধ প্রথম তৈরি হয়েছিল মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিসহ জয়দেবপুরের চৌরাস্তা থেকে বিভিন্ন জায়গায়, সেখানে আপনার সাহসী ভূমিকা ছিল। সেই আপনি বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে রাজাকারদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন। এই তালিকার পরিপ্রেক্ষিতে আমি আপনাকে এই খোলা চিঠি দিতে বাধ্য হচ্ছি। আপনি এই তালিকার ভুলভ্রান্তির বিষয়ে বলেছেন, এতে যদি বড় কোনো ভুল থাকে, তবে এটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। আর এরই মধ্যে যেসব ভুল ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, এর জন্য আপনি দুঃখপ্রকাশ করেছেন।
মাননীয় মন্ত্রী, একটি ভুল একটি জাতির জন্য কত নির্মম হতে পারে সে সম্পর্কে বোধহয় আপনার কোনো ধারণা নেই। আপনি এটাকে একটি নিছক ভুল হিসেবে বলতে চাইছেন এবং এর দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। আপনি যখন তালিকা প্রকাশের দিন-তারিখ পর্যন্ত দিয়ে দিলেন, তখন কিন্তু একবারও উল্লেখ করলেন না যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা বা অবদান আছে। আপনার এবং আপনার মন্ত্রণালয়ের এই কার্যক্রমের কারণে লাঞ্ছিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রয়াস ও প্রচেষ্টা। আর কী হয়েছে এর ফলে? স্বাধীনতাবিরোধীদের উল্লসিত করেছে আপনার মন্ত্রণালয়ের এই অবিমৃষ্যকারী পদক্ষেপ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে আপনার কি উচিত ছিল না নিজে যাচাই করে দেখা? আপনার কি উচিত ছিল না রাজাকারদের তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা? এত বিশাল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য কি একটি কমিটি করা যেত না?
আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মেজর (অব.) আরেফিন বিভিন্ন জেলার রাজাকারদের সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করেছেন সরেজমিনে। এ নিয়ে কয়েক খণ্ডে পুস্তক আকারে প্রকাশও করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগের সঙ্গে আত্মিকভাবে যুক্ত থেকেছি। আমি জানি, ডা. হাসান এ ব্যাপারে কতখানি মনোযোগী ছিলেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কতখানি আন্তরিকতার সঙ্গে গণকবর অনুসন্ধান থেকে শুরু করে রাজাকারদের অবস্থান চিহ্নিত করার কাজে কিংবা গণহত্যার প্রশ্নে কী নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। কই, তাদের কাউকেই তো আপনার এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখলাম না।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার, আপনি এককভাবে এই তালিকা প্রকাশের কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের শক্তি অপদস্থ ও বিব্রত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যেখানে ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপুকে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ করেছেন, তিনি স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে, আর আপনার তালিকায় তাকে রাজাকার বানানো হলো! এটা কি কোনো ছোটখাটো ভুল? এর জবাব আপনাকে দিতেই হবে।
আমি একটু বিস্মিতই হয়েছিলাম, যখন দেখলাম যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রাজাকারের তালিকা প্রকাশের ব্যাপারে সদম্ভ ঘোষণা এলো, ব্যাপকভাবে বিভিন্ন জায়গায় প্রচারিত হলো এবং পরবর্তী পর্যায়ে একটা সময়ে তারিখও নির্ধারিত হলো যে ১৫ ডিসেম্বর থেকেই রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, আমি এই রাজাকারের তালিকা দৈনিক জাগরণের অনলাইনে প্রকাশ করার একটা চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু কোনোভাবে কোনো ধরনের সহযোগিতা মন্ত্রণালয় থেকে পাইনি। রাজাকারের তালিকা যেটা প্রকাশিত হলো সেটা আমাকে শুধু বিস্মিত নয়, অসহায় এবং শঙ্কিতও করছে। এটা কী করলেন আপনি? আপনার মন্ত্রণালয় এ কী কাজ করল? একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হিসেবে আপনি প্রথম থেকে একে নিজের কৃতিত্ব বলে বিবেচনা করেছেন, পরবর্তী পর্যায়ে যদি এর মর্মান্তিক পরিণতি হয়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে? আমার মনে হয়, আপনার মন্ত্রণালয় কখনোই কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
আপনি এই তালিকা প্রকাশ করেছেন বিজয়ের মাসে, ১৬ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে ১৫ ডিসেম্বরে। আপনি এই তালিকা এমন একটি সময়ে প্রকাশ করেছেন, যখন দেশব্যাপী মুজিববর্ষ পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। এ সময় আপনি এই ঘোষণাটি দিয়ে কি কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছেন? এই তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আপনার মাধ্যমে সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অপমানিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে সে সময় আমরা রাজাকারদের চেহারা দেখেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে সেই পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের পর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে কিংবা খন্দকার মোশতাকের মতো লোকের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা হলো এবং রাজাকারদের তালিকাকে সম্পূর্ণভাবে তছনছ করে দেওয়া হলো, সেই অবস্থাও আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি কীভাবে বারবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করা হয়েছে। রাজাকাররা এটা ধ্বংস করেছে, পরবর্তী পর্যায়ে রাজাকাররা মন্ত্রী হয়ে এই তালিকা নষ্ট করেছে। সংযোজন করেছে মিথ্যা তথ্য। রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার বানিয়ে তালিকা প্রস্তুত করেছে। আর সেই নষ্ট তালিকার ওপর নির্ভর করেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সমস্ত অর্জনকে নস্যাৎ করার মাধ্যমে একটি তালিকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার করা হলো।
দেখলাম স্বয়ং আপনি সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, তালিকায় যে ভুলভ্রান্তি হয়েছে তার জন্য আপনি দুঃখিত। আর তালিকায় ভুলভ্রান্তি যদি খুব বেশি থাকে, তাহলে তালিকা প্রত্যাহার করা হবে। প্রশ্ন পরিষ্কার, আপনি কেন অপ্রস্তুত অবস্থায় এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতির কাছে উপস্থিত করলেন? এর জবাব তো আপনাকে দিতেই হবে। কেননা এটা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অপমান নয়, এটা সমগ্র জাতির প্রতি অপমান, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অপমান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অপমান, তার কন্যা যিনি এত দিন ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করে সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি আবহ তৈরি করেছেন, তার জন্য এটা অপমানজনক এবং তার প্রতি কটাক্ষের সমান। কাজেই আমার মনে হয়, আপনি শুধু দুঃখপ্রকাশ করলেই কিন্তু এর দায় মোচন হবে না। আপনাকে অবশ্যই এসব ভুলের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে সবকিছুকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং আপনাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তারপর জাতি বিবেচনা করবেন কিংবা সরকার বিবেচনা করবেন। স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে বলেছেন তালিকা সংশোধন করতে। এই পদক্ষেপ যৌক্তিক সন্দেহ নেই। তবে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিনীতভাবে নিবেদন জানাব যে তিনি বিবেচনা করবেন আপনি এই মন্ত্রণালয় পরিচালনার উপযুক্ত কি না। অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে এই কথাগুলো আমাকে লিখতে হলো আজ।
আপনি বন্ধুবৎসল ব্যক্তি। আপনার প্রতি আমার পরামর্শ হলো, এই মুহূর্তে সমস্ত দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে আপনার উচিত পদত্যাগ করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেবেন সেটা তার ব্যাপার। কিংবা রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাসে মুজিববর্ষের এই সূচনালগ্নে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এরকম ধরনের অদ্ভূত আচরণ অগ্রহণযোগ্য, এটা দৈনিক সংগ্রামের আবুল আসাদ যে অপকর্মটি করেছেন তার সঙ্গে যদি কেউ এই কর্মকাণ্ডের তুলনা করেন, তবে কী উত্তর হবে তার? আপনি কি বোঝেন না এই ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের কতখানি আহত ও বেদনার্ত করে? আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে এই ঘটনা থেকে কত সহজভাবে প্রমাণ করা যায় যে সমগ্র প্রশাসনযন্ত্র, মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমের সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনতাবিরোধীদের নিঃশব্দ পদচারণ রয়েছে। এ ব্যাপারে এখন সমগ্র জাতিকে ভাবতে হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবতে হবে, সরকারকে ভাবতে হবে যে আমরা কীভাবে এই অবস্থায় নিজেদের রক্ষা করব। মুক্তিযুদ্ধের বিবেক বলতে যাকে বোঝায় সেই কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, ‘রাজাকারই যদি রাজাকারের তালিকা প্রস্তুত করে, তাহলে তো খুব স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযোদ্ধার নাম সেখানে রাজাকার হিসেবে থাকবে।’ এ অবস্থা আজকে সমগ্র ব্যবস্থাকেই একটা হাস্যকর জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এর অবসান চাই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার স্বপ্ন, স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন এবং মুক্তিযোদ্ধার ভাবনা যদি তুলে ধরতে হয়, তাহলে বাহাত্তরের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারাকে ফেরত আনতে হবে অবিকৃতভাবে, চার মূলনীতিকে পুনর্বাসিত করতে হবে। সেই সঙ্গে চিহ্নিত শত্রু, গুপ্তশত্রু সবাইকে চিহ্নিত করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাঁচানো যাবে না।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ