Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুশাররফের রায়ে রুখে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনী; বেকায়দায় ইমরান


২১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৬:৫১

পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মুশাররফের বিরুদ্ধে আনা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে একটি বিশেষ আদালত মৃত্যুদণ্ডের যে আদেশ দিয়েছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে পাক সেনাবাহিনী। গত ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালতের তিন বিচারপতি ওই আদেশ দেন। এর দুদিন পর অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে- ‘পারভেজ মুশাররফ যদি পলাতক থাকেন তাহলে তাকে ধরে এনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে রায় বাস্তবায়ন করতে হবে অর্থাৎ জেনারেল পারভেজ মুশাররফকে ফাঁসি দিতে হবে। আর যদি তিনি মারা যান তাহলে তার লাশ এনে ইসলামাবাদের সংসদ ভবনের সামনে ফাঁসিতে তিনদিন ঝুলিয়ে রাখতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আদালতের এই রায়কে কোনভাবেই প্রথম থেকে মেনে নিতে পারছিল না। বরং রায়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল তারা। তাদের অসন্তুষ্টির কথা তুলেও ধরেছিল। সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে আইএসপিআরের মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর প্রকাশ্যে সামরিক বাহিনীর অসন্তুষ্টির কথা জানান। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, বিশেষ আদালতের এই রায়ে সামরিক বাহিনীর বহু কর্মকর্তার মধ্যে নিদারুন মনঃকষ্ট দেখা দিয়েছে। আইএসপিআরের বিবৃতিতে সুস্পষ্ট করে বলা হয়, ‘সাবেক একজন সেনাপ্রধান, জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যিনি ৪০ বছর ধরে দেশের সেবা করেছেন, দেশকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছেন- তিনি কখনো বিশ্বাসঘাতক হতে পারেন না।’

বিজ্ঞাপন

বিবৃতিতে আরো বলা হয়- বিশেষ আদালত সংবিধানসহ বিচার প্রক্রিয়াকে অগ্রাহ্য ও আত্মরক্ষার মতো মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে মনে হচ্ছে। মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করার কথাও বলা হয় আইএসপিআরের বিবৃতিতে। বলা হয়- ‘পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী আশা করে, দেশের সংবিধান মেনেই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।’

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ১৯ ডিসেম্বরই মেজর জেনারেল আসিফ গফুর অনির্ধারিত এক সংবাদ সম্মেলনে সামরিক বাহিনীর চূড়ান্ত অসন্তুষ্টির কথা জানান। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সম্মান ও মর্যাদা কিভাবে রক্ষা করতে হয় তা আমাদের জানা আছে কিন্তু আমরা এ মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করছি কারণ আমরা চাই এ বিষয়ে সবার আগে রাষ্ট্র এগিয়ে আসুক।’ জেনারেল আসিফ গফুর আরও বলেছেন, ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানবতা এবং সভ্যতার বাইরে গিয়ে আদালতের রায় দেয়া হয়েছে এবং এর শব্দচয়ন করা হয়েছে।’

ধারণা করা হচ্ছে- জেনারেল মুশাররফের লাশ সংসদ ভবনের সামনে ঝুলিয়ে রাখার যে কথা বলা হয়েছে রায়ে, আইএসপিআরের মহাপরিচালক সেই অংশটির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি পরিবার। আমরা জানি কিভাবে দেশ রক্ষা করতে হয়। আমরা আমাদের সম্মান, মর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠানকেও রক্ষা করতে জানি।’

পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ডন জানিয়েছে, জেনারেল মুশাররফের বিরুদ্ধে রায় হওয়ার পর রাওয়ালপিণ্ডির সেনা সদরদপ্তরে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা বৈঠকে মিলিত হন। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে পাক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া রাওয়ালপিন্ডিতে এসএসজির সদরদপ্তরে সেনাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। পারভেজ মুশাররফ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের একজন কর্মকর্তা ছিলেন সেই এসএসজি বিশেষভাবে ক্ষুব্দ হয়ে উঠেছে আদালতের এই রায়ে। গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা দেখেছি- সেনা সদস্যদের মাঝে দাঁড়িয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়াও সবার সাথে মুষ্টিবদ্ধ হাত উচু করে আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছেন।

পরিস্থিতি যখন খুবই টালমাটাল তখন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ভেতরে যে প্রচণ্ড রকমের ক্ষোভ বিরাজ করছে তা তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। ইমরান খানের সঙ্গে জেনারেল বাজওয়ার ১৯ ডিসেম্বরের ওই বৈঠক সম্পর্কে আইএসপিআর বলেছে, বৈঠকের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে দেশের জনগণকে সরকারই জানাবে।

স্মরণ করা যেতে পারে- জেনারেল পারভেজ মুশাররফ ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর এক রক্তপাতহীন সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন। ২০০৪ সালে শওকত আজিজকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বেসামরিক পর্যায়ে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করেন। এরপর দীর্ঘদিন জোর করে ক্ষমতায় থাকার পর যখন জেনারেল মুশাররফের রাজনৈতিক অবস্থান টালমাটাল হয়ে পড়ে তখন ২০০৭ সালে সংবিধান রোহিত করে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। তারপরও রাজনৈতিক অবস্থান দিনে দিনে নড়বড়ে হয়ে ওঠে এবং এক সময় তা চরম পর্যায়ে চলে যায়। এ সময় শওকত আজিজ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং মুশাররফের রাজনৈতিক অবস্থান নাটকীয়ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে ইমপিচমেন্ট এড়ানোর জন্য তিনি পদত্যাগ করেন এবং লন্ডনের স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান। জেনারেল মোশাররফই আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের সময় বুশ প্রশাসনকে অকুণ্ঠ সমর্থন করে পাকিস্তানকে মারাত্মক সংকটের ভেতরে ফেলে দেন। মুশাররফের সেই সিদ্ধান্তের খেসারত এখনো পাকিস্তানকে দিতে হচ্ছে, যে ভয়াবহ উগ্রবাদ পাকিস্তানকে বছরের পর বছর নাকাল করেছে তার পেছনে মুশাররফের ওই সিদ্ধান্ত বড় ভূমিকা রেখেছে।

২০১৩ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে তিনি অংশ নেয়ার চেষ্টা করেন এবং এজন্য তিনি লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন। বেনজির ভুট্টো এবং নবাব আকবর বুগতিকে হত্যার জন্য জেনারেল মুশাররফ এবং শওকত আজিজের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। ফলে জেনারেল মুশাররফ ওই নির্বাচনে অংশ নিতে ব্যর্থ হন। ২০১৩ সালে নওয়াজ শরীফ ক্ষমতায় আসার পর জেনারেল মুশাররফের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার পদক্ষেপ নেন। ২০০৭ সালে সংবিধান রোহিত করে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করার অপরাধে মুশাররফের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়। সেই মামলায় পাকিস্তানের বিশেষ আদালত মুশাররফকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে।

যাহোক, পাক সামরিক বাহিনীর নানা তৎপরতা ও বিবৃতির ভেতর দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে যে, জেনারেল পারভেজ মুশাররফের মৃত্যুদণ্ডের রায়ে খুশি নয় তারা বরং একরকমের যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখিয়েছে। এতে ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে ইমরান খানের সরকার। কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, সেনাবাহিনী এবং সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার জন্য এই রায় দেয়া হয়েছে। কেউ বলেছেন, সামরিক বাহিনীকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দুর্বল করার জন্য এই রায়।

জেনারেল মুশাররফের রায়কে ঘিরে আসলে সংকট খুব সাধারণ পর্যায়ে থাকে নি। এ নিয়ে রীতিমতো ইমরান খানের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রীরা এবং ক্ষমতাসীন পিটিআই দলের নেতারা বৈঠক করেছেন। শুধু তাই নয় মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত কুয়ালালামপুর সামিট-২০১৯ এ যোগ দিতে পারেন নি ইমরান খান। দেশকে এই অস্থিতিশীল অবস্থায় রেখে তিনি কোনমতেই কুয়ালালামপুর সম্মেলনে যোগ দেয়ার ঝুঁকি নেন নি। ১৯৯৯ সালে শ্রীলংকা সফর থেকে দেশে ফেরার সময় নওয়াজ শরীফ জানতে পারেন জেনারেল মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন এবং ক্ষমতা দখল করে নিয়েছেন। তখন নওয়াজ শরীফ চলে গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। ইমরান খান সম্ভবত কুয়ালালামপুর সামিটে যোগ না দিয়ে তেমনই একটি ঝুঁকি এড়ালেন।#

লেখক: সিরাজুল ইসলাম, রেডিও তেহরানের সাংবাদিক

দণ্ড পাকিস্তান পারভেজ মোশাররফ

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর