শ্রদ্ধা, স্যার ফজলে হাসান আবেদ
২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ১১:৩৬
মানুষের ভেতর সৎ এবং অসৎ এই দুই প্রবৃত্তিই আছে। সৎ ও অসৎ প্রবৃত্তির বিশ্লেষণ করতেও আমরা সমর্থ। পরের দুঃখে দুঃখী হওয়া, পরের সুখে সুখী হওয়া, পরোপকারের প্রবৃত্তি, পরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, কোনও অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বা সেই কাজের প্রতিরোধ করা, সৎকার্য সাধনে দৃঢ়চিত্ত হওয়াই সৎবৃত্তির অন্তর্গত।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ সেই সৎ প্রবৃত্তির মানুষ। মানুষের কল্যাণ এবং সার্বিক উন্নতিতে কাজ করার অভীপ্সায় আত্মনিয়োজিত ফজলে হাসান আবেদের মত মানুষ আর দেখিনি। খুব যে কাছের ছিলাম তা নয়। আমার নানা বাড়ি তার খুব বাড়ির খুব কাছের হওয়ায় মা’র আত্মীয়দের মুখে তার কথা শুনেছি। সাংবাদিক হিসেবে তার মুখোমুখিও হয়েছি কয়েকবার। যতবার তাঁর কাছে গিয়েছি আর যত তাঁর সম্পর্কে জেনেছি, শুধু মনে হয়েছে হৃদয়বান এই মানুষটি অজ্ঞ, কাতর, পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজে, তাদের স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে সবসময় ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কখনও কোন অবস্থাতেই বিচ্যুত হননি সেই প্রতিজ্ঞা থেকে।
ইউরোপের অভিজাত উঁচু স্তরের কর্পোরেট জীবন ছেড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পীড়িত মানুষের সেবা করতে এসে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর ফিরে যাননি। ফিরে যাননি কারণ তার জীবনাচরণ ও দর্শন সবটা জুড়ে ছিল মানুষের কথা। তাঁর কাজ ও কথা, নিজের হাতে গড়ে তোলা ব্র্যাকের দর্শনেও আছে সেই মানুষের কল্যাণ ও উত্থানের প্রসঙ্গ এবং প্রাধান্য।
সার ফজলে হাসান আবেদকে নিয়ে বড় মানুষেরাই লিখছেন, বলছেন। যাঁরা তাঁর সাথে কাজ করেছেন, যাঁরা নানাভাবে তাঁর কাছের ছিলেন তারা সবাই বলছেন। সাংবাদিক হিসেবে, সমাজের পর্যবেক্ষক হিসেবে আমার মনে হয়েছে স্যার আবেদ আত্মপরতায় বাঁচতে চাননি, চেয়েছিলেন পরার্থে জীবন উৎসর্গ করতে। আর এই উৎসর্গের মাধ্যম ছিল নিরলস কাজ, সৃজনশীল কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আমি যখন ব্র্যাক শুরু করেছিলাম, দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে—এটাই ছিল তখন একমাত্র ভাবনা। কখনো ভাবিনি যে ব্র্যাক একদিন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এনজিও হবে কিংবা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজের বিস্তার ঘটাবে। ব্র্যাককে আমরা বলি ‘লার্নিং অর্গানাইজেশন’। কাজ করতে গিয়ে আমরা প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছি”।
দরিদ্র মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে, তাদের জীবন বদলে দিতে গিয়ে তিনি ভাবনার জগতে দরিদ্র থাকেননি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি, দর্শন-মনন-প্রজ্ঞার অপরিসীম বিস্তৃতি, সমাজ-সভ্যতার দ্রুত সম্প্রসারণে তিনি বরাবর নিজেকে আর ব্র্যাককে নিয়ে এগিয়েছেন। দেশে-বিদেশে ব্র্যকের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো, ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলো, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, আড়ংসহ সবগুলো প্রতিষ্ঠান উৎকর্ষতায় সেরা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা এবং প্রত্যাশাগুলো বদলাতে থাকে সেটা তিনি জানতেন। জানতেন বলেই সভ্যতার বিপরীতে মানুষে মানুষে হিংসা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অভাবনীয় স্খলন-পতন-বিভেদ-বিদ্বেষ-বিপর্যয়-বীভৎস কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত থেকেছেন। তার প্রতিষ্ঠানকে, তার বিশাল কর্মী বাহিনী আর ব্র্যাকের সাথে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য মানুষকে তিনি শুভচেতনা ও নৈতিক মূল্যবোধে আচ্ছন্ন করতে চেয়েছেন।
স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম নিয়েছেন, সম্পদশালী দেশে থেকেও স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন একজন নির্মোহ মানুষ। আমরা বুঝতেই পারছি যে, তিনি চাইলে ব্যক্তিগতভাবে অনেক সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। নিজের সম্পদের পেছনে ছুটলে তাঁর জীবনের ব্রত থেকে দূরে সরে যাবেন বলে সেদিকে ছোটেননি তিনি। এই সাধনাই মানুষের পরিচয়। তিনি ছিলেন যথার্থ মানুষ, ভাল মানুষ, সচেতন, শুভ্র, সুন্দর, বুদ্ধ, শুদ্ধসত্ত্ব, প্রমুক্ত মানুষ। জন্মালেই সবাই মানুষ হয়ে যায় না। মানুষ হয়ে উঠতে হয়। চেতনার সম্প্রসারণে বড় হতে হয়।
তিনি ছিলেন অগ্নিময় আত্মবিশ্বাসের অধিকারী। তাইতো তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও। দেশ-মহাদেশের সীমা অতিক্রম করে তিনি নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তার প্রতিষ্ঠানকেও নিয়ে গেছেন তাদের কাছে। বিশ্বের তাবৎ মানুষের সঙ্গে বাঙালির আত্মিক যোগ স্থাপন করেছে তাঁর ব্র্যাক। আজ তিনি নেই, কিন্তু তিনি আছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, আছেন বিশ্ব মাঝে। ধরিত্রীর নানা প্রান্তে দারিদ্র্য ও শোষণের যন্ত্রণায় ছটফট করা মানুষের পাশে থেকে যাবেন ফজলে হাসান আবেদ।
ব্র্যাক গ্লোবাল বোর্ডের চেয়ার আমীরা হক বলেছেন, ভবিষ্যতের জন্য সবসময় প্রস্তুত থেকেছেন তিনি। কিন্তু কীভাবে? আমার নিজের কাছে উত্তর হল – বুদ্ধি ও চিন্তার বিকাশে, মনন ও প্রজ্ঞায়। তিনি বিশ্বাস করতেন আভিজাত্য ধনসম্পদের দিক থেকে নয়, ভাবনার সমৃদ্ধিতে, চিন্তার ঐশ্বর্যে, উদ্দীপনায়। আর সে জন্যই তিনি মানবতার আলোকিত ভুবন গড়তে চেয়েছেন। জীবনে জীবন সংযুক্তির প্রত্যয় ছিল তার হৃদয়ে। পিছিয়ে পড়া অজ্ঞ, কাতর, শোষিত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষজনের পাশে থেকে জীবনের মূল স্রোতে শামিল করার বিষয়টিকে আর এমন করে কেউ দেখবেনা হয়তো যেভাবে দেখেছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ও জিটিভি
সারাবাংলা/এমএম