নতুন বছর, নতুন আলো
৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ২৩:৩৫
আরও একটি নতুন বছর, আবারও নতুনের শুরু। গত বছর যখন এই পয়লা জানুয়ারিতে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম, তখনো প্রত্যাশা ছিল সবার জন্য বছরটি শুভ থাকুক। কিন্তু তা আসলে থাকে না। সবার জন্য সারাটা বছর সাজানো থাকে না ভালবাসার ওমে।
আমাদের ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা ফলপ্রসূ হয় তখনই, যখন আমরা আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে সাজাতে পারি সুন্দর করে। একটি শান্তিপূর্ণ সহিষ্ণুতার সমাজ গড়ার প্রত্যয় যদি থাকে, তবেই ভালো থাকা যায়। ইংরেজি বর্ষবরণ করতে পশ্চিমাদের মতোই অনেক আয়োজন এই শহরে হবে, আবার কোথাও সেই আয়োজনের লেশমাত্র থাকবে না। যাদের থাকে না, অর্থাৎ অর্থনৈতিক সক্ষমতা যাদের নেই, যারা আনন্দ আয়োজন থেকে সব সময় দূরে, তাদের ভাবনাটা আমাদের শাসন পরিচালনার প্রথায়, আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় থাকে কি না— সেটাই বড় কথা।
সংসদ নির্বাচনেরও একটি বছর চলে গেছে। শেখ হাসিনাও সরাসরি তার তৃতীয় মেয়াদের একটি বছর পার করে দিয়েছেন। নতুন বছরের শুরুতেই হতে যাচ্ছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। স্থানীয় সরকার কাঠামোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং কেন্দ্রে অবস্থানকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সেই উপলক্ষে রাজনৈতিক উত্তাপ তথা টানাপোড়েন বাড়তে শুরু করেছে এরই মধ্যেই। চলতি সপ্তাহ থেকেই ধাপে ধাপে আরও চড়বে রাজনীতির পারদ। মেগা সিটির মানুষেরা তাদের নগরের শাসকদের বেছে নিতে চলেছে, হইচই তো একটু হবেই। কিন্তু সেই হইচই, সেই টানাপড়েন, সেই উত্তাপ যেন সহনশীল মাত্রায় হয়, সেটাই প্রত্যাশা।
বিদায়ী বছরটির দিকে চোখ ফেরালে দেখি— আমরা অনেক কিছুই পেয়েছি, অনেক কিছু পেয়ে হারিয়েছি এবং অনেক কিছুই যেভাবে চেয়েছি, সেভাবে হয়নি। আমাদের জীবন, জীবিকা, অর্থনীতি, আমাদের পরিবেশ, প্রতিবেশের ওপর চেপে বসা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কোনো সামান্য ইঙ্গিতও পাইনি। একজন রোহিঙ্গাও ফেরত যায়নি এবং তাদের ফেরানো যাবে— সেই আশাও এখন কোথাও উচ্চারিত হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলেন ফসল নতুন সড়ক পরিবহন আইনটি ১৪ মাস পর কার্যকর করেও বাস্তবায়ন করা গেল না। কোনো সাফল্য না দেখাতে পেরেই আমরা সড়ক নিরাপদ রাখার প্রতিশ্রুতির আরও একটি বছর পার করেছি।
তবে অনেক না পাওয়ার মধ্যে একটি বড় আশার জায়গা তৈরি হয়েছিল বছরের শেষভাগে এসে দুর্বৃত্তবিরোধী অভিযানে। খোদ সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের বড় নেতারা ক্যাসিনো কাণ্ড, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন, বেশ কয়েকজনকে রাজনৈতিক পদও হারাতে হয়েছে। অর্থনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। বিশেষ করে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয় এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাত এখনো সুশাসনের অপেক্ষায়।
রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তারা নিশ্চয়ই নতুন উদ্দীপনায় নতুন বছরের পরিকল্পনা করবেন। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ নাগরিক, তারাও নিশ্চয়ই ভাবতে পারি নিজ নিজ ক্ষেত্রে আমরা নতুন বছরে কী প্রতিজ্ঞা সাজাতে পারি। নতুন বছর মানেই নতুন আশা, নতুন করে কিছু শুরু করা, নতুন করে স্বপ্ন দেখা। সব প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন করা যায় না। কিন্তু কিছু নিশ্চয়ই যায়। যেমন—
১. নাগরিক দায়িত্ব: নাগরিক হিসেবে আইন মেনে চলা, খেয়াল রাখা আমার জন্য যেন কোনো অঘটন না ঘটে— সেটা সড়কে হতে পারে, অন্য ক্ষেত্রেও। যিনি গাড়ির চালক, তিনি সঠিক লাইসেন্স নিয়ে চালাবেন, মালিক ফিটনেসবিহীন গাড়ি পথে নামাবেন না, যারা নীতি নির্ধারণী জায়গায় আছেন, তারা তাদের দায়িত্ব সততার সাথে, নিষ্ঠার সাথে পালন করবেন।
২. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কম বিচরণ: আমরা জানি এখনকার যুগে ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া জীবন অচল। কিন্তু এখানে সময়ও নষ্ট হয় প্রচুর। একটা প্রতিজ্ঞা হোক, প্রয়োজন ছাড়া কম থাকি সামাজিক মাধ্যমে। কাজ বাদ দিয়ে যেন এখানে সময় ক্ষেপণ না হয়। আর অবসর মানেই ফেসবুক বা ইউটিউব নয়, একটু মৌলিক লেখাপড়ার চেষ্টাও হোক।
৩. সুস্থ থাকার চেষ্টা: পরিবেশ দূষণ, খাদ্যে ভেজালসহ নানাবিধ কারণে আমরা রোগাক্রান্ত। আমরা নিজেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকা-খাওয়ার চেষ্টা করি, নিজেকে শারীরিকভাবে ফিট রাখার চেষ্টা করি, নিজের ও অন্যদের জন্য চারপাশকে সুস্থ রাখি।
৪. পরিবারকে হ্যাঁ বলুন: ব্যস্ত সবাই, কিন্তু পরিবার সময় চায়। বিশেষ করে পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনের মাঝে সেই মানুষটি, যার বয়স হয়েছে, যিনি অনেক একা হয়ে গেছেন, তাকে সময় করে দেখতে যাওয়া এ বছর একটি বড় কাজ বলে বিবেচিত হোক।
৫. সঞ্চয়ের স্বভাব গড়ে উঠুক: আগেই বলেছি, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় আছে। বিশ্বজুড়ে একটা মন্দা হাওয়াও আছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছুটা সঞ্চয়ের অভ্যাস হোক।
৬. নতুন বন্ধুত্ব গড়ি: যত বেশি নতুন মানুষের সাথে পরিচয়, যত বেশি বন্ধুত্ব তত বেশি নেটওয়ার্ক, তত বেশি সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত।
মানুষের জীবনের গতিপথ বড় বিচিত্র। কখন যে কোন পথে তা বাঁক নেয়, তা বোঝা মুশকিল। জীবনে বেঁচে থাকার সময়টুকু কম। এই অল্প সময় আমরা যেন সবসময় ইতিবাচক থাকি, সেটাই জীবনের মৌলিক দর্শন হোক আমাদের। নতুন বছরের নতুন দিনটি সামনে এসে দাঁড়াক নতুন আলোর প্রতীক্ষায়। সারাবাংলার সুধী পাঠকদের জানাই শুভকামনা, শুভ ২০২০।