আজ… যানে কি জিদ্ না করো!
২ জানুয়ারি ২০২০ ১৭:৩২
পিজি হাসপাতালের আইসিইউ’র সামনে মুখ ব্যাজার করে রফিক ভাই। ৩০ ডিসেম্বর। বাপ্পি আপা, বাঁচার জন্য ভেন্টিলেশন মেশিন এবং তাঁর স্বামী, পরিবার, বন্ধু, রাজনীতির সহযোদ্ধা ও ডিসিশন মেকারদের ওপর একটু দ্বায়িত্ব দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে কাঁচের ঘরের ভেতরের আরেক কাঁচের ঘরে।
আইসিইউ’র দরজায় দাঁড়িয়ে ওর মুখটা দেখতে পাওয়া যাবেনা। তাও চোখের দুপাশটায়, দুহাত দিয়ে বায়োলজিক্যাল বায়নোকুলার বানিয়ে দেখে নিলাম বাপ্পি আপাটাকে। ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পি। সাবেক সংসদ সদস্য। ওর পরিচয় আরো আরও অনেক কিছু লেখা যায়, আওয়ামীলীগের ‘অমুক-তমুক’…আইনজীবি। কিন্তু আমি তো, বন্ধু বাপ্পী কে দেখে নিলাম, যাকে দুষ্টুমি করে ডাকতাম… ‘ফাজিলাতুন নেসা’। আমাদের সার্কেলের সবাই এই দুষ্টুমির নামের পেছনের যৌক্তিক রসসুধা পেয়েছে। আড্ডার মধ্যমনি হবার দুরন্ত ক্ষমতার এই মহীয়সীকে রাজপথে যেমন বেদম পুলিশী পিটুনির শিকার হয়ে গাড়ি তোলার সময়, দূর থেকে আমাকে দেখে একটা দুষ্টু চাহনি দিতে দেখেছি, আবার অ্যাকিউট অ্যাজমা নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় ম্যাচিং কাপড়, টুপি, ব্যাগ জুতার বাহারের সাথে ওই দুষ্টু চাহনির সেলফি তুলতে হয়েছে আমাকেই।
আইসিইউর কাঁচঘরে বাপ্পিকে একটু কাতর, ক্লান্ত দেখার চেষ্টা করলাম। উঁহু…! কিছুতেই সে ধরা দিচ্ছেনা ওই চেহারায়। বরং বারবার, দুষ্টুমি ভরা মাদকতা নিয়ে যেন গাইছে- ‘আজ যানে কা জিদ্ না করো…, হায় মর যাউঙ্গে হাম্ তো লুট যাউঙ্গে…’
আমার এই বন্ধুটার কতটা অসুবিধা, কতটা ফাইট করতে হচ্ছে সেটা জানার জন্য ডাক্তারের ব্রিফ শুনলাম। নিমোনিয়া থেকে আইসিইউর ইনফেকশন ‘এর-আর-ডি-এস’ বাপ্পিকে ধরেছে। ডাক্তারদের সাথে ডাক্তারি ভাষায় বিতর্ক করার জ্ঞানতো নেই, শুধু মাস ছয়েক আগে আমাদের মেজদিকে হারানোর অভিজ্ঞতা থেকে বাপ্পির স্বামী, রফিক ভাইকে কয়েকটা ঝাঁঝালো কথা শোনালাম।
রফিক ভাই, নরম মানুষ। বাপ্পির এগ্রেসিভ কেয়ার, মায়া, ছায়া, নেতৃত্বের তলে বেড়ে ওঠা একজন প্রেমিক স্বামী। আড্ডাচ্ছলে আমরা রফিক ভাইকে নিয়ে দুষ্টুমি করলে, বাপ্পি আপা প্রোটেস্ট করতো- এ্যাঁই তোরা আমার ভালমানুষ স্বামীটারে খোঁচাইসনা…। ভঙ্গীটা এমন, যেন স্ত্রী নয় বলছে রফিকের মা। আমরা হাসতাম।
হাসপাতালের বারান্দায় বসা রফিক ভাইকে খোঁচালাম, ‘হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে হবে না রফিক ভাই, বাপ্পি আপা আপনাকে সুযোগ দিচ্ছে…।
ওর শুধু অক্সিজেন লেভেলটা স্ট্যাবল থাকছে না, বাকী সব ভালো। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে দিল্লি বা সিঙ্গাপুর নিয়ে যান। তাপসদা, প্রভাষ সব ঠিক করে দেবে!’
রফিক ভাই সিদ্ধান্তহীনতায়। শোনা গেলো, ভাই- পরিবারের অন্যরা যা বলবেন তাই হবে। আবারো শোনা গেলো, ডিসিশন দেবেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। কারন তিনি ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পিকে খুব স্নেহ করেন, বাপ্পি তাঁর পরিক্ষিত লয়াল কমরেড।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে তাপসদা আমাকে সামান্য শাসনের সুরে বলার চেষ্টা করলো, ‘মুন্নী তুমি বেশি জোর করছো। টাকা পয়সা জোগাড় করার ব্যাপার আছে, কে যোগাযোগ করবে, পরিবার চায় কিনা… কত ইস্যু!
বাপ্পি আপার পরিনতির সাথে নিজের বাস্তবতা মেলাই। আমাদের মতো, এগ্রেসিভ, কাজের প্রতি লয়াল, বন্ধুত্ব আর সম্পর্কের প্রতি কপটতাহীন ওয়ার্কিং ওম্যানদের পরিণতিটা বুঝি একই! ভালবাসার সাহসে বাঁচিয়ে তোলার সিদ্ধান্তহীনতায় বলয় তৈরি করে রাখছি কি?
আমাকে থামিয়ে, তাপসদা নিজেই আরো বেশি নেমে পড়ে বাপ্পি আপার সুচিকিৎসার একটি তড়িৎ সিদ্ধান্ত পাবার জন্য। কারণ, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউর মেশিনের ইনফেকশন, নবিশ সব চিকিৎসা স্টাফ আর ২৪ ঘন্টা মুমূর্ষ রোগীদের আত্মীয়-স্বজনদের ওষুধ আনা নেওয়ার হ্যারাসমেনন্টের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী, লাশ করে ফেরত আসার দগদগে ক্ষতটা তাপসদারই বেশি।
খবর পাই, বাপ্পি আপার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছেন, এখানেই সর্বোচ্চ কেয়ার নিতে। দলীয় সাধারন সম্পাদক জানেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
নববর্ষের রাতে, বাপ্পি আপার স্বামী রফিক ভাইই জানালেন, ২ জানুয়ারি বিকেলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে বাপ্পি আপা দিল্লি যাচ্ছে।
আরে বাহ্! আমাদের বন্ধুটা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে যাচ্ছে, তাতে কি? ওর প্রিয় জামদানি, ম্যাচিং ব্যাগ-জুতা, ম্যাক-এর প্রসাধনী সব ঠিকঠাক গুছিয়ে দিচ্ছে তো কেউ? তা না হলে, বাপ্পি কথা বলতে শুরু করেই বলবে- ‘আমারে এমন ফকিন্নিদের মত পাঠায় দিলা তোমরা’? মনে মনে হাসি। এমন একটা প্রাণোচ্ছ্বল, পরিশ্রমী, সাহসি, ঝাল ঝাল মিষ্টি মানুষ কেন যে অসুস্থ হয়!
সকালে হাসপাতালের বারান্দায়, বাপ্পি আপার দ্বিধাগ্রস্থ স্বামীকে ঘিরে কান্না, জটলা। রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের কেউ একজন নিশ্চিত জানালেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাপ্পির শংকটাপন্ন অবস্থার খবর নাকি পৌছানোই যায়নি। পার্টি সেক্রেটারিকেও গত চার দিন নাকি ফোনে পায়নি বাপ্পির পরিবার বন্ধুরা।
লাশের জন্য শত লোক, শত মুখ। শত মুখে কত কথা। সাম্প্রতিক কমিটিতে কত লিপস্টিক পার্টি, ক্লাব ফ্রেন্ড, গ্লাস ফ্রেন্ডরা জায়গা পেলো, অথচ বাপ্পীর মতো একরোখা দল পাগলিকে একনলেজ করা হলো না, আক্ষেপ ঝড়লো কারো কারো মুখে।
এসব নিয়ে নাকি বাপ্পির অভিমান ছিলো।
ছিলো কি? “যেখানে অভিমানের “মান” থাকে, সেখানেই তো অভিমান, কি বলো বাপ্পি আপা”! কড়িডোরে লাশের ট্রলিতে ম্যাচিংহীন চাদর, বালিশে মোড়া একটু আগেই লাশ হওয়া বাপ্পী আপার দিকে তাকিয়ে সাপোর্ট নেওয়ার চেষ্টা করলাম।
রাজনীতি, পরিবার, বন্ধু স্বজনদের আহা উহুতে নানান তথ্য। আক্ষেপ। রাজনীতিটাকে সন্তান হিসেবে বুকে নেয়া এই রাজপথের বারুদের ভেতরের মায়া- ছায়া, আতিথেয়তা আর সেবার ছোঁয়া যারা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে আমাদের অনেকেরই সেই গভীরতা বোঝার বোধ নেই। তাই ফেসবুকে বাপ্পির জন্যে “যথেষ্ট ” একটা RIP লিখে ফিরে যাই আনন্দের বাজারে। ভীড়ের কেউ একজন বলেন, দোয়া করো… দোয়া করো।
আরে ভাই- প্রিয়জনকে বাঁচানোর জন্য লড়াই, চেষ্টা না করে সহজ দোয়ার দোহাই বাপ্পির লাশের ওপর দিও না, এমন কঠিন ঝাড়ি ভীড়ের মধ্যে উচ্চারণ করতেই, ঘড়ঘড় শব্দে এগুলো ট্রলি। বাপ্পি লাশটা গাড়িতে উঠছে…। কে গাইছে, আজ যানে কে জিদ্ না করো…।
মুন্নি সাহা: প্রধান নির্বাহী সম্পাদক, এটিএন নিউজ।