Friday 01 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমেরিকা কেন সোলায়মানিকে হত্যা করল, এর পরিণতি কি?


৪ জানুয়ারি ২০২০ ১৬:৩৯

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কুদস ব্রিগেডের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করেছে আমেরিকা। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ভোররাতে বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে তার গাড়ির ওপরে মার্কিন বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে রকেট হামলা চালায়। এ ঘটনায় সারাবিশ্বে তোলপাড় চলছে। বিশ্বের বহু মানুষ যেমন শোকে বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন, তেমনি তারা বিস্মিত।

জেনারেল সোলায়মানি মূলত সারাজীবনই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। বিশেষ করে ২০১১ সালে যখন সিরিয়ায় উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে আমেরিকা, ইসরাইল এবং তাদের পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক মিত্ররা লেলিয়ে দিয়েছিল তখন যার নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিরোধ ফ্রন্ট গড়ে তোলা হয়েছিল তিনি জেনারেল কাসেম সোলায়মানি। তিনিই ছিলেন সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের সম্মুখভাগে। তিনি ইরাক এবং সিরিয়াতে উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএস’র বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন।

বিজ্ঞাপন

আমেরিকা শুরু থেকেই দাবি করে আসছে তারা আইএস’র বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই জায়গা থেকে আবারও প্রশ্ন উঠছে- আমেরিকা যদি আইএস’র বিরুদ্ধে লড়াই করে তাহলে কেন সেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সম্মুখভাগে থেকে লড়াই করা জেনারেল সোলায়মানিকে আমেরিকা হত্যা করল? অনেকে প্রশ্ন করছেন- কেন আমেরিকা এই সময় জেনারেল কাসেম সোলায়মানির মতো একজন আন্তর্জাতিক সমর কুশলবিদ ও সেনানায়ককে হত্যা করল? এর পাশাপাশি সবার মনে একই প্রশ্ন এই হত্যাকাণ্ডের পরিণতি কি? এর পরিণতিতে কি আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হতে পারে?

বিজ্ঞাপন

দীর্ঘদিন আমি ইরানে থেকেছি এবং ইরান-আমেরিকা সম্পর্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণ করেছি। সে অভিজ্ঞতার আলোকে এই নিবন্ধে বিষয়টি আমি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনার চেষ্টা করব। এখানে শুধু এইটুকু বলে রাখি- এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে ইরান এবং আমেরিকার মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের আশঙ্কা নাকচ করা যাচ্ছে না।

মূল আলোচনায় যাবার আগে জেনারেল কাসেম সোলায়মানি সম্পর্কে শুধু এতটুকুই বলতে চাই যে, তিনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা, ইসরাইল এবং তাদের বিশাল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে প্রচণ্ড রকমের একটি বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। বিরাট একটি শক্তির পক্ষ থেকে ইরাক, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লেলিয়ে দিয়ে এবং যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যে কূটকৌশল বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিল সেই পরিকল্পনা এক কথায় নস্যাৎ করে দিয়েছেন জেনারেল কাসেম সোলায়মানি।

ইরানের এই জেনারেলের কারণে আমেরিকা, ইসরাইল এবং তার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যে বহু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছিল না। ফলে জেনারেল কাসেম সোলায়মানি আমেরিকা, ইসরাইল এবং তাদের পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক মিত্রদের মাথাব্যথার অনেক বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পক্ষান্তরে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বের মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন কাসেম সোলায়মানি। এ কথার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তার মৃত্যুতে সাধারণ মানুষের শোক এবং সমবেদনা প্রকাশ থেকে।

এবার আসি কেন জেনারেল সোলায়মানিকে হত্যা করা হলো সে আলোচনায়। জেনারেল সোলায়মানিকে হত্যার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ কতগুলো বিষয় আছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই মুহূর্তে ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে এরইমধ্যে তিনি ইমপিচ্ড হয়েছেন। ইমপিচমেন্ট নিয়ে খুব শিগগিরই মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটেও ভোটাভুটি হবে। সিনেটে যদি ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব পাস হয় তাহলে তিনি সম্ভবত চূড়ান্তভাবে ক্ষমতা হারাবেন। আর যদি প্রস্তাবটি পাস না হয় তাহলেও এটি তার জন্য বিব্রতকর একটা ব্যাপার।

যখন ট্রাম্পকে ইমপিচ করার জন্য মার্কিন রাজনীতিবিদরা জোট বদ্ধ হচ্ছেন এবং আলাপ আলোচনা করছেন ঠিক তখন কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করে ট্রাম্প আশা করছেন সেই আলাপ-আলোচনা এবং মার্কিন রাজনীতিবিদদের ইমপিচমেন্টকেন্দ্রিক ঐক্য নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হবেন। কাসেম সোলায়মানির হত্যাকাণ্ডের ফলে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করার জন্য দেশটির রাজনীতিবিদরা এখন ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া বাদ রেখে বরং তারই পেছনে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হবেন। আমার মনে হয়- ট্রাম্পের যারা পরামর্শক ও বুদ্ধিদাতা তারা তাকে এই ‘ইতিবাচক’ পরিকল্পনার কথা শুনিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, মার্কিন নির্বাচন সামনে। চলতি ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান দল থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং পুনর্নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী। শুধু তাই নয় তিনি সম্ভাব্য ইমপিচমেন্টের মুখে রয়েছেন। এছাড়া যে সমস্ত পররাষ্ট্রনীতি তিনি গ্রহণ করেছেন তাতে আমেরিকার জন্য তেমন কোনো সফলতা নেই। পাশাপাশি চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধও আমেরিকাকে খুব সুবিধাজনক অবস্থানে রাখেনি। আমেরিকাকে বিশ্বে আবার তিনি সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ অবস্থানে নেবেন বলে যে ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন সেই কাজও ট্রাম্প করতে পারেননি। ফলে তার জনপ্রিয়তার পারদ নিম্নগামী। এ অবস্থায় কোনো বড় ঘটনা ঘটানো তার জন্য বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। ভোটের রাজনীতিতে এ ধরনের সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের খেলা মোটেই নতুন নয়।

মার্কিন রাজনীতিবিদরা গত চার দশক ধরে ইরান এবং তার সামরিক বাহিনীকে মার্কিন জনগণের কাছে এক নম্বর শত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে ইরানের কাসেম সোলায়মানির মতো একজন জেনারেলকে হত্যা করা সেদেশের অনেক মানুষের কাছেই হয়তো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য ‘ক্রেডিট’। এ ধরনের নোংরা ও নিকৃষ্ট কাজ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট অনেক সময় জনপ্রিয়তার ধারাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে আনেন। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত সেই কাজটিই করলেন।

তৃতীয়ত, ইহুদিবাদী ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও সংকটাপন্ন। সেখানে গত বছরের এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর মাসে দুই দফা সংসদ নির্বাচন হয়েছে কিন্তু দুবারই বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জট বা দল সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিপরীতজোটেরও একই অবস্থা। সেখানে আগামী মার্চ মাসে তৃতীয় দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে আলাদা রকমের কিছু ঘটনা ঘটাতে পারলে নেতানিয়াহুর জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। এখানে লক্ষণীয় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু দুজনই নিজ নিজ দেশে নতুন করে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে সন্দিহান। দুজনই সংকটের মধ্যে। এই অবস্থায় তাদের জন্য আলাদা এমন কিছু ঘটনা দরকার যার জন্য তারা কৃতিত্ব হিসেবে দেখাতে পাবেন। মানুষ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ সংগঠন করেও এসব দেশের নেতারা জনপ্রিয়তার পারদ ঊর্ধ্বমুখী করার চেষ্টা করেন। এ কাজটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর জন্য ফলদায়ক হতে পারে বলে তারা বিবেচনা করে থাকতে পারেন। কারণ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা এবং ইসরাইলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে নিঃসন্দেহে জেনারেল কাসেম সোলায়মানি একটি বড় বাধা ছিলেন। সেই বাধা দূর করা ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহুর জন্য ‘কৃতিত্বই বটে’।

আমেরিকার দীর্ঘদিনের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে একথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয় যে, তারা পেশীশক্তিকে যতটা গুরুত্ব দেয় ততটা গুরুত্ব দেয় না কূটনীতিকে। অর্থাৎ আমেরিকা আন্তর্জাতিক যেকোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে পেশীশক্তি এবং সমরশক্তির ওপরই নির্ভর করে বেশি। আজকাল এই পেশীশক্তির একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। তারা যখন শত্রুদেশকে কূটনৈতিক কিংবা সামরিক দিক দিয়ে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় তখন তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়। ইরান আমেরিকার এই নিষেধাজ্ঞাকে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদ বলে অভিহিত করছে। যাই হোক, দীর্ঘ চার দশক ধরে আমেরিকা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় রেখে সারাবিশ্বে ইরানকে কোণঠাসা করে ফেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইরান তার কূটনৈতিক সততা ও দক্ষতা দিয়ে ধীরে ধীরে সংকট কাটিয়ে উঠেছে বরং এখন আমেরিকাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এ কারণেই পরমাণু চুক্তি থেকে আমেরিকা সরে গেলেও তারই ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপের দেশগুলো কিন্তু ইরানের সঙ্গে চুক্তি থেকে সরে যায়নি। পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুই দেশ ইরানকে গত দুই দশক ধরে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে এবং এ দুটি দেশ এখন ইরানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মিত্র। রাশিয়া এবং চীন ইরানের যেমন অর্থনীতিক মিত্র, তেমনি রাজনৈতিক মিত্র। সামরিক দিক দিয়ে তার চেয়েও সম্ভবত বড় মিত্র হতে চলেছে। কারণ আগামী অক্টোবরে ইরানের ওপর থেকে জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। তখন ইরান অস্ত্র রফতানি করতেও সক্ষম হবে আবার যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে রাশিয়া এবং চীনের কাছ থেকে তার সুবিধা মতো অস্ত্র কিনতে পারবে।

একথা নিশ্চিত যে, আগামী অক্টোবরে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আমেরিকা বাড়ানোর চেষ্টা করলেও রাশিয়া এবং চীন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন দেবে না। ফলে মার্কিন রাজনীতিবিদরা বিশেষ করে পর্দার আড়ালে যারা কলকাঠি নাড়েন তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। না তারা ইরানকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বিপর্যস্ত করতে পারছে, না তারা কূটনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে পেরেছে। এ অবস্থায় ইরানের একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনানায়ককে হত্যা করার মধ্যদিয়ে ইরান অস্থিতিশীল অবস্থায় ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেছে আমেরিকা। এর ধারাবাহিকতায় যদি আমেরিকার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ইরান তাহলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের আরও একটা মওকা পেয়ে যাবে আমেরিকা। এই চিন্তা থেকে আমেরিকা ইরানকে যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে জেনারেল সোলায়মানিকে হত্যা করে থাকতে পারে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ইরানকে অভ্যন্তরীণভাবে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করেছে আমেরিকা। এটি তার নতুন কোনো নীতি নয়। দফায় দফায় তারা নানা ইস্যুতে অর্থ দিয়ে, তাদের গুপ্তচর পাঠিয়ে, এমনকি অস্ত্র দিয়ে ইরানের ভেতরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। কিন্তু যতবার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই ইরান তা বেশ সফলতার সাথে মোকাবিলা করেছে। গত মাসে এমন একটি প্রচেষ্টা দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য যেমন ইরানের নিরাপত্তাবাহিনী ভূমিকা রেখেছে তেমনি শান্তিকামী সাধারণ মানুষও ভূমিকা রেখেছেন। অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে আমরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে দেখেছি। ফলে অভ্যন্তরীণভাবে ইরানকে অস্থিতিশীল করার মার্কিন প্রচেষ্টা ও বারবার ব্যর্থ হয়েছে। সেক্ষেত্রে জেনারেল সোলায়মানিকে হত্যার মধ্যদিয়ে আমেরিকা ইরানি জনগণের কাছে এই বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে যে- ইরান, সেখানকার জনগণ, সেনাবাহিনী কেউই আমেরিকার সামরিক শক্তির কাছে নিরাপদ নয়। ইরানি সামরিক বাহিনী ও জনগণের ভেতরে এক ধরনের ভীতি ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে আমেরিকা।

এর পাশাপাশি সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেন ইস্যুতে ইরানি কৌশলের কাছে আমেরিকা দারুণভাবে আটকে গেছে। এসব দেশে মার্কিন কৌশল বারবার যেমন মার খেয়েছে, তেমনি ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, ফিলিস্তিন প্রতিটি দেশে মার্কিন ও ইসরাইল-বিরোধী শক্তিশালী প্রতিরোধ সংগঠন গড়ে উঠেছে। এসব দেশের সাধারণ মানুষও দিনদিন প্রচণ্ডভাবে মার্কিনবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। আমেরিকা, ইসরাইল ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের মিলে ‘নিউ মিডলইস্ট প্ল্যান’ বাস্তবায়নের চেষ্টা করে আসছে তা ব্যর্থ করে দিতে ইরান এবং এই প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলো খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার এই অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য জেনারেল সোলায়মানির মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিত্বকে হত্যা করা আমেরিকা ও ইসরাইলের জন্য বড় ধরনের ‘অর্জন’ বলে গণ্য করা হতে পারে।

সম্প্রতি সৌদি আরবের আরামকো তেল স্থাপনায় যে হামলা হয়েছে তা সম্মিলিতভাবে ঠেকাতে পারেনি আমেরিকা এবং সৌদি আরব। ওই হামলার দায়িত্ব ইয়েমেনের হুতিরা স্বীকার করলেও সৌদি আরব এবং আমেরিকা বলেছে- ইরান এই হামলা চালিয়েছে। আর হুতিরা দাবি করেছে তারা ড্রোন হামলা চালিয়ে আরামকোকে বিধ্বস্ত করেছে। এখন ইয়েমেনের হুতিরা ড্রোন হামলা চালিয়ে থাকুক অথবা ইরান ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাক- যাই ঘটুক না কেন আমেরিকা এবং সৌদি আরবের সামরিক বাহিনী এবং তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যে ওই হামলা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে সেটি কিন্তু পরিষ্কার।

সৌদি আরবের হাতে যত সামরিক সরঞ্জাম এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তার বেশিরভাগই আমেরিকার তৈরি। তার অর্থ দাঁড়ায় ইরান অথবা হুতিদের হামলা মোকাবিলা করতে মার্কিন প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্ষম নয়। এতে সারাবিশ্বে আমেরিকার রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই যে দুরবস্থা তা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমেরিকার একটি পয়েন্ট দরকার। ইরাকে জেনারেল কাসেম সোলায়মানির ওপরে হামলা চালিয়ে আমেরিকা সেই পয়েন্ট অর্জনের চেষ্টা করেছে। তবে মনে রাখতে হবে ইরানের আকাশ থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে জেনারেল সোলায়মানির ওপরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো আর ইরানের ভেতরে মার্কিন হামলা চালানো এক কথা নয়।

এবার এই হত্যাকাণ্ডের পরিণতি কী হতে পারে সেদিকে একটু আলোকপাত করি। জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে হত্যার পর সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে ইরান-আমেরিকা যুদ্ধ। এ ধরনের যুদ্ধের কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না এই কারণে যে, জেনারেল সোলায়মানি যেহেতু ইরানের স্বীকৃত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সামরিক বাহিনীর একজন কমান্ডার এবং তিনি যেহেতু ইরান সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অ্যাসাইনমেন্টে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করছিলেন সেহেতু তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চ পর্যায়ের একজন ব্যক্তিত্ব তাতে সন্দেহ থাকার কারণ নেই। এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করার অর্থ হচ্ছে ইরানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং তার পুরো সামরিক বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করা। যখন ইরানের সামরিক বাহিনী বা তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে তখন ইরানকে যুদ্ধের পথে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। ফলে আমেরিকার সঙ্গে ইরানের সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা একটা আছে।

তবে একথা ঠিক- ইরানের নেতারা হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। তারা অত্যন্ত বুঝেশুনে পা ফেলবেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অনেক কাজ এখনো বাকি। সিরিয়ার গোলযোগ শেষ হয়নি, সিরিয়ার পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়নি, সিরিয়ায় জবরদখল করে মার্কিন সেনারা ঘাঁটি গেঁড়ে রয়েছে, সিরিয়ার তেল ক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ মার্কিনিদের হাতে। এগুলোর একটা বিহিত করার প্রশ্ন কিন্তু ইরানের সামনে রয়েছে। পাশাপাশি ইরাক এখনো অস্থিতিশীল। যদিও সেখানে সন্ত্রাসীরা আপাতত পরাজিত হয়েছে কিন্তু আমেরিকা এবং ইসরাইলের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। মাঝেমধ্যেই তারা ইরাককে অস্থিতিশীল করে তুলছে। ফলে সেখানে অনেক কাজ বাকি।

সিরিয়া এবং ইরাকে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই অপরিহার্য। এসব দেশে যত দ্রুত অস্থিতিশীলতা দূর করা যাবে ততো দ্রুতই পুরো মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা হবে এবং ইরান অন্য কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে। ইয়েমেন সংকট সমাধানের দিকে নিতে হবে প্রধানত ইরানকেই। সৌদি আরব, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সম্মিলিত ও সর্বাত্মক অবরোধের কবলে পড়ে রয়েছে কাতার। দেশটির পাশে তাৎক্ষণিকভাবে এসে দাঁড়িয়েছে ইরান এবং তুরস্ক। এই কাতারকেও সঙ্গে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন রয়েছে ইরানের জন্য। পাশাপাশি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে সেখানে পুনর্গঠনের প্রশ্ন আছে। সেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার কাজ রয়েছে। এ নিয়ে ইরানের হাতে বহু প্রকল্প। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দরকার ইরানের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি।

এই মুহূর্তে যদি আমেরিকার সঙ্গে ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে এই বৃহৎ কর্মকাণ্ড বাধার মুখে পড়বে। সেক্ষেত্রে ইরান হয়তো এখনই যুদ্ধের পথ বেছে নাও নিতে পারে। কিন্তু আমার আশঙ্কা- আমেরিকা আরও কিছু কাজ করবে যার প্রেক্ষাপটে ইরান হয়ত একটা পর্যায়ে গিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এরইমধ্যে ঘোষণা করেছেন যে, আমেরিকার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিশোধ নেয়া হবে। ফলে ইরান যদি কঠোর প্রতিশোধ নিতে চায় তাহলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠার কথা বলতেই হবে।

তবে, যুদ্ধে না গিয়েও বিকল্প পথ বেছে নিতে পারে ইরান এবং এই সম্ভাবনাই বেশি। সেই বিকল্প পথ হতে পারে এমন যে, পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে মার্কিন সেনাদের জন্য মারাত্মকভাবে অনিরাপদ করে তোলা। ইরানের প্রতি অনুগত মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি প্রতিরোধকামী সংগঠনের সঙ্গে জেনারেল কাসেম সোলায়মানির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্ক মূলত ইরানেরই সম্পর্ক। জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করার কারণে বিভিন্ন সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারে। ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মার্কিন সেনাঘাঁটিতে বোমা হামলা হয়েছিল। সেই হামলায় আমেরিকার ২৪১ জন এবং ফ্রান্সের ৫৮ জন সেনা নিহত হয়। শুধু লেবাননে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন সেনারা এ ধরনের হামলার শিকার হয়েছে।

জেনারেল কাসেম সোলায়মানির হত্যার পর প্রচলিত যুদ্ধের পথ অনুসরণ না করে ইরান এবং তাদের প্রতি অনুগত সংগঠনগুলো অপ্রচলিত যুদ্ধের পথও বেছে নিতে পার। অবশ্যই একথা ঠিক যে, জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করে যে পথ দেখিয়ে দিয়েছে আমেরিকা, ইরান সে পথে হাঁটবে এবং সে পথ অবশ্যই হবে প্রতিরোধ এবং প্রতিশোধের পথ।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইরানি জেনারেলের পাশাপাশি নিহত হয়েছেন ইরাকের জনপ্রিয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিট বা হাশ্দ আশ-শাবির সেকেন্ড ইন কমান্ড আবু মাহদি আল মুহান্দিস। তার সংগঠন ইরাক সরকারের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ। তাদের দলের অনেকেই সংসদ সদস্য। এছাড়া, ইরাকে আইএস বা দায়েশ নামক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ হয়েছে তাতে এই পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিট সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ফলে আবু মাহদি আল-মুহান্দিস এবং তার সংগঠন ইরাকের জনসাধারণ বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। ফলে তার এই হত্যাকাণ্ড ইরাকের জনগণের মেনে নেয়ার কোনো কারণ নেই, মেনে নেবে না পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটও। তারাও এর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে। এরইমধ্যে ইরাক সরকার বলেছে, কাসেম সোলায়মানি এবং আবু মাহদি আল-মুহান্দিসের ওপর হামলা চালিয়ে আমেরিকা তাদের সেনাদের ইরাকে থাকার চুক্তি ভঙ্গ করেছে।

ইরাকের অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা মুক্তাদা আল-সাদর। তিনি তার শিয়া মিলিশিয়াদেরকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এই অবস্থায় এমন ধারণা করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে যে, ইরাকে মার্কিন দূতাবাসে আবার হামলা হতে পারে এবং ১৯৭৯ সালে ইরান থেকে যেভাবে দূতাবাস গুটিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল মার্কিন সরকার, ইরাক থেকেও সম্ভবত তারা সেই কাজ করতে বাধ্য হবে।

ইরাকের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমেরিকা যা করেছে তাতে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। লেবাননের হিজবুল্লাহ প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। একই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে ইয়েমেনের হুতি আনসারুল্লাহ আন্দোলন। ফিলিস্তিনের হামাস এবং ইসলামি জিহাদ আন্দোলন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। হামাস জানিয়েছে, তাদেরকে আজকের এই শক্তিশালী অবস্থানে আনার পেছনে জেনারেল কাসেম সোলায়মানি বিরাট বড় অবদান রেখেছেন। ফলে সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা আজকের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি খারাপ অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে- একথা বলা যেতেই পারে। দিন দিন যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠবে। সেই প্রতিরোধের সামনে সম্ভবত আমেরিকা টিকতে পারবে না।

এই আলোচনার সর্বশেষ পর্যায়ে যে কথাটি বলতে হয় তা হচ্ছে এই যে, মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে হত্যার পর ইরান এবং আমেরিকার চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে যদি যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে তার সর্বব্যাপী প্রভাব ঠেকাতে পারবে না আমেরিকা। পুরো মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকার জন্য বারুদের কুণ্ডলীতে পরিণত হবে। পাশাপাশি পারস্য উপসাগরে সব ধরনের জাহাজ চলাচল অনেক বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠবে। এমনকি পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালিতে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে সারাবিশ্বে বিশেষ করে তেলের বাজারে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং তেলের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এ মুহূর্তে ধারণা করাও কঠিন। ফলে সারাবিশ্বে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবে তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাল দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। ফলে আমি মনে করি, আমেরিকার পক্ষ থেকে এই সংকট বাড়ানো আর মোটেই ঠিক হবে না। জেনারেল সোলায়মানিকে হত্যার ভেতর দিয়ে তারা যে অন্যায় করেছে তার খেসারত আমেরিকাকে দিতে হবে। সেই খেসারত কিভাবে কমানো যায় সেদিকেই বরং আমেরিকার মনোনিবেশ করা উচিত।

লেখক রেডিও তেহরানের সাংবাদিক

ইরান কাসেম সোলায়মানি যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ পরিস্থিতি সিরাজুল ইসলাম

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

আরো

সম্পর্কিত খবর