তুই ধর্ষক, লজ্জা তোর! মেয়ে তুমি এগিয়ে যাও…
৮ জানুয়ারি ২০২০ ১৫:৫৩
ভিক্টিমের পয়েন্ট থেকে বিবেচনা করলে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধ ধর্ষণ। এমনকি আমার কাছে মনে হয়, হত্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর। মানবজীবন সবচেয়ে মূল্যবান। কারণ কোনোকিছুর বিনিময়েই জীবন ফিরে পাওয়া যায় না। তাই হত্যাই সবচেয়ে বড় অপরাধ। কিন্তু খুন হযে যাওয়ার পর ভিকটিমের পরিবার, বন্ধু, স্বজনদের কষ্ট হবে; কিন্তু ভিকটিমের তো আর কিছু যাবে-আসবে না। সে তো কিছু জানতেই পারবে না। তবে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ঘটে উল্টো ঘটনা। যতদিন বাঁচবেন, তাকে দিন কাটাতে হবে ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন আর দীর্ঘ মানসিক ট্রমা নিয়ে। আমি আপনি যতই বলি, যতই সান্ত্বনা দেই, যতই বিচার হোক; ধর্ষিতার মন থেকে অপমানের, অমর্যাদার গ্লানি, বেদনা কখনোই মুছে যাবে না, যায় না।
একজন মানুষকে ধ্বংস করার সবচেয়ে সহজ অস্ত্র ধর্ষণ।
ধর্ষণের পর যাদের মেরে ফেলা হয়, তারা আসলেই বেঁচে যান। কিন্তু যারা ধর্ষিত হওয়ার পর বেঁচে যান, তারা আসলে জীবনভর বারবার মরেন। সড়ক দুর্ঘটনায় একটা পা হারিয়ে গেলেও মানুষ সে কষ্ট ভুলে যেতে পারে। কিন্তু ধর্ষণের গ্লানি, ধর্ষণের বেদনা তাকে বয়ে বেড়াতে হয় জীবনভর। ধর্ষণে বেঁচে যাওয়ার পর তাকে প্রতিদিন মানসিকভাবে ধর্ষিত হতে হয়। এই ভয়ে অনেকেই ধর্ষণের খবরটি চেপে যান। নিজে নিজেই দগ্ধ হন গ্লানিতে। সইতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেন। ধর্ষককে আদালত পর্যন্ত নিতে ভিকটিমের দুরন্ত সাহস আর দৃঢ় মনোবল থাকতে হয়। লাগে পরিবারের ও চারপাশের সহায়তা। কিন্তু অনেকের মনোবল ততটা দৃঢ় থাকে না। ধর্ষণই যে কারো মনোবল শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট। আর পরিবার এবং চারপাশের সহায়তা তো পানইনি, ঘটে উল্টো ঘটনা।
তারপরও যারা সাহস করে বিচার চাইতে যায়, তাদের আসল গ্লানিটা শুরু হয় তখন। প্রথমে হাসপাতালে ধর্ষণের প্রমাণ দিতে হয়, তারপর পুলিশের কাছে ধর্ষণের খুটিনাটি বিবরণ দিতে হয়। অভিযোগ যদি আদালত পর্যন্ত যায়, তাহলে প্রকাশ্য আদালতে আইনজীবীর অশ্লীল জিজ্ঞাসাবাদে বারবার ধর্ষিত হতে হয়। এই দীর্ঘ দুর্ভোগ সইবার মতো মানসিক শক্তি সবার থাকে না। আমাদের আইনটাই এমন ধর্ষকের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। চেষ্টা করা হয় ধর্ষিতাকে নষ্টা, চরিত্রহীনা প্রমাণের। আর এটা প্রমাণ করতে পারলেই যেন জায়েজ হয়ে যায় ধর্ষণ। কিন্তু মেয়েটি যৌনকর্মী হলেও, এমনকি আপনার বিয়ে করা স্ত্রী হলেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা যাবে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে কোনও সম্পর্ক অপরাধ। কিন্তু আমাদের দেশে যে ধর্ষণ করে, তার পক্ষে হাজার যুক্তি-বয়সের দোষ, পোলাপান একটু-আধটু এমন করেই, মেয়েটা কেন অত রাতে অমন পোষাকে বাইরে এলো, মেয়েটা কেন হেসে কথা বললো, মেয়েটা কেন ফিরে তাকালো? এসব কথা উঠতে থাকে।
খলের কখনও ছলের অভাব হয় না। নেকড়ে ভেড়াটাকে খাবে। ব্যস, এর জন্য যুক্তির অভাব হবে না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী
কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হলো, তাকে নিয়েও বলা হচ্ছে, সে কেন হল থেকে বান্ধবীর বাসায় গেল, কেন ভুল করে আগের স্টেশনে নেমে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই সমাজে ধর্ষকরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর ধর্ষিতার জন্য এই পৃথিবীটা হয়ে যায় নরকসময়। অবিবাহিত হলে তার আর বিয়ে হবে না। বিবাহিত হলে সংসার ভেঙে যাবে। এই মেয়েগুলোকে একটু সুরক্ষা দেওয়ার আশায় আমরা তাদের নাম প্রকাশ করি না, ছবি দেখাই না। কিন্তু তাতে কাজ হয় সামান্যই। এলাকার সবাই চিনে ফেলে তাকে। মেয়েটি হেঁটে গেলে হাজার পুরুষের চোখ তাকে বারবার ধর্ষণ করে। নিজেরা নিজেরা মেয়েটিকে দেখিয়ে দেখিয়ে রসালো আলাপ করে। দেশে এমন হাজার ধর্ষিতার এই দুর্বিষহ জীবনের কতটুকু খবর আমরা রাখি? কিন্তু ধর্ষিতাকে দেখে দেখে আনন্দ নেয় যে পুরুষ, সে কি ভাবে না, তার বোন বা কন্যাও একদিন এই পরিস্থিতিতে পড়তে পারে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যাটা দ্বিগুন। ধর্ষণের ব্যাপারে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটা না বদলালে এই সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। একটা বিষয় পরিস্কার করতে হবে, ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষিতার কোনো দায় নেই, দোষ নেই। যে কোনো এই ঘটনায় অপরাধ শুধু ধর্ষকের। কিন্তু গ্রামে দেখেছি দুজনকে দেখেই লোকজন হাসে। ধর্ষিতাকে দেখে হাসে অশ্লীল হাসি, আর ধর্ষককে দেখে হাসে প্রশ্রয়ের হাসি। গ্রামে সবচেয়ে ঘৃণার কাজ হলো গরু চুরি করা। আর ধর্ষণ যেন কোনো অপরাধই নয়। আহারে পোলাপান মানুষ করে ফেলেছে, বয়সের দোষ মিটমাট করে দাও, বিয়ে দিয়ে দাও। সারাদেশে যত ধর্ষণের ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়, তারচেয়ে অনেক বেশি ঘটনা আড়ালে থেকে যায়। অনেকেই সামাজিকতার ভয়ে, লজ্জায় চুপ করে থাকেন। অনেক সময় অভিভাবকরা সন্তানের মুখ বন্ধ রাখেন। অনেক সময় সামাজিকভাবে মিটিয়ে ফেলেন। আর পরিবারের ভেতরে মামা, চাচা, খালু, কাজিন, প্রতিবেশীর দ্বারা যে কন্যা শিশু বা মেয়েরা কত ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়, তার কোনো ইয়ত্তা থাকে না। কেউ জানতেও পারে না। এমনকি কন্যাশিশুরা অনেকসময় ভয়ে কাউকে বলেও না। অনেক সময় বললে, তাকেই উল্টো ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়।
আমি এমন একটা দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন ধর্ষক ধর্ষিতাকে বিয়ে করার সুযোগ পাবে না। সে কারাগারে থাকবে, ফাসিঁর মঞ্চে যাবে, তার পরিবার লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না। কিন্তু ধর্ষিতাকে লজ্জায় মুখ লুকাতে হবে না। ধর্ষিতা তার স্বাভাবিক জীবন চালিয়ে যেতে পারে। ধর্ষিতার পড়াশোনা, সংসার, ক্যারিয়ার কোথাও যেন কোনো সমস্যা হবে না। সমাজে তিনি যেন সাহসী নারীর মর্যাদা পান। ধর্ষিতা যেন তার পরিচয় না লুকিয়ে জোর গলায় বলতে পারে, লজ্জা আমার নয়। আমি মাথা উচু করে রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটবো। তুই ধর্ষক, তুই অপরাধী, লজ্জা তোর।
আমি জানি তেমন দিন আসতে অনেক সময় লাগবে। তবুও আমাদের লড়াইটা চালাতে হবে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। বিএনপি আমলে ধর্ষণের শিকার পুর্ণিমা টেলিভিশন টক শো’তে এসে কথা বলেছেন। ধর্ষণের পর নিজের দুঃসহ জীবনের বর্ণনা দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, যারা ধর্ষণ করেছে লজ্জাটা তো তাদের, আমাদের লজ্জা হবে কেন? এই সাহস দেখিয়ে তাকেও অনেক কথা শুনতে হয়েছে। তবুও একদিন সামাজিক প্রতিরোধটা গড়তেই হবে। ধর্ষকদের ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে ধর্ষিতাকে তার অবস্থানে সুদৃঢ় রাখতে হবে। তার পাশে দাড়াতে হবে, সাহস দিয়ে বলতে হবে, মেয়ে তুমি ভয় পেও না, লজ্জা পেও না। দোষ তোমার নয়, দায় তোমার নয়। এটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র। একটি দুর্ঘটনা যেন তোমার জীবন থামিয়ে না দেয়। মেয়ে তুমি এগিয়ে যাও।
প্রভাষ আমিন: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ