একুশের শক্তিতে আমরা এগোই আমাদের পথে
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৩:১৩
একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারের দিকে তাকাতেই রক্তে ছলাৎ খেলে যায়। এই মিনারতো অন্য আট-দশ দিনের মতো না। কেমন জীবন্ত আর প্রাণবন্ত। মনে হচ্ছে শহীদ মিনার ঘিরে এই যে এত আয়োজন এত আবেগ এত ভালোবাসা সবকিছুই যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে মিনার হয়ে লুকিয়ে থাকা সকল ভাষা শহীদদের। যেন তারা সব দেখছেন। অনুভব করছেন কোটি বাঙালির, বাংলাভাষীর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। আর তাইতো একুশের রক্তলাল শহীদ মিনার যেন হয়ে ওঠে আমাদের অনুভূতির প্রতিবিম্ব।
একুশকে ঘিরে বাঙালির এই যে এত আবেগ এটা নতুন কিছু না। দিন যত যাচ্ছে এই আবেগ ততই শাণিত হচ্ছে। পরিণত হচ্ছে আমাদের যাপিত জীবনের অংশে। কারণ একুশ আমাদের অর্জন। একুশ আমাদের অহংকার। এই একুশ এখন সারা বিশ্বের অনুপ্রেরণা। বিশ্বজুড়ে একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
হবেই না বা কেন? সারা পৃথিবীতে ভাষা আছে প্রায় সাত হাজারের ওপরে। কিন্তু নিজের ভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছি শুধু আমরাই। জীবন দিয়েছি আমরাই। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘মায়ের ভাষা বাংলা চাই’ বলে ঘাতকের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছে সালাম, রফিক, শফিক, জব্বার, বরকতেরা। দুনিয়া জুড়ে এমন নজির আর একটিও নেই। এমন দুঃখের দিন যেমন আর কারও নেই তেমনি এমন অহংকারের দিনও পৃথিবীতে আর কারোরই নেই। এ শুধু আমাদের।
ফেব্রুয়ারির একুশ তাই আমাদের কাছে কোনও মামুলি সংখ্যা না। একুশে লেগে আছে রক্তের দাগ, একুশ ভরা প্রতিবাদী বারুদ, একুশ আমাদের কন্ঠস্বর। একুশ আমাদের অস্তিত্ব।
আমাদের জাতীয় জীবনে এমন রক্তাক্ত তারিখ আরও আছে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ ভাবনার সূচনা হয়েছিল বায়ান্নর একুশ থেকেই। একুশ আমাদের প্রথম রক্তাক্ত অর্জন। চেতনার দিনপঞ্জির প্রথম রক্তমাখা তারিখ। বায়ান্ন’র একুশ থেকেই আমরা পেয়েছি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস। একুশ চিনিয়েছে স্বাধিকারের সাধ্য। একুশ থেকেই এসেছে একাত্তর আর আজকের বাংলাদেশ। একুশ আমাদের মুক্তির ‘বীজ’।
পরম্পরায় মায়ের ভাষাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার যেমন আছে তেমনি ভাষারও মৃত্যু আছে। যখন কোনও ভাষা তার শেষ বক্তাকেও হারায় তখন একটি ভাষার মৃত্যু হয়। পৃথিবী থেকে এভাবে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য ভাষা। ইউনেস্কো জানাচ্ছে, প্রতি দুই সপ্তাহে অর্থাৎ মাত্র ১৪ দিনে পৃথিবীর বুক থেকে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে একেকটি সুদীর্ঘ অধ্যায়।
কিন্তু এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় পৃথিবীর বুক থেকে বাংলা কখনো হারাবে না। যতদিন এই পৃথিবী টিকে থাকবে ততদিন টিকে থাকবে বাংলা ভাষা। কারণ ওই পরম্পরা।
একুশের প্রভাত ফেরির দিকে তাকালেই বুকটা ভরে যায়। বুক ভরে যাওয়ার কারণ, কে নেই এই প্রভাত ফেরিতে? তরুণ-তরুণীরা যেমন আছে, তেমনি আছেন অশীতিপর বৃদ্ধও।
বৃদ্ধ বাবাকে হাতে ধরে তার সন্তান যেমন নিয়ে এসেছে শহীদ মিনারে। তেমনি বাবা-মায়ের কোলে কোলে এসেছে হাজারো শিশু। এই যে বাবা-মা তার সন্তানকে চেনাচ্ছেন আমাদের গর্বিত অতীত। শেখাচ্ছেন ইতিহাসকে টেনে নেবার পাঠ, এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমরা বুনে দিচ্ছি চেতনার বীজ। যে বীজে ফসল ফলতে বাধ্য।
কোনও কিছুকে নিজের বলে ধারণ করার, একান্ত নিজের বলে দাবি করার সবচেয়ে যথার্থ শব্দ হচ্ছে ‘আমার’। আমাদের চেতনা আর আবেগের দুই গান- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ এবং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। লক্ষ্য করুন, এই দুই গানের প্রথম শব্দই হচ্ছে ‘আমার’। গানের মতোই বাংলা ভাষা এবং মাতৃভূমি বাংলাদেশকে আমরা ধারণ করি একান্ত আমার হিসেবে। আর আমাদের প্রত্যেকের এই একান্ত ‘আমার’ সমষ্টিগতভাবে এক প্রচণ্ড ‘আমাদের’ তৈরি করে। এটাই আমাদের শক্তি। এই শক্তি দিয়েই আমরা এগিয়ে যাবো আমাদের পথে।
পলাশ মাহবুব : উপ-সম্পাদক, সারাবাংলা
ছবি : আশীষ সেনগুপ্ত ও জিমি আমির