স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতা, প্রয়োজন ‘ম্যান-মেশিন ম্যারেজ’
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৭:৩৪
সাম্প্রতিক সময়ে অ্যালগরিদম শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছে ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করছেন এমন প্রতিটি সংবাদকর্মীকেই। আরও একটি শব্দ ভীষণভাবে আমাদের কানের পাশে উচ্চারিত হচ্ছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টলিজেন্স। আর এই দুইয়ের সফল প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব করে তোলা হয়েছে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে খবর তৈরির কাজ। যা গেলো দুই-এক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে।
এই ‘স্বয়ংক্রিয় সংবাদ’ শব্দ দুটি যে গোটা বিশ্বের সাংবাদিকতা শিল্পকে বড় ধরনের একটি ঝাঁকুনি দিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে যখন জানা গেলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এরই মধ্যে এমন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির সফল ব্যবহার করে ফেলেছে। একবার কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারলে এই অ্যালগরিদম কোনও একটি বিশেষ বিষয়ের ওপর হাজার হাজার খবর নিজেই তৈরি করতে পারে। আর তা সম্ভব আরও দ্রুততায়, আরও সস্তায় এবং সর্বপোরি তাতে ভুলের মাত্রাও থাকে অপেক্ষাকৃত কম। একজন মানব সংবাদকর্মীর যা রীতিমতো এক সংগ্রাম, একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তা করে ফেলছে নিতান্তই অনায়াসে।
এই খবরে মানব সংবাদকর্মীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত হয়ে না পড়ার একটি কারণও বর্তমান নেই। কারণ এই স্বয়ংক্রিয় কনটেন্ট প্রডাকশন ব্যবস্থা বার্তাকক্ষে কাজের সুযোগ কমাবে। তবে একই সঙ্গে একটি বার্তাকক্ষের, তথা সংবাদচর্চাকারীর জন্য সুখকর খবর এই কারণে যে, প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের খবরের মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা যাচ্ছে।
এরই মধ্যে আমরা দেখছি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কোম্পানি এখন এমন স্বয়ংক্রিয় সংবাদ তৈরির সফটওয়্যার বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে। বিশ্বের প্রধান সারির সংবাদমাধ্যমগুলো, যেমন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, লস এঞ্জেলস টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, প্রোপাবলিকা এসব প্রতিষ্ঠান স্বয়ংক্রিয় খবর তৈরি করছে ও প্রকাশ করছে। ব্যাপকভাবে এখনই ছড়িয়ে না পড়লেও এটা বুঝাই যাচ্ছে- স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে খবর তৈরি ও তার প্রকাশ ও প্রচার দিন দিন বাড়বে এবং টিকেও থাকবে।
যেসব বিষয়ের ওপর নিয়মিত তথ্য-উপাত্ত তৈরি হয়, স্পষ্ট, সঠিক ও কাঠামোবদ্ধ ড্যাটা পাওয়া যায় সেগুলোর ওপর খবর তৈরিতে অতীতের মানব সংবাদকর্মীর ওপর নির্ভরতা আর থাকবে না, মেশিন জেনারেটেড কনটেন্ট বা অটোমেটেড কনটেন্টই সরাসরি প্রকাশ করতে পারবে যেকোনও মিডিয়া আউটলেট।
তবে যে সব ক্ষেত্রে এমন কাঠামোবদ্ধ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে না, সেসব ক্ষেত্রে এই স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতা কাজ করবে না। আবার ড্যাটার মান যদি প্রশ্নবিদ্ধ থাকে তাহলেও এই সাংবাদিকতা করা সম্ভব হবে না।
কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে অনেক কিছুতেই এখন কাঠামোবদ্ধ তথ্য-উপাত্ত থাকছে। এবং তার পরিমাণ ও পরিধি দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপরও বাড়ছে খরচ কমানোর চাপ। আর একইসঙ্গে খবরের মান বাড়ানোর পাশাপাশি খবরের সংখ্যা বাড়ানোর চাপও রয়েছে। ফলে এই স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতা যে অদূর ভবিষ্যতের কিংবা সময়ের বাস্তবতা তাতে সন্দেহমাত্র নেই।
বিশ্লেষকরা এরই মধ্যে এই স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতা যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন এবং এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। তাদের মতে, এই যে অ্যালগরিদমের ব্যবহার, এতে করে খবর তৈরি করা দ্রুততার সাথে যেমন করা সম্ভব তেমনি খবরের পরিধিও বাড়িয়ে দেওয়া যায়। মানব সাংবাদিকের তুলনায় এতে ভুলের মাত্রাও কম থাকবে।
তারা আরও বলছেন অ্যালগরিদমের ব্যবহারের মাধ্যমে একই তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে একই খবর অনেক ভাষায় তৈরি করা ও প্র্রকাশ করা সম্ভব। নানাবিধ অ্যাঙ্গেলে খবর তৈরি করা যায় আর সর্বোপরি এর মাধ্যমে কোনও পাঠক যে ধরনের কনটেন্টে আগ্রহী, তার ব্যক্তি পছন্দকে গুরুত্ব দিয়েও খবর তৈরি, প্রকাশ ও পাঠ করিয়ে নেওয়া যায়।
স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতাকে যথেষ্ট মিথষ্ক্রীয় হিসেবেও দেখাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পাঠক কোনও চাহিদা জানালে, কিংবা তাদের বিশেষ কোনও আগ্রহের দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে এই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি খুব দ্রুততার সঙ্গে সে ধরনের বার্তা বা খবর তাদের সামনে হাজির করতে পারবে।
সীমাবদ্ধতা যে কিছু নেই তা নয়। কারণ অ্যালগরিদমকে আসলে কেবল প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত আর অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে এর মাধ্যমে তৈরি খবর কখনো কখনো কখনো অপ্রত্যাশিত বা অস্বাভাবিক কিছু হয়ে সামনে ধরা দিতে পারে।
অ্যালগরিদম কোনও প্রশ্ন করতে পারে না, কোনও বিষয়ের পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারে না অথবা খবরের সম্ভাব্য সামাজিক প্রভাব পর্যবেক্ষণও এর মাধ্যমে সম্ভব নয়, যা একজন সংবাদকর্মীর দায়িত্ব। আর একথা বলাই বাহুল্য স্বয়ংক্রিয় সংবাদ কখনোই আপনাকে একটি মানসম্মত, সুলিখিত কনটেন্ট দিতে পারবে না।
তবে, দিন যত গড়াবে এই সীমাবদ্ধতাগুলোর কিছু কিছু যে স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতা কাটিয়ে উঠবে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। মানুষ হয়তো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে তৈরি সংবাদটি পড়ে খুব একটা মজা পাবে না, তবে এই কনটেন্ট যে তাদের কাছে নির্ভরযোগ্য খবর হয়ে উঠবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তথ্য বা উপাত্তই যেখানে খবরের মূল আধেয় সেখানে হয়তো এই স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতা হয়ে উঠবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পথ।
অনেক পাঠক এখন কেবল খবরটিই জানতে চায়। কে কীভাবে কোনও ভঙ্গিমায় লিখলো? লেখা কতটা মানসম্পন্ন হলো? তা নিয়ে অনেকেরই এখন আর মাথাব্যথা নেই। ফলে অনেক কোয়ালিটি কনটেন্ট (মানসম্পন্ন সংবাদ আধেয়) অপঠিত, কিংবা স্বল্প পঠিত হয়ে পড়ে থাকে। খবরের মূল অংশটুকুই জানতে চান, কিংবা খবরকে উপরিতল থেকেই শুধু দেখতে চান এমন পাঠকই এখন বেশি বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রমাণ করেছে। ফলে এমন পাঠকের জন্য এ ধরনের সাংবাদিকতা কিংবা এ ধরনের আধেয়ই হবে সবচেয়ে উপযোগী। তাছাড়া এখন খুব কম মানুষই খবর পড়ে, তারা কেবলই খবরটি জানে, তা হতে পারে শুধু খবরের শিরোনাম পড়ে, সর্বোচ্চ সংবাদসূচনাটুকু পাঠ করে, তাদের জন্যও স্বয়ংক্রিয় সংবাদই অধিক উপযোগী। আর সর্বোপরি সামাজিক মাধ্যমের যুগে, যেখানে নিউজফিড এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, সেখানে খবর আসলে ধীরে ধীরে স্রেফ দেখে নেওয়ার আধেয়তে রূপ নিয়েছে, পড়ার কনটেন্ট হিসেবে খবর এখন কমই বিবেচিত হয়, সে কারণেও স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতাকেই তাদের ভরসা বাড়বে।
এটি সত্য যতই ব্যবহার বাড়ুক কোনও সংবাদ মাধ্যমের পক্ষে এই সম্পূর্ণভাবে এই অ্যালগরিদমের ওপর নির্ভর হয়ে থাকা হয়তো কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ এতে ভুল-ভাল কিছু হলে তার জন্য কাউকে দায়ী করার থাকে না। বিশেষ করে যখন কোনও বিতর্কিত বিষয়ে এ ধরনের কনটেন্ট তৈরি করা হয় তখন কোনও ভুল কিছু ঘটে গেলে স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাও সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে অ্যালগরিদমটি ঠিক কিভাবে কাজ করছে তা পাঠকের কাছে তুলে ধরতে হবে। যেটি এখনো অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া এবং অধিকাংশ পাঠকের কাছে তা বোধগম্য নয়। সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি সংবাদ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়তো বাড়তি কাজ হয়ে উঠবে।
আর এই স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতার কিছু সামাজিক প্রভাবও ঘটতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তারা বলছেন এতে যেহেতু সংবাদের প্রবাহ বাড়বে, তাতে পাঠকের পক্ষে তাদের জন্য কোনটা উপযোগী, কোনটা নয়, তা বেছে নেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। এতে তারা বিরক্তও হয়ে পড়তে পারেন। আর সর্বোপরি গণতন্ত্রে সাংবাদিকতার যে একটা পর্যবেক্ষকের ভূমিকা রয়েছে, তা এই অ্যালগরিদমভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতা পূরণ করতে পারবে কি না, তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে গেছে।
তবে এ অবস্থায়, যে কোনও সংবাদকর্মীকে এখনই ভাবতে হবে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে। সে লক্ষ্যে বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞরা কিছু পরামর্শ সামনে আনছেন। তারা ব্যক্তি সাংবাদিককে এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা পরিচালনার কাজটাই দ্রুত শিখে নিতে বলছেন। একটি কথা তারা ব্যবহার করছেন, ম্যান-মেশিন ম্যারেজ… অর্থাৎ যন্ত্রের সাথেই বাঁধতে হবে গাঁটছড়া।
এর বাইরে যে কাজগুলো অ্যালগরিদমের পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না, কিংবা হয়তো কখনো সম্ভব হবে না, সেগুলো শিখে নিতে এবং তাতে দক্ষ হয়ে উঠতেও সাংবাদিকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যেমন, কোনও বিষয়ের গভীর বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, অনুসন্ধানভিত্তিক সাংবাদিকতা, খবরের ভেতরের খবর, ইত্যাদি। অর্থাৎ সামথিং আউট অব দ্য বক্স।
যারা গতানুগতিক সাংবাদিকতা করছেন, তাদের কাজ হয়তো স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতা খুব দ্রুতই কেড়ে নেবে। তবে এর মাধ্যমে নতুন কাজের সুযোগও সৃষ্টি হবে। কারণ খবর তৈরির অ্যালগরিদম তৈরিও কিন্তু একটি কাজ।
সারাবাংলা/এমএম