পার্বত্য চট্টগ্রাম – বিপন্ন জীবন, অসহায় রাষ্ট্র
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১২:৩৫
রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে দুই মারমা তরুণী ধর্ষণের ঘটনা আলোড়ন তুলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষিতাদের হাসপাতাল থেকে অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাখার মত ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষিতাদের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন স্বয়ং চাকমা সার্কেলের উপদেষ্টা রাণি ইয়েন ইয়েনসহ আরো কয়েকজন। অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে রাষ্ট্রীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। এর বিপরীতে বক্তব্য ও এসেছে যথারীতি। বিচার নয়, নিরাপত্তা মুখ্য দাবি করে মেয়ে দু’টিকে চাকমা সার্কেলের রাজার হেফাজতে রাখার আবেদন করেছিলেন বলে জানান চাকমা সার্কেলের রাজা দেবাশীষ রায়। কিন্তু তার আগেই মেয়ের পরিবার কাস্টডি দাবি করায় আদালত পরিবারের পক্ষে রায় দিয়েছেন৷ সবকিছুর পরে, এই ইস্যুতে মূলধারার গণমাধ্যমের নীরবতা সকলকে বিস্মিত করেছে।
আমরা কিছুদিন পর পর খবর পাই পাহাড় অস্থিতিশীল হচ্ছে, সেটেলার কর্তৃক উপজাতিদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আবার এই যে উপজাতি শব্দটা ব্যবহার করলাম, এটা নিয়েও আপত্তির শেষ নেই। আদিবাসী না উপজাতি না ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এই বিতর্ক প্রায়ই সামনে চলে আসে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষোভ নতুন নয় এবং কোন ক্ষোভই অমূলক নয়। পাহাড়িরা ‘৪৭ এ পাকিস্তান চান নি, রাঙ্গামাটিতে চাকমারা উড়িয়েছিল ভারতের আর বান্দরবানে মারমারা উড়িয়েছিল বার্মার পতাকা। ‘৬০ সালে পাকিস্তান এই পাহাড়ের মানুষদের বাস্তুচ্যুত করে কাপ্তাই পানিবিদ্যুত কেন্দ্রের মাধ্যমে। উন্নয়ন হয়ে দাঁড়ায় বিপর্যয়, ৫৪,০০০ একর জমি ডুবে যায়, এক লক্ষ চাকমা হন উদ্বাস্তু। সমস্যা হল, এই অন্যায়ের পরও একাত্তরে তারা আবার পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ান। অনেক উপজাতি তরুণ বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করলেও ত্রিদিব রায়, অউং শু প্রুর মত রাজারা দালালি করলেন পাকিস্তানের। এ জায়গায় একটা তথ্য দিয়ে রাখি,বর্তমান চাকমা সার্কেল এর রাজা দেবাশীষ রায়ের পিতাই এই ত্রিদিব রায়। পাকিস্তানের প্রতি তার আনুগত্যের পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার তাকে আজীবন মন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৮১ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি আর্জেন্টিনায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার ছিল, মার্ক্সবাদী লারমা ভাইয়েরা পক্ষ নিলেন পাকিস্তানের। এই দুইভাইয়ের বড়জন মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমা। কমিউনিস্ট ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে বেড়ে ওঠা এ নেতা ‘৭২ এ সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছে যান, চারদফা দাবি করেন যার প্রধানটি ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পৃথক আইনপরিষদ। যে এম এন লারমা কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের পক্ষালম্বন করেছিল, তার এহেন দাবি বঙ্গবন্ধু মানবেন না, এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যাখ্যাত হয়ে গড়ে তুললেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, যা পরিচিতি পায় শান্তিবাহিনী নামে। শান্তি নামটি এসেছে এম এন লারমার ছোটভাই শন্তু লারমার নাম থেকে, ইতিহাসের পরের বাঁকে যিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। এর মধ্যে ‘৭৩ এর ইলেকশন এ এম এন লারমা জিতে গেলেন, শান্তিবাহিনীতে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হল, সাহায্য প্রার্থণা করলেন ভারতের কাছে। কিন্তু ভারত সাহায্য তো করলোই না, বরং জানিয়ে দিল সরকারকে। বঙ্গবন্ধু এম এন লারমাকে ডাকলেন, পিঠ চাপড়ে বললেন, “তোরা বাঙ্গালি হইয়া যা।” লারমা সাহেব বাকশালে যোগদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলেন।
এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হল। আত্মগোপনে গেলেন এম এন লারমা। মেজর জিয়ার সাথে নভেম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন, ফলপ্রসূ হল না। ‘৭৬ এ সশস্ত্র যুদ্ধে জড়াল শান্তিবাহিনী, পুলিশ প্রশাসনকে করা হল টার্গেট। এই সময়টায় বাংলাদেশই রাজনৈতিকভাবে অসুস্থ ছিল, জিয়া আরেকটু অসুস্থতা ছড়িয়ে দিলেন সাধারণ পাহাড়িদের উপর নগ্ন নৃশংস আক্রমণের মাধ্যমে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হল, ধর্ষণকে অস্ত্রে পরিণত করলো মিলিটারি। জলপাই রঙ্গের বিভীষিকায় ছেয়ে গেল পাহাড়, ভারতের মিজোরামে দলে দলে উপজাতিরা পালাতে লাগলো। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত ঢুকিয়ে দিলেন কয়েক লক্ষ বাঙ্গালি, যাদের বলি সেটেলার। সেনাপতি জিয়া অস্ত্রের ভাষায় রাজনৈতিক সমস্যাকে মোকাবেলা করতে গিয়ে জন্ম দিলেন মানবিক সংকটের।
শান্তিবাহিনী সামরিকভাবে জেতে নি, কিন্তু তারা চাঁদাবাজি আর অপহরণের অস্ত্রে পাহাড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলো। জুম্মল্যান্ডের নামে চলা এই অরাজকতা সেনাবাহিনীর অন্যায়গুলাকে মানুষের সামনে জাস্টিফিকেশন দিল। মাঝখানে পড়ে প্রাণ হারালো, জমি হারালো নিরীহ পাহাড়িরা। এর মাঝে জিয়া মারা গেলেন, শান্তিবাহিনী দ্বিখন্ডিত হল, অন্য নিজেদের অন্য এক গ্রুপের প্রীতিবাহিনীর হাতে মরলেন এম এন লারমা। সামনে চলে এলেন শন্তু লারমা। এরশাদ সরকার তিনজেলায় পার্বত্য এলাকাকে ভাগ করলো, পাশাপাশি চললো মিলিটারি আগ্রাসন, পাহাড়ি সশস্ত্র বাহিনীগুলোর চাঁদাবাজি এবং নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি। লম্বা হতে লাগলো লাশের সারি, সাধারণ পাহাড়ি বাঙ্গালী অবিশ্বাসের ভিত মজবুত হল। বারবার যুদ্ধবিরতি, তা লঙ্ঘন এবং নিষ্ফল শান্তি আলোচনা চললো।
‘৯৬ এ বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় এলেন, ভারতকে সম্পৃক্ত করলেন শান্তি প্রক্রিয়ায়। অবশেষে কনভিন্সড হলেন শন্তু লারমা, ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। অস্ত্র ছেড়ে শান্তির পথে এলো পাহাড়িরা। একট ছোট্ট টুইস্ট বলি। ঐ সময় শন্তু লারমার প্যারালাল একজন নেতা ছিলেন ঊষাতন তালুকদার। তাকে কনভিন্স করা যাচ্ছিল না শুরুতে। পরে দেখা গেল তিনি রাজি। আরো পরে দেখা যাবে, উনিই আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়ে বসে আছেন। শেখ হাসিনা যা হাসিমুখ, চাওয়া পাওয়ার বিনিময়ে করেছেন অনেক রক্ত ঝরিয়েও তা করা যায় নাই। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগই কিনা আবার ‘০৯ এ ক্ষমতায় আসার পর থেকে আদিবাসী না বলে উপজাতি বলা শুরু করলো। কারণটা কি?
আদিবাসী শব্দটি সাধারণ কোন শব্দ নয়, এর সাথে অনেক শর্ত প্রযোজ্য। কোনো অঞ্চলের আদি ও অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা Son of the soil হল আদিবাসী। যেমন নিউজিল্যান্ডের মাউরি কিংবা আমেরিকার রেড ইণ্ডিয়ানরা। এদেশে পাহাড়ে মোট তের রকমের উপজাতির মধ্যে প্রধান চাকমারা। চাকমা সম্প্রদায় বাংলাদেশে আসে ১৪১৮ সালে রাজান মোআন তসনির নেতৃত্বে, ব্রহ্মদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে। মারমা বা মগ জনগোষ্ঠী ১৭৮৪ সনে বার্মা থেকে এ অঞ্চলে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে। বাকিদের অবস্থাও এমন অর্থাৎ ভূমিপুত্রের কনসেপ্ট এখানে ইনভ্যালিড।
এবার দেখা যাক অফিসিয়ালি কীভাবে আদিবাসী কনসেপ্টকে ডিফাইন করা হয়। ১৯৮৯ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৬৯নং কনভেনশন অনুযায়ী-
প্রথমত যদি রাষ্ট্র কোন নির্দিষ্ট জাতিগোষ্টীকে আদিবাসী স্বীকৃতি দেয় তাহলে তাদের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আদিবাসী ঘোষিত এলাকায় নিজস্ব পররাষ্ট্র্নীতি থাকবে এবং ঐ এলাকায় যেকোনো খনিজ সম্পদের উত্তোলন ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র উক্ত এলাকার শাসকদের অনুমতি নিতে বাধ্য থাকবে । দেয়া যাবে এই অধিকারগুলো?
চট্টগ্রাম টেকনিক্যালি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের রুট ক্রমেই আমেরিকা, চীন এবং ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আমেরিকা চায় সেন্টমারটিনে একটি সেনাঘাটি স্থাপন করে এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ কিন্তু শেখ হাসিনা তা বারবার প্রত্যাখ্যান করছেন। এই কারণেই বাংলাদেশকে কখনো জঙ্গি, কখনো শান্তিবাহিনী আবার এখন যেমন রোহিঙ্গা প্রবলেম ফেস করতে হচ্ছে এই অঞ্চলে। মাঝে আবার সমুদ্রসীমা বিজয় আমেরিকার কপালের ভাজ বাড়িয়েছে। এই অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন দেয়া মানে নিজের পায়ে কুড়াল না, কুড়ালে পা মারা। এই ধরনের জটিল ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই সেনাশাসন এর প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু পাহাড়ি বাঙ্গালি সংঘাতে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সেনাদের ভূমিকা।
আসলে পাহাড়ের পরিস্থিতি কি? কেমন আছে পাহাড়ের মানুষেরা? পাহাড়ি বনাম সেটেলার বিভেদের চোরাস্রোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কি? স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি কিংবা উপদলীয় কোন্দল কিরূপে আছে এখন?
পাহাড় থেকে আমরা দু ধরনের খবর সাধারণত পাই। একটা হচ্ছে, প্রথমেই যা বলেছি, পাহাড়ের মানুষদের উপর অত্যাচার নির্যাতন, কখনো পাহাড়ি বাঙ্গালি সশস্ত্র সংঘর্ষ। এ ধরনের সংঘর্ষে যাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়ার কথা অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ আসে, রক্ষকের ভেক ধরে ভক্ষক হয়ে গিয়েছেন তারা। এ তালিকায় নবতম সংযোজন দু মারমা বোনের ইনসিডেন্ট। আবার, স্থানীয় রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ সকলেই। আজ জেএসএস মারছে ইউপিডিএফের কাউকে, কালকে ইউপিডিএফ মারছে জনসংহতি সমিতির কাউকে, পরশু কোন বাঙ্গালি নিহত হচ্ছে তাদের হাতে। সবমিলিয়ে বহুমুখী স্বার্থের হাত ধরে বহুমুখী দ্বন্দ্ব ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। এখানে আপনি আর্মিকে দোষ দেবেন। হুম, অবশ্যই বেশকিছু ঘটনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা কিংবা পুলিশ আনসারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে, এই সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই এখনো বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না, আমরা সাজেক-বান্দরবান ঘুরে আসতে পারি। নাহলে বাংলার এক বিরাট অঞ্চল আমাদের জন্যেই ফরবিডেন কিংডম হয়ে থাকতো। আবার, যে সশস্ত্র পাহাড়ি বিরোধীদের আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছি, তাদের আকাঙ্খা তো স্বাধীনতার। বিপুল জনসমর্থনও আছে এসব অস্ত্রধারী গ্রুপের।
প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিতে ভালো বা খারাপ বলে কেউ নেই। এখানে অনেকগুলো খারাপ অপশন এর মধ্য থেকে বেছে নিতে হয় নেসেসারি ইভিলকে। কিন্তু জাতীয়তাবাদের ধ্বজার আড়ালে, রাজনৈতিক সহিংসতার আড়ালে বিপন্ন হয় সাধারণ মানুষের প্রাণ। মারমা দুই তরুণীর হাহাকার বাঙ্গালি নাগরিক মানসে দোলা দেয় না। আবার চাঁদা দিতে অপারগ কোন সেটেলার বাঙ্গালীর লাশ হয়তো খুব সহজেই এড়িয়ে যায় পাহাড়ের মানুষেরা। বিশ্বাসের এক ক্রান্তিকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম, আকাশে অজস্র শকুন। সেখানে কে ভালো আর কে খারাপ – মোটা দাগে বলে দেয়া বড়ই কঠিন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক, প্রতিটি নাগরিক সুবিচার পাক, এই আশাবাদ ব্যক্ত করা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আর কোন উপসংহার টানা আসলেই কঠিন।
সারাবাংলা/এমএম