Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নতুন ব্যবসায়িক ভাবনায় বাঁচবে সাংবাদিকতা


৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৭:৪১

সাংবাদিকতার ক্ষেত্র নিত্য বাড়লেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বাইরে মহান এ পেশাটির সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। পরিবর্তিত বাস্তবতায় একের পর এক ছাপা পত্রিকা বন্ধ হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এই তালিকায় বিশ্বের প্রাচীনতম সংবাদপত্র যুক্তরাজ্যের লয়েডস লিস্ট থেকে শুরু করে দ্য ইনডিপেনডেন্ট, স্টার ট্রিবিউন, মিয়ামি হেরাল্ড, বোস্টন গ্লোবসহ আছে হাজারো পত্রিকার নাম।

এককালের খ্যাতনামা এই ছাপা পত্রিকার অনেকগুলোই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। নতুন ব্যবসায়িক ভাবনা নিয়ে এগিয়ে এসেছে অনলাইনের জগতে। নতুন ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসা এই সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের লেখা ও সংবাদ পরিকল্পনায় এনেছে নতুনত্ব। বিশ্বব্যাপী অনলাইন পাঠকগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করতে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পাশাপাশি পাঠক ও বিশেষজ্ঞের মতামত ও চটুল খবর প্রকাশকে দিয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম যখন আধুনিকীকরণের চলমান প্রক্রিয়ায় মুখর ঠিক সেই সময়ে আশ্চর্যজনকভাবে এশিয়া ও আফ্রিকায় সংবাদপত্রের ব্যবসা রমরমা। বিশ্বের মানচিত্রের এই অঞ্চলের পাঠকরা এখনো ছাপা কাগজে লেখা পড়তে পছন্দ করেন। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়া, কঙ্গো, সুদান, দক্ষিণ আফ্রিকা, লাইবেরিয়া আর এশিয়ায় চীন, ভারত, কাজাখস্তান, ইন্দোনেশিয়ায় একটি জরিপ চালায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইজেনেট। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে এই অঞ্চলের সংবাদপাঠকের সিংহভাগই ছাপা কাগজে সংবাদ পড়তে পছন্দ করেন। তবে অনলাইনে সংবাদ পাঠের হারও উল্লেখজনক হারে বাড়ছে বলে জানিয়েছিল আইজেনেট।

তবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ছাপা পত্রিকার এই রমরমাও আর বেশি দিনের নয়। সময় বাস্তবতায় ক্রমশ বন্ধ হবে এশিয়ার ছাপা পত্রিকাগুলোও। আর এর মধ্যে যেসব সংবাদমাধ্যম ডিজিটালের দুনিয়ায় এগিয়ে থাকবে তাদের হাতেই থাকবে আগামীর দুনিয়ার প্রচারের ব্যাটন। অবশ্য এশিয়ায় বেশ কিছু দেশের অনলাইন পোর্টাল এরই মধ্যে বেশ এগিয়ে গেছে বলে আইজেনেটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

আইজেনেটের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর চলতি বছরে সংবাদমাধ্যমে চলমান পরিবর্তন নিয়ে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সংস্থা নিম্যান ল্যাব এক গবেষণা চালায়। সম্প্রতি ওই গবেষণা প্রতিবেদনের সারমর্ম প্রকাশ করে ওয়াশিংটন পোস্ট।

নিম্যান ল্যাবের গবেষণায় জানা গেছে, ডিজিটাল যুগ ভোক্তাদের রুচি বদলে দিচ্ছে। পাঠকরা এখন সংবাদপত্রের ‘ঐতিহ্যবাহী বিজ্ঞাপনী প্রচারণায়’ বিরক্ত। এ ছাড়া হাতে হাতে স্মার্টফোন বদলে দিয়েছে পাঠাভ্যাসও। তরুণ পাঠকরা সকালে পত্রিকার পাতা ওল্টানোর চাইতে হাতের স্মার্টফোনে প্রধান খবরগুলো দেখে দিতে পছন্দ করেন।

গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মানুষ খবর পড়ছেন ঠিকই, কিন্তু এই মাধ্যমটিতে আবার বিজ্ঞাপনের বাজারের আশানুরূপ বিস্তার ঘটেনি। ফলে নতুন এই সংবাদমাধ্যমটিকেও টিকে থাকার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

আর এই কঠিন বাস্তবতায় বাণিজ্যিকভাবে টিকে থাকতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো একের পর এক উদ্ভাবনী উপায় ও মডেল বের করছে। এর মধ্যে কয়েকটি উপায় এরইমধ্যে প্রমাণ করেছে নতুন ব্যবসায়িক ভাবনাতেই বাঁচবে আগামীর সাংবাদিকতা। নতুন এই ব্যবসায়িক ভাবনার কয়েকটি প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।

স্পনসরড আর্টিকেল : প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা বা বিজ্ঞাপনের নতুন প্রচলিত মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘স্পন্সরড আর্টিকেল’। এতে সাধারণত সাংবাদিকতায় প্রচলিত গল্প বলার ঢংয়ে লেখার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান বা পণ্যের প্রচার করা হয়। এর একমাত্র ব্যতিক্রমটি হলো লেখাটিকে প্রতিষ্ঠান তাদের কোনো প্রতিবেদকের লেখা হিসেবে প্রকাশ না করে ‘স্পনসরড কনটেন্ট’ বা ‘স্পন্সরড আর্টিকেল’ হিসেবে প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে প্রচারমাধ্যমগুলো তাদের নিরপেক্ষতা ও সরাসরি পণ্যের গুণগান না প্রকাশের ‘ঐতিহ্য’ ধরে রাখে। একইসঙ্গে পাঠকও এই নতুন ধারার প্রচারটিকে যথেষ্ঠ গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। পণ্য ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে নতুন ধরনের এই প্রচারণাটিকে সারাবিশ্বের বিজ্ঞাপনদাতারা বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছে। এই ধরনের বিজ্ঞাপন পাঠকের আস্থা তৈরি করে বলেও মনে করেন বিজ্ঞাপনদাতারা।

পাঠকের তহবিল : সারাবিশ্বে এখন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রকাশনা পাঠকের অনুদানের ওপর নির্ভর করে। এটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান চালানোর কৌশল হিসেবে সারাবিশ্বে স্বীকৃত। উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও দ্য গার্ডিয়ান সংবাদমাধ্যম দুটিতে সদস্যপদ অন্তর্ভুক্তির বিনিময়ে অর্থ নেওয়ার রেওয়াজ চালু আছে। এ ছাড়া ইউরোপের সংবাদমাধ্যমগুলোতে ‘সাবসক্রিপশন’ ও ‘পে-ওয়েলের’ মাধ্যমে অর্থ নেওয়ার রীতি চালু আছে। ২০১৬ সালে ডাচ প্রকাশনাসংস্থা ‘দে করাসপন্ডেন্ট’ প্রকাশের আগে পাঠকের কাছ থেকে কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ সাড়ে ১৪ কোটি টাকার (১৭ লাখ মার্কিন ডলার) তহবিল সংগ্রহ করে। এ ছাড়া আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়ার সংবাদমাধ্যম ‘ফ্রন্ট পেইজ আফ্রিকা’ পাঠকের তহবিলে চলে। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক রডনি সিয়েহ দেশটির একজন খ্যাতনামা মানবাধিকারকর্মী। আন্তর্জাতিকমণ্ডলে তার ব্যাপক পরিচিতি এবং দেশটির মানবাধিকার রক্ষায় রডনির ভূমিকার জন্যই পত্রিকাটি পাঠকের তহবিলে স্বাধীনভাবে চলছে।

সাবসক্রিপশনস : অনলাইন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যুগ শুরু হওয়ার পর থেকেই টিকে থাকার মাধ্যম হিসেবে সাবসক্রিপশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এই ব্যবস্থায় পাঠককে তাঁর আগ্রহের খবরসহ গুরুত্বপূর্ণ খবর সম্পর্কে ই-মেইল বা ইন্টারনেট পপ-আপের মাধ্যমে জানিয়ে দেয় সংবাদসংস্থাটি। এ ছাড়া এই সাবস্ক্রাইবার পাঠকরা ‘ভ্যালু এডেড সার্ভিসে’র মাধ্যমেও তার কাঙি্ক্ষত খবরটি পেতে পারেন। বিনিময়ে পাঠক ওই সংবাদসংস্থাটিকে টেলিফোন অপারেটর অথবা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সরাসরি যৎসামান্য অর্থ দেন। বিশ্বের প্রধান অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই সাবসক্রিপশনের ব্যবস্থা চালু আছে। খ্যাতনামা দুই অনলাইন পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ান মূলত সাবক্রিপশনসনির্ভর।

দাতাদের অনুদান: এই ধরনের অনুদান সাধারণত সরকারি সহযোগিতা, মানবহিতৈষী কর্মকাণ্ড ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমের তহবিল থেকে আসে। মানবহিতৈষী বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি সাধারণত মানবকল্যাণে নিয়োজিত সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করে। যেমন— পণ্য কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান ‘ইবে’র প্রতিষ্ঠাতা পিয়েরে ওমিডায়ার প্রতি বছর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করতে বছরে প্রায় সাড়ে আট শ’ কোটি টাকার (১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) অনুদান দেন। এই অর্থ সারাবিশ্বের বিভিন্ন সংস্থাকে কল্যাণমূলক সাংবাদিকতায় অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। এ ছাড়া পিয়েরে ওমিডায়ার সম্প্রতি অনলাইনে ‘মিথ্যা খবরের প্রচার’ রুখতেও মনোযোগী হয়েছেন। এ ছাড়া সারাবিশ্বেই সরকার সংবাদমাধ্যম পরিচালনা করে ও অনুদান দেয়। ইউরোপের দেশ ফ্রান্স ও নরওয়ের সরকার অলাভজনক বেসরকারি সংবাদমাধ্যমকে অনুদান দেয়। বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবেও সংবাদমাধ্যম পরিচালনার নজির ভুরি ভুরি। সম্প্রতি তুমুল আলোচিত অনলাইনে মিথ্যা খবরের প্রচার রুখতে ফেসবুক ও গুগলও অনলাইন সাংবাদিকতায় এগিয়ে এসেছে।

মাইক্রোপেমেন্টস: ‘মাইক্রোপেমেন্টস’ আভিধানিকভাবে অল্প পরিমাণ অর্থ লেনদেনে ব্যবহৃত শব্দ। কিন্তু এই অল্প অর্থই যে একটি সংবাদমাধ্যমের অন্যতম চালিকাশক্তি হতে পারে সেটি প্রমাণ করেছে। এই গবেষণাসংস্থাটি এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে আগামী দিনের সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে এই ‘মাইক্রোপেমেন্টস’ পদ্ধতিই আশার আলো দেখাবে। এই পদ্ধতিতে পাঠক খবর পড়তে ‘অল্প পরিমাণ অর্থ’ সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দেয়। বাংলাদেশী টাকায় এই পরিমাণ হতে পারে ৮০ পয়সাও (১ সেন্ট)। এই পদ্ধতিতে পাঠক একটি সংবাদ পড়তে পারেন কিংবা একইসঙ্গে এক সপ্তাহ অথবা মাসের পুরো খবরগুলোর প্যাকেজ কিনতে পারেন। এই ব্যবস্থায় পাঠক কোনো প্রকার বিজ্ঞাপন ছাড়াই শুধু নিজের পছন্দেও খবরটি পড়তে পারবেন। সংবাদ সরবরাহকারী সংস্থাগুলো এই ব্যবস্থায় খবরের প্রথম অংশ কিংবা ছবি তাদের ওয়েবসাইটে দেয়। বাকি অংশ পড়তে পাঠককে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। অনলাইনে খবর পড়া ও প্রচারের এই ব্যবস্থাপনায় এরইমধ্যে অর্থ পরিশোধের গেটওয়ে ‘পেপ্যাল’ ও ‘গুগল অ্যাডসেন্স’ এগিয়ে এসেছে। বিশ্বব্যাপী এই দুটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে  ‘মাইক্রোপেমেন্টস’ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়।

নিম্যান ল্যাবের গবেষণা প্রতিবেদনটিতে সাংবাদিকতার নতুন যুগে এসে টিকে থাকার বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্ট খ্যাতনামা কয়েকজন বিপনন বিশেষজ্ঞেরও মন্তব্য নেওয়া হয়েছে। এদেরই একজন ওয়াশিংটন পোস্টের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা জেড হার্টম্যানের একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।

আগামীর সাংবাদিকতার সম্ভাবনার বিষয়ে গবেষণাসংস্থা নিম্যান ল্যাবকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জেড হার্টম্যান বলেছেন, ‘এটা সত্যি যে বিজ্ঞাপন এবং নানা খাত থেকে পাওয়া অর্থ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্র তৈরি করে। তবে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রও তৈরি করে দেয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাই। সংবাদকর্মীদের পেশাগত সততা ও দক্ষতা মিলিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের ও ‘ব্রান্ডভ্যাল’ তৈরি হয়। আর এই ব্রান্ডভ্যালুই একটি প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতার পাশাপাশি আর্থিক সক্ষমতা তৈরি করে দেয়।’

[ নিম্যান ল্যাবের প্রতিবেদন অবলম্বনে ]

সারাবাংলা/এসবি/আইজেকে


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার শাজাহান খান
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০২:৪৫

সম্পর্কিত খবর