বসন্তে ভালোবেসে মন্দ করা ওই দুটি চোখ
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৫:২৯
স্বামী লখিন্দরকে ‘মৃত’ মানতে নারাজ ছিল বেহুলা। তাই কলার ভেলায় কালীদহের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে মরা স্বামীকে নিয়ে ফিরে চলে ঘাটে ঘাটে। সতী নারীর স্বামী মরে না, মরতে পারে না- এমন প্রতিজ্ঞায় ভাসতে থাকে মরা স্বামীর দেহের সাথে বেহুলা। এর পরের কাহিনী সবারই জানা। মরা লখিন্দরকে জ্যান্ত করার যে জেদ বেহুলার মনে চেপেছিল তার নাম কি? সহজ উত্তর ‘ভালোবাসা’!
হ্যাঁ, ভালোবাসাই তো বটে! ভালোলাগার বন্দন থেকে গড়ে উঠা হৃদয়ের বন্ধন। পৃথিবীজুড়ে তুমুল আলোড়ন জাগানো এই একটি মাত্র শব্দ। এ এমন এক মানবিক অনুভূতি যার নাকি কোন বিশেষ সংজ্ঞাই নেই। মনোবিদ্যার প্রচলিত সংজ্ঞায় নাকি বলা হয় ‘মনের মধ্যে অতি আনন্দদায়ক অনুভূতিই হলো ভালোবাসা’।
বেহুলা থেকে কাজলরেখা, সবাই চেয়েছে প্রিয় সঙ্গীর চোখটি খুলে যাক। আবার নিষ্পলক চেয়ে দেখুক পৃথিবীর সৌন্দর্য। পৃথিবীতে ভালোবাসা দেখা যায় না, কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে দেখা যায়। সেই দেখার জন্য চাই চোখ। আজ ভালোবাসা ও চোখ নিয়ে হয়ে যাক দু’চার কথা।
অক্টাভিও পাজ বলেছিলেন, ‘আমার হৃদয় এক চোখ’। জীবনানন্দ দাশ চেয়েছিলেন অনন্ত জীবন নয় শুধু, অনন্তকাল দেখতে পাওয়ার চোখ। শহিদ কাদরির চোখ পাহারা দেয়। জয় গোস্বামীর চোখ ঝর্ণার মতো ছুটে পালায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় চোখের ভাষা মানুষের কৃতঘ্ন সভ্যতা দেখে থেমে থাকে। ধৃতরাষ্ট্রের চোখ ছিলো জন্মান্ধ। অশ্বত্থামার চোখ উপড়ে ফেলে অনন্তকাল বেঁচে থাকার অভিশাপ দিয়েছিলেন কৃষ্ণ। ত্রিনয়ন শক্তি নিয়ে জন্মানো শিশুপালের চোখও কেড়ে নিয়েছিলেন কৃষ্ণ। নির্মলেন্দু গুণের চোখ চোখে চোখে চুমু খায়।
গুরু দ্রোণাচার্য অর্জুনকে অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছিলেন। শিষ্যের যথাযোগ্য পরীক্ষার জন্য দ্রোণাচার্য অর্জুনকে বললেন, “ওই গাছের ডালে কী দেখতে পাচ্ছো”? অর্জুন বলল, “আমি শুধু পাখির চোখ দেখতে পাচ্ছি, গুরুদেব”। গুরুর শিক্ষা মাথায় রেখে অর্জুন এক চোখ বন্ধ করে নিখুঁত নিশানায় তীর চালালো। পাখি বিদ্ধ হলো অর্জুনের তিরে। গুরু তাঁর শিষ্যকে বললো, নিখুঁত নিশানার জন্য ওই একটি চোখই চাই!
কৈশোরে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় একচোখ হারানোর পর একচক্ষুনীতিতে বড় হয়েছি। কৈশোর শেষে তারুণ্য। যথারীতি জীবনে একদিন বসন্ত এসে হাজির। হঠাৎ একদিন নিরালা দুপুরে কেউ একজন আমাকে বললো, ‘আমি তোমার ওই ছোট্ট চোখটিকে-ই ভালোবাসি’। চমকে গিয়েছিলাম অভিনব এমন প্রস্তাব শুনে। যা আমি আড়ালে রাখতে চাইছি বছরের পর বছর, তাঁর প্রতি এক নিষিদ্ধ ভালোবাসা কেন এই নারীর? আমার অন্তর্চক্ষু গেয়ে উঠলো ‘কে জানিত আসবে তুমি গো অনাহূতের মতো’? উত্তরে সে আমাকে জানায়, ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে’। আমি যেন তাঁর চোখে চোখ রেখে পুরো জীবনের জন্য হারিয়ে গেলাম। ভাবছি, ‘তা (প্রস্তাবটি) সে যতই ভালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ’।
চোখে চোখে অনেক বার্তা বিনিময় হয় আমাদের। তাঁর ভ্রুপল্লবে চন্দনের বনে যাওয়ার ইশারায় আমি অস্থির হয়ে পড়ি। যেন সুনীলের মাতাল কবিতা ‘চন্দনের বনে’ যাওয়ার তাড়া। তাঁকে আমি বনফুলের ‘চোখ গেলো’ গল্প পড়ে শোনাই। নায়ক তার নায়িকাকে বলছে ‘”অসাবধানতার জন্য অমন দুটি চোখ গেল!” নায়িকা উত্তর দিল – “কেন যে গেল তা যদি না বুঝতে পেরে থাক তা হলে না জানাই ভালো।” একদিন ভালোবাসার উত্তুঙ্গ পরিণতিতে। সে আমাকে গভীর আবেগে চুমু খায়। আমাকে বলে, ‘আমি তো ভালো চুমু খেতে পারি না’! তবুও দেখি চুমু খেতে গিয়ে তাঁর দুই চোখ নিবিড়ভাবে বন্ধ। সে চোখ বন্ধ করে রেখে পাল্টা-চুমু প্রার্থনা করে আমার। কেন সে এভাবে দু’চোখ বন্ধ করে চুমু খেতে চায় আমাকে? চুমু দেয়ার সময় মস্তিষ্কে ভাল লাগার অনুভব ছড়িয়ে পড়ে। মস্তিষ্ক একই সঙ্গে দু’টি কাজ ভাল করে করতে পারে না। তাই দর্শনেন্দ্রিয়র তুলনায় স্পর্শজনিত বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে চোখকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার নির্দেশ পাঠাচ্ছে মস্তিষ্ক! আমি বুঝি, দৃষ্টিশক্তি ও বোধশক্তি অন্য দিকে ব্যস্ত থাকলে তাঁর সেন্সরি অর্গানরা আর কোনও ইন্দ্রিয়কে অত গুরুত্ব দেয় না। তাই চোখ খোলা থাকলে চুমু থেকে সার্বিক আনন্দ মেলে না। কিন্তু আমাকে কষ্ট করে দু’টি চোখ বন্ধ করতে হয়না। একটি চোখ তো এমনিতেই বন্ধ থাকে, শিকার খোঁজে!
এই সমাজে আবেগী মানুষগুলো যখন ভয়ংকর বঞ্চনার শিকার হন বা তীব্র সঙ্গপ্রত্যাশিরা হঠাৎ করে নিঃসঙ্গ হন; তখন কারো কারো মৃত্যুচিন্তা আসে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, কোন একজন মানুষের জীবনে এসে যখন আরেকজন বন্ধু, সহকর্মী বা পার্টনার ‘ভালোবাসার’ সন্ধান দেয় কিন্তু ‘সাড়া দেয়না’ তখন প্রাপ্ত ভালোবাসা বা নবলব্ধ আবেগ অনুভূতিগুলো হয়ে যায় মানুষটির ওপর চাপ। সে পারে না পরিস্থিতিকে প্রত্যাখ্যান করতে, পারে না ধরে রাখতে। সেজন্য একটি গান জনপ্রিয় হয়েছে আমাদের এপার বাংলায়, ‘চলে যদি যাবি দূরে স্বার্থপর, আমাকে কেন জোছনা দেখালি?’ আমি যেন আল মাহমুদের চোখ কবিতার প্রথম দুই লাইন- ‘এখন চোখ নিয়েই হলো আমার সমস্যা। যেন আমি জন্ম থেকেই অতিরিক্ত অবলোকনশক্তিকে ধারণ করে আছি‘। দৃষ্টিবিভ্রমের শিকার হয়ে আল মাহমুদ লিখছেন, ‘আমি একসময় সংবাদপত্রে প্রুফরিডার ছিলাম। প্রতি আ-কার ই-কারের অনুপস্থিতি এখনও আমার চোখে লাগে’। আমার অকেজো চোখটি যেন তসলিমা নাসরিনের দৃষ্টিপাত কবিতার মতো বলছে ‘নির্মিমেষ তাকিয়ে আছি সুন্দরের দিকে/কার এমন স্পর্ধা আছে ফিরিয়ে নেয় চোখ’?
ভালোবেসে পুরোপুরি অন্ধ হওয়ার আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের নিরালা চন্দনের বনে আমি শুনেছিলাম, ‘তোমার ওই ভীষণ শীতল চোখ, যেন কৈশোর রাজীব চেয়ে আছে অপলক লজ্জাবনত দৃষ্টিতে। তোমার সেই মৃত নিষ্প্রভ নির্জন ফ্যাকাশে মলিন চোখের হারিয়ে যাওয়া মণি আমি’। অভিনব সান্ত্বনা শুনে আমার চর্মচক্ষু বন্ধ হয়ে আসে। অন্তর্চক্ষুতে দেখতে পাই সকলের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। আমি ভালোবাসি এক দূর দ্রাঘিমার ‘বন্দিনী’কে। অথচ যে নিজেকে ‘নন্দিনী’ ভাবতে চায়। ‘ব’ আর ‘ন’-এ কি আসে যায়? পৃথিবীর ঘোর লাগা এক প্রান্তর থেকে অনেক দূরের দূরদ্বীপবাসিনী বন্দিনী বা নন্দিনী যেন আমাকে বলছে, ‘Be strong, be positive, one eye is enough to live, to love, to survive. Pack your bags and smile. Look at the smiley that I’ve given you. Smile like that Tears don’t suit you, my love. I’m always with you’.
কারো অনুপস্থিতি বা শূন্যতায় মন খারাপ না করে, তাঁর প্রিয় কাজে নিজেকে সঁপে দেয়ার নামই ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষটি যখন দূরে থাকে, অন্তরে তখন নূর জ্বলে উঠে। হৃদয় তোলপাড় করা ভালোবাসার পাথুরে কষাঘাতে জর্জরিত নিঃসীম শূণ্যতাই ‘প্রেম’। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর, অনেকবার ভেবেছি জীবনের অর্থ কী? বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘‘এ জীবন লইয়া কি করিব ?” জীবন হলো তাই, যা আমরা প্রত্যেকদিন যাপন করি। যাপিত জীবনে অসফল প্রেম থাকে, থাকে সফলতা, ব্যর্থতা, চাহিদা আর যোগানের অপূর্ব বা অপূর্ণ সমন্বয়। সুখ আর শোক চক্রাকারে ঘুরেফিরে আসে জীবনে। তবুও মানুষ গড়ে নিতে পারে ছিমছাম একটি জীবন। যে জীবনে, ভালোবাসার স্ত্রী ও একটা চমৎকার সংসার থাকে। একটা মেয়ে থাকে, ফুটফুটে ফুলের মতন। যাকে নিয়ে আমি বাকি জীবন গর্ব করতে পারব। আমার স্ত্রী-কন্যা আর যাই করুক, সবটুকুতেই আমি গর্ব করব। বছরজুড়ে আমার ব্যস্ততার চুল্লিতে আগুন ঠেলে দেয়ার সর্বংসহা কাঠ এরা। নিয়ত প্রেমের আগুনে এরা পোড়ে, আমাকেও পোড়ায়। থাকবে কিছু খুনসুটি বন্ধুত্ব, থাকবে ডানা ঝাপটানো কোন এক উঠপাখি, যে কিনা পাখা নিয়ে জন্মানোর পরও উড়তে পারে না। এ যদি হয় জীবন, তবে এ জীবন ভালোই। প্রতিদিন ঘরে ফিরে, অনেক হিসেব করে, ‘এ জীবন চাই’, তা বলাই জীবন।
লেখক: রাজীব নন্দী
সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়