Tuesday 10 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুজিববর্ষে বাংলাদেশে ফুটবল কোথায়?


৫ মার্চ ২০২০ ১২:১০

বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এক খন্ড চিত্র তিনি। স্বাধীনতা পরর্বতী সময়ে দেশজ ফুটবলের এক বর্ণময় চরিত্র। তার ক্যারিয়ারে ধারণ করে আছেন ফুটবল উন্নয়নের দেড় দশক। সত্তরের দশকের গোড়া থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ছাত্র-যুবা-বৃদ্ধ সবার মন জয় করা এক ফুটবলার। স্টারডামটাও দারুণভাবে উপভোগ করেছেন তিনি। প্রচারমাধ্যমে তার স্টারডামটা এখনও সেলাবেল। তার বড় একটা কারণ, নিজের থেকে তার ছায়াটা বড় হওয়ার আগেই ফুটবল মাঠ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। বড় নাম মাঠের কাঁদা-জলে, ধুলা-বালিতে গড়াগড়ি খাওয়ার সুযোগ দেননি তিনি।

দেশের ফুটবলে রাজকীয় বিদায় নিয়েছিলেন কাজী সালাউদ্দিন। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ। গ্যালারি ভর্তি দর্শক। দুই দলের সমর্থকরা গ্যালারি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন তাঁকে। স্মৃতিকাতর বাঙালির মনোজগত থেকে’৮৪-র সেই স্মৃতি এখনও ফেডআউট হয়ে যায়নি।

একইভাবে স্মৃতি রিওয়াইন্ড করলে মানসপটে ফেড ইন হয়, আবাহনী, জাতীয় দল এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের কোচ হিসেবে সাফল্য খরা দেখা দিতেই তাঁর সরে যাওয়া। ফুটবল ক্যারিয়ারে জাতীয় দলের অধিনায়ক পরির্বতনের প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন তিনি। ব্যাংকক এশিয়াডে আবাহনীর সাত ফুটবলারের সাথে তিনিও যাননি। ফুটবল ম্যাচ ঘিরে সামরিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। জেল খেটেছেন। সমর্থকদের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন। আবার সেই সামরিক শাসক তাঁকে বঙ্গবভনে ডেকে নিয়ে সংবর্ধনাও দিয়েছেন!

বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালের বন্ধু। আবাহনীর সাবেক তারকা। আওয়ামী ঘরানার লোক। কিন্তু ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতির পদ নিলেন ডান এবং উগ্র ডান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়! আবার পদত্যাগ করে বেরিয়ে গেলেন একজন অখেলোয়াড়কে জাতীয় দলের ম্যানেজার করার প্রতিবাদে। পদত্যাগ পরর্বতী সময়ে দারুণ একটা কথা বলেছিলেন। ফুটবলের জন্য কিছু করতে হলে বাফুফে-তে ফিরবো ‘বস’ হয়েই। যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে।

তিনি ফিরলেন। বাফুফের সভাপতি হয়েই ফেডারেশনে ফিরলেন। সেটা গত দশকে। তাকে সভাপতি হিসেবে জয়ী করার জন্য সাবেক তারকা ফুটবলাররা জোটবদ্ধ হলেন। একজন ফুটবলার শীর্ষপদে থাকলে দেশের ফুটবলের চেহারা পাল্টাতে পারে। সেরকম এক স্বপ্ন নিয়েই ফুটবলাররা তার পাশে থাকলেন। কিন্তু এই প্রাক্তনি বেশি মনোযোগী হলেন ক্ষমতার ব্যবহারে। ফেডারেশনের উপর নিয়ন্ত্রণ আর কর্তৃত্ব বাড়াতে আদর্শ থেকে একটু একটু সরতে শুরু করলেন। যার বা যাদের কারণে বাফুফে থেকে পদত্যাগ করেছিলেন তাদের সাথেই সহাবস্থান করলেন! দূরে সরে যেতে লাগলেন তার কাছের লোক হিসেবে চিহ্নিতরা।

প্রথমবার সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে একটু একটু করে ভোল বদল শুরু করলেন! টানা তৃতীয় বার সভাপতি নির্বাচিত হলেন। কিন্তু দেশের ফুটবলের পরিচালনা পদ্ধতি কী হবে। কোন ঘরানার ফুটবলকে মডেল হিসেবে নিয়ে সামনের দিকে এগুবে বাংলাদেশ? এসব প্রশ্নের উত্তরে তার চঞ্চল মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। সেই চঞ্চলতা আর সিদ্ধান্তহীনতার একটা উদাহরণ হচ্ছে; বাফুফের ফুটবল একাডেমীর হঠাৎ সিলেটে ভূমিষ্ট হওয়া এবং একাডেমি চালানো কাজ বাফুফের নয় বলে তার ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া। সঙ্গে উন্নত বিশ্বের প্রেসক্রিপশন- একাডেমি চালাবে ক্লাবগুলো।

বছর চারেক আগে সভাপতির পদে নির্বাচনের আগে ঘোষণা করলেন; এটাই তার শেষ নির্বাচন। কিন্তু গণমাধ্যমের কাছে বলা সেই কথাটাকে মনে হচ্ছে বেমালুম ভুলতে বসেছেন তিনি। এবার আবার সভাপতি পদে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। তার ঘোষণা ক্ষেপিয়ে তুলেছে তার এক সময়ের টিমমেটদের। অনেক প্রাক্তনিকে। তা ছাড়া বাফুফের কমিটির ভেতরেও এক গ্রুপের সঙ্গে তার নীরব শীতল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিশ্রুতি আর কাজে কোথায় যেন তার বৈপরীত্য অনেক বেশি ফুঁটে উঠেছে। যার প্রতিফলন বাংলাদেশ ফুটবলের রুগ্ন চেহারায়।

বলতেই হবে গেলো এক যুগে ফুটবল সমাজে হতাশার প্রভাব। দেশের ফুটবল জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। মান হারিয়েছে। জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকীকে সামনে রেখে ফুটবলের ক্রমশ নিম্মগামী চেহারাটা সত্যিই বেমানান। ক্রিকেটের কথা বাদ দিন; আর্চারির মত খেলাও উন্নয়নের রথে সাওয়ারি, আর ফুটবল নিম্মগামী। এই প্রচারকে আর যাই হোক বিরোধী মহলের অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বরং যারা কথাগুলো বলছেন সেটাকে ফুটবল সমাজের স্বাধীন স্বর-ই বলতে হবে।

মুজিব বর্ষে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ফুটবল? সেটা জানার জন্য কোন ব্যক্তি বা কর্মকর্তার কথা শোনার প্রয়োজন পড়বে না। অন্তত আজকালকার নেট জামানায়। ডাব্লিউ ডাব্লিউ ডাব্লিউ ডট লিখে ফিফার ওয়েবসাউটে সার্চ দিলেই বেরিয়ে পড়ে সব কিছু। ফিফা র‌্যাংকিং আর যাই হোক মিথ্যা তথ্য দিবে না। র‌্যাংকিং এ দুইশ’র কাছাকাছি অবস্থান বাংলাদেশের। একটা অস্বস্তিরোধ করেন অনেক সাবেক ফুটবলার থেকে ফুটবলপ্রেমী। ফিফার র‌্যাংকিং এর বিষয়টা ভুল, তা বলা যাচ্ছে না। যেমন বলা যাবে না ফিফা একটা অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বাংলাদেশ ফুটবলে। বাফুফের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক রীতির ব্যতয়ের সুযোগ নেই।

এক যুগ সভাপতির পদে থাকার পর যার হাত ধরে দেশের ফুটবল ক্রমশ নিম্মমুখি, তার নিজের বোঝা উচিৎ ফুটবল নাকি ফেডারেশনের পদ কোনটা গুরুত্ব পাওয়া উচিত। ফুটবল পরিচালনার পথ যদি ভুল হয়, তাহলে মান ক্রমশ নিম্মগামী হবে। তাতে দর্শক ফুটবল বিমুখ হবে। সেটা হয়েছে। এর একটা অবস্থায় বাফুফে-তে নতুন ব্লাড ইনজেক্ট জরুরি। সেটা করা না হলে ফুটবলের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং ভালবাসার জায়গা থেকে প্রাক্তনিদেরও পরির্বতন চাই’ স্বরটা আরো জোরালো হতে পারে। ফুটবলের কর্ণধারদের কানে স্বরটা পৌঁছালে ভাল। ফুটবল নিয়ে সাবেকদের উদ্বেগকে সম্মান জানানো ফুটবল পরিচালনার শিষ্টাচারের মধ্যেই পড়ে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কর্তারা সেই শিষ্টাচারকে আরো বেশি সম্মান দেখাবেন। তা দেখাতে না পারলে ফুটবল নিয়ে বাঙালির স্বপ্নের অট্টালিকা এগুয়েমির ‘বুলডোজারে গুড়িয়ে যেতে পারে।

লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট

মুজিববর্ষে বাংলাদেশের ফুটবল কোথায়?


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর