যোগাযোগবিদ্যার আলোকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ
৭ মার্চ ২০২০ ১৭:০৮
আজ আমাদের বাঙালি জাতির জীবনে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। কোন লিখিত স্ক্রিপ্ট ছাড়াই বঙ্গবন্ধু আজকের দিনটিতে লাখো শিষ্যের সামনে ঐতিহাসিক কিছু বাণী দিয়েছিলেন। একটি জাতিকে স্বাধীনতার ডাকে উদীপ্ত করতে পেরেছিলেন তিনি অসাধারণ চিত্রকল্পময় ভাষণে। ১৯৭১ সালের এই দিনে প্রথমেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি- আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে….’
গুরুর বক্তৃতা/ভাষণ শুনে শিষ্য কখন উদীপ্ত হয়? যদি গুরুর উচ্চারণে শিষ্যের মনের ধ্বনিই প্রতিধ্বনিত হয়। বক্তৃতাটি বারবার শুনি আর ভাবি। বিশ্বের ‘খুব কম নেতা’দের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লাখো দর্শক-শ্রোতাকে উদ্দেশ করে যিনি বলতে পেরেছিলেন- ‘আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন’। দুনিয়ার বুকে এমন কোন কোন পাওয়া বিরল, যিনি এইভাবে দর্শক-শ্রোতাকে সম্মান জানিয়েছেন। কথাসাহিত্যিক ও গবেষক শাহাদুজ্জামান তাঁর এক নিবন্ধে লিখেছেন- ‘‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন- ঐ একটি বাক্যের মধ্য দিয়েই বিশাল জনসভায় সাত-আট লক্ষ মানুষের সঙ্গে ঐ একজন মানুষের যেন মেলবন্ধন ঘটে গেল মুহুর্তের মধ্যেই। ঐ লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের আস্থার সম্পূর্ণটুকু মঞ্চে দাঁড়ানো শেখ মুজিবের উপর এবং শেখ মুজিব ভাষণের শুরুতেই ঐ একটি বাক্যের মধ্য দিয়ে ঐ অগুণতি মানুষের ওপর তার সম্পূর্ণ আস্থার কথা জানান দিলেন। একটি সেতু রচিত হয়ে গেল। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে, তার সামনে দাঁড়ানো এই লক্ষ জনতা সবকিছু শুধু জানেন না, বোঝেনও। তিনি নিমিত্ত মাত্র।’’
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ভাইয়েরা, আমার উপর বিশ্বাস আছে? আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা, মানুষের অধিকার চাই।’ অর্থাৎ তিনি দুঃখ, রাগ, ক্ষোভ, প্রত্যাশা, সংহতি, শৃঙ্খলা, যুদ্ধ, শান্তি সব একই বক্তৃতায় এনেছেন। অধ্যাপক আ.আ.ম.স. আরেফিন সিদ্দিক এক গবেষণামূলক নিবন্ধে লিখেছেন- ‘৭ মার্চের ভাষণ যোগাযোগ বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক প্রয়োগের এক বিস্ময়কর ঘটনা।.. সম্প্রচার তত্ত্বে প্রতি মিনিটে ৬০ শব্দের উচ্চারণ একটি আদর্শ হিসাব। এক হাজার একশত সাতটি শব্দের এ ভাষণে কোনো বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি নেই, কোনো বাহুল্য নেই, ভাষণের সূচনাপর্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ হ্যাঁ, মানববিদ্যায় যোগাযোগের প্রয়োগ বিষয়ে আধুনিক নিয়মকানুনের এক আশ্চর্য প্রতিফলন ঘটেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক ভাষণে। যেখানে আছে হাজার বছরের বাঙালির সংগ্রামের সারকথা। তবে দু-একটি স্থানে পুনরাবৃত্তি বক্তব্যের প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দঅন্তর্লীন তাৎপর্যকে বেগবান করেছে। একটানেই বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিটে এই কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছিলেন।
মানুষের জীবনে একটি বড় সম্পদ তাঁর বাকশক্তি। বলা হয়, শব্দই ব্রহ্ম! শব্দ উচ্চারণ করেই মানুষ সেই শব্দকে বিন্যস্ত করে তাকে অর্থবহ যোগাযোগ বার্তাতে পরিণত করতে পারে। আপন ভাব প্রকাশে তাই ভাষণ পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয় একটি বিষয়। ক্লাসিক থিয়েটারের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলে উঠেছিলেন, ‘তোমার ক্ষুধিত সন্তানদের পদধ্বনি ওই শোনা যাইতেছে, এখন বাজাও তোমার শঙ্খ, জ্বালো তোমার প্রদীপ।’ লেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত সাহিত্য-শাখার সভাপতির ভাষণের শুরুতেই চমকে দিয়েছেন এই বলে যে, ‘মানুষকে প্রণাম! যে মানুষ সাহিত্যের উপজীব্য তাকে। যে মানুষ সাহিত্যের রচয়িতা তাকেও।’ আবার রঙপুর সারস্বত সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ভাষণের শুরুতেই বলেছিলেন, ‘আমার যোগ্যতার কথা বিচার না করেই আমার উপর আপনারা যে সম্মান অর্পন করেছেন, তার মূল্য সমন্ধে আমি যথেষ্ট সচেতন। এজন্যই আপনাদের সবাইকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।’ সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় ‘বাংলাদেশের নূতন প্রকাশ মুহূর্তে’ শীর্ষক কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত ভাষণে বলে উঠেছিলেন, ‘কালসমুদ্র থেকে বাংলাদেশের খণ্ডিত পূর্বাংশ পূর্ববঙ্গ পূর্ব পাকিস্তান নূতন চেতনায় নূতন মহিমায় এক কথায় এক নবীন মাহমান্বিত সত্তায় যেন অভ্যুত্থিত হচ্ছেন, তাঁকে মাথায় করে দেবতার মতো তুলেছেন পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। তাঁদের পুরোধা শেখ মুজিবুর রহমান। সমগ্র বিশ্ববাসী তাঁদের ঘোষণা শুনেছেন। এদেশ পূর্ব পাকিস্তান নয়, এদেশ বাংলাদেশ। সোনার বাংলাদেশ।’ এভাবেই বাঙালি মনিষীরা ভাষণের শুরুতেই দর্শত শ্রোতাদের হৃদয়ে আলোড়ন তুলতে পারতেন।
রাজনীতি ও সাহিত্য থেকে এবার চোখ ফেরাই মিথলজিতে। মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’-এ দেখেছি গ্রিক বীর আগামেনন দেশে ফিরে অশ্রুসিক্ত হৃদয়ে চুম্বন করে বক্তৃতা দিয়েছেন দেশকে উদ্দেশ করে। ‘রামায়ণ’-এ রামচন্দ্রের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছিল ঐতিহাসিক বক্তৃতা, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’ মদিনায় হিজরত করতে যাওয়ার সময় অশ্রুসিক্ত নয়নে হযরত তাকিয়েছেন পেছন ফিরে। ফেলে আসা মাতৃভূমি মক্কার দিকে নবী বলেছিলেন, ‘হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ঈমান’- স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। যুদ্ধক্ষেত্র-ধর্মক্ষেত্রতে (কুরুক্ষেত্র) দেখি যুদ্ধভীত অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের ঐতিহাসিক ভাষণ। কৃষ্ণ বলছেন- ‘দুর্যোধনের অর্ধমের বিরুদ্ধে এই ন্যায়যুদ্ধে সাড়া দেয়াই ধর্ম, এই যুদ্ধে অস্ত্রত্যাগ ভীরুতা।’ হ্যাঁ, যুগে যুগে মহামানবেরা এমনিভাবেই আহ্বান জানিয়েছেন মানুষকে স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বভাষার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তা আলোকিত করার জন্যে।
আধুনিক যোগাযোগবিদ্যার পরিসরে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একেবারে শেষ বাক্য ‘এবারের সংগ্রাম-আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাঙালি জাতির জন্মবেদনার চিৎকার। স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বভাষার প্রেমে উদ্বুদ্ধ না হয়ে কেউ এই চিৎকার করতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু এই জাতির স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন বলেই তিনি তর্জনি তুলে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’। অথচ আমাদের সমাজে তর্জনী তুলে কথা বলাটি সামাজিক ট্যাবুতে ‘বেয়াদবি’র চিহ্ন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন বলেন, ‘আমরা মানুষ’… তখন সেই তর্জনীকে মোটেও ঔদ্ধত্য মনে হয় না।
একটা গল্প বলি। পিতৃতুল্য এক বয়জ্যেষ্ঠ বইপ্রেমী পাঠকের সাথে আলাপ হলো সেদিন। কথা প্রসঙ্গে বইয়ের বিষয় এলো। দারুণ আড্ডাপ্রিয় এবং বইপড়ুয়া ভদ্রলোক। জগত সংসারের সবকিছুই যার আগ্রহের বিষয়। আমি বিষ্ময়ে তাঁর পারঙ্গমতার দিকে তাকাই। তাঁর বিচিত্র আগ্রহের প্রতি সম্মান করে মনে-মনে ভাবি, এ যেন ‘সবজান্তা উইকিপিডিয়া’। নৈশভোজের আড্ডায় তিনি বললেন, ‘আপনি ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফ্রস্টের বই পড়েছেন?’ ‘না’ উত্তর শুনে কিছুটা অবাক হয়েছেন হয়তো। বললেন, ‘পড়বেন সময় করে বঙ্গবন্ধুর সাথে ফ্রস্টের আলাপ।’ সম্মতিসূচক ‘হ্যাঁ’ বলে নৈশাহারে মন দিলাম। পরদিন ভোরে ইন্টারনেট ঘেঁটে ফ্রস্টের একটি কাজ চোখে পড়লো। সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু কেন স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, ব্রিটিশ সাংবাদিক ফ্রস্টের এমন একটি প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলছিলেন- ‘I don’t want to allow them to tell the world that Mujibur Rahman has declared independence and we have no alternative but to hit back. I wanted them to hit us first and my people were ready to resist it.’
পণ্ডিতের কথা, ‘অল্প কথায় কাজ হইলে বেশি কথার দরকার কী’? আর সময়ের কথা যথাসময়ে বললেই সবচেয়ে ভালো ফল হয়। অসময়ে বললে বিফলে যেতে পারে। ৭ই মার্চের ভাষণেও বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা না করে আবার স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। যার মধ্য দিয়ে দারুণ একটি শান্তি-ঐক্য-সংগ্রামের আলো আঁধারি দিশা খুঁজে দিলেন। সমগ্র ঢাকাকে তিনি আইনের আওতার রেখে মুক্তিকামী চরমপন্থীদের প্রতি যুদ্ধের টগবগে আহ্বানও দিলেন।
আমি বলবো কুরু -পাণ্ডব দুই দলকে কৌশলে বশে রাখার মতো মহামতি ভীষ্মের পাণ্ডিত্য ভর করেছিলো সেদিন মুজিবের ওপর। যে অল্প কথায়, কম শব্দে, কম বিরামচিহ্নে, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে বিশ্বকে, বাঙালি জাতিকে এবং পাকিস্তানি শাসককে বার্তা দিতে পেরেছেন তা আধুনিক যোগাযোগবিদ্যার প্রায়োগিক ইতিহাসে অনন্য। পাবলিক স্পিকিং গবেষণার একাডেমিক পরিসরে ‘নেতা-জনতা’র আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণের মোক্ষম এক গবেষণার বিষয় এই ভাষণ। যোগাযোগবিদ্যার শিক্ষার্থী হিসেবে এই ভাষণ নিয়ে আরো গবেষণা করা আমাদের দায়।
একদিন ঘনপল্লবিত বনশ্রীতে এক গুরু-শিষ্য পথভ্রমণে বের হলেন। গুরু সারাক্ষণ শিষ্যকে উপদেশ দিতে থাকলেন। শিষ্য নীরব। গুরু বলে চললেন তাঁর জীবনের সাধনার পথ। বলে চললেন, জীবনব্যাপী তাঁর সংগ্রামের কথা। শিষ্যের হৃদয়ে গুরুর বাণী প্রবেশের চেষ্টায় গুরু ছিলেন মুখর বক্তা। কিন্তু শিষ্য ভীষণ শান্ত ও মৌনী। গুরুর ভাষণে ছন্দছেদ ঘটিয়ে শিষ্য হঠাৎ বলেন উঠলেন, ‘গুরুদেব- আপনার নীরবতা-ই আমার জীবনের বড় শিক্ষা। আপনার নীরব চেহারায় ওই দুটি চোখ থেকে আমি যে বাণী নিতে পারি, অনর্গল বক্তৃতার মুখ আমাকে সেই শান্তি দেয় না’। সেই থেকে গুরু-শিষ্য নিরবতার অধ্যয়ন করতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল সরবতা শেখায় না। শেখায় নীরবতাও। এই সরব-নীরব ভাষণ নিয়ে বহুমাত্রিক গবেষণা হোক, বহু ভাষায় অনুবাদ করে সারা দুনিয়ায় প্রচার করা হোক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে এই দেশে বহুবছর নির্বাসনে রাখা হয়েছিল, বহুবছর প্রচারমাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যারা নিষিদ্ধ করেছিল- আজ ঐতিহাসিক সাতই মার্চের দিন ওদের দুই ‘পাপকর্ণ’র দুই পাশে দুই শব্দভেদী মাইকে বেজে উঠুক স্বাধীনতার বজ্রনির্ঘোষ- ‘জয় বাংলা’!
রাজীব নন্দী, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সমন্বয়ক, ইন্দো-বাংলা মিডিয়া এডুটেকরস নেটওয়ার্ক