ক্রিকেটের নারী, নারীর ক্রিকেট ও আমাদের মন-মানসিকতা
৮ মার্চ ২০২০ ১১:০৮
মিডিয়াবন্দিত সমাজে এখনও পুরুষ এবং নারী খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকে বিরাট ফারাক! সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে বলুন কিংবা ভারত বা অস্ট্রেলিয়ান নারী ক্রিকেটে বলুন। আর বাংলাদেশেতো বটেই। আর্ন্তজাতিক নারী দিবসটিতেই আইসিসি নারী টি-টোয়েন্টি ওর্য়াল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ম্যাচটি ফেলেছে। সেদিক থেকে আজকের দিনটি নারীদেরই। কারণ বিশ^ব্যাপী ক্রিকেটপ্রেমিরা আজ নারীদের ফাইনাল ম্যাচটি দেখার সুযোগ পাবে। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের পথচলা শুরু হয়েছিল যে এমসিজিতে, সেখানেই ফাইনাল। নারীদের কোন বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি দর্শক গ্যালারিতে থাকবেন। এরকম একটা আয়োজন। কিন্তু ক্রিকেটে কী নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? প্রশ্নটা উঠছে। শুধু ক্রিকেট কেন, বিশ্বের সব জায়গায় আজ ঘটা করে আয়োজন করা হচ্ছে নানা অনুষ্ঠান। নানা টুর্নামন্টে। কিন্তু কোথাও থেকে কী ঘোষণা এসেছে; নারী-পুরুষ খেলোয়াড়দের বেতন বৈষম্য কমানো হলো। অথবা নারী-পুরুষ খেলোয়াড় মধ্যে পারিশ্রমিক বা সুযোগ-সুবিধায় কোন বৈষম্য থাকবে না! না এই জায়গায় এখনো এক আকাশের বাসিন্দা হতে পারিনি আমরা।
অথচ সেই ১৯৭৫ এ জাতিসংঘ বিশ্ব নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর ১৯৭৭ সাল থেকে ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে আর্ন্তজাতিক নারী দিবস। কিন্তু একটা দিন বিশেষভাবে পালন করে নারী-পুরুষের বিভাজন কতোটা কমলো, বা কমানো সম্ভব? ইতিহাস বলছে এখনো সম্ভব হয়নি। পরিকল্পনাবিদরা বলছেন সময় লাগবে। তবে এটা সত্য, সময়ের সাথে সাথে সামাজিক প্রেক্ষাপট কিছুটা বদলেছে। ‘নারীমুক্তি’ শব্দ গুচ্ছের একটা প্রভাব বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেও পড়েছে। মাঝে খানিকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ও পার করেছিল বাংলাদেশ। যেখানে নারীরা ফুটবল মাঠে নামতে পারবেন না বলে হুমকি দেয়া হয়েছিলো। বাংলাদেশ সফরে আসা পশ্চিমবঙ্গ নারী দলকে ফিরে যেতে হয়েছিল ম্যাচ না খেলে এমন ঘটনাও ঘটেছে। দুই দশক পর সেই অবস্থা কিছুটা না; বলতে হবে অনেকটাই পাল্টেছে। যে কারণে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবলে ছেলেদের দলের চেয়ে ভাল করছে নারী দল। ক্রিকেটেও প্রথম বড় ট্রফিটা এসেছিল নারী ক্রিকেটারদের হাত ধরে। প্রথম এশিয়া কাপ তারাই জিতেছিল। সেটা ভারতকে হারিয়ে। কিন্তু আজ সেই ভারত নারী টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপের ফাইনাল খেলছে। আর বাংলাদেশ ফিরলো কোনো জয় ছাড়া!
কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন কে? খুঁজতে গেলে একটা কমন উত্তর মিলবে কর্তাদের মুখে। অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা হাঁটছি সব দেশ যেমন নারী-পুরুষ ক্রিকেটারদের পাশাপাশি নিয়ে হাঁটছে, আমর্ওা তেমন হাঁটছি। কখনও এক পা এগিয়েছি, কখন্ও বা পিছিয়েছি। তবে বাংলাদশের নারীরা ক্রিকেটের বাইশ গজে খেলছে। সেটা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটাঙ্গনেও পৌঁছেছে। এই অগ্রযাত্রাই বা কম কী?
তা দিয়ে কী সান্ত¡না মিলবে। এটাতো সত্য; পুরুষ ক্রিকেটারদের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি নারী ক্রিকেটারদের জন্য দীনতা প্রকটভাবে ফুঁটে উঠেছে। ধরুন, বাংলাদেশ পুরুষ ক্রিকেট দল যদি ওর্য়াল্ড টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে এভাবে জয়হীন থেকে ফিরে আসে, তবে বোর্ড কর্তা থেকে সাধারণ দর্শক, গণমাধ্যম সবাই মেতে উঠবেন সমালোচনায়। আমাদের নারীদের ব্যর্থতায় আমরা সেভাবে কথা বলিনি। তাহলে কী নারী বলে এদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কোনটাই হলো না! হ্যাঁ, তাই। এখনও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা ওরকমই। নারীরা আর কী খেলবেন! এটা তাচ্ছিল্যের সুর! যেনো তারা হারলে এমন আর কি এসে যায়! অথচ এই নারীরাই যখন কোন ট্রফি জিতে আসেন তখন কিন্তু মাতামাতিটা কম হয় না। আসলে এমনটা কাম্য নয়। পুরুষদের ক্রিকেট নিয়ে আমাদের যতটা মাতামাতি, নারীদের ক্রিকেট নিয়ে ততটা না হলে নারীরা এগুবে কোন উৎসাহে? এখানেই প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই যেমন আজ, বিশ্ব নারী দিবস। কত আয়োজন। কত পুরস্কার। কিন্তু ভেতরটা ফাঁপা। মানসিকতার পরিবর্তন না হলে কোন বিশেষ দিনের বিশেষ আয়োজনে নারী-পুরুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, নাগরিক অধিকার কোন কিছুতেই সমতা আসবে না।
এতকিছুর পরেও এরকম একটা দিনে বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকালে কিছু পরির্বতনের চিহ্ন দেখা যায় । আজ মেলবোর্নে নারী টি-টিয়োন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল ঘিরে শুধু আয়োজনেই সেই পরির্বতন সীমিত থাকছে না। সত্তর-থেকে আশি হাজার দর্শক নারীদের ক্রিকেট দেখতে গ্যালারিতে হাজির হচ্ছেন। টেস্ট ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয়েছিল যেখানে সেই মেলবোর্নে অনুষ্টিত হচ্ছে ফাইনাল। এখানে দুই দুটো বিশ^কাপের ফাইনাল হয়েছে। সেখানেই নারী টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপের ফাইনাল হচ্ছে। সেই ফাইনাল নিয়ে বাড়তি উচ্ছ্বাস শুধু কী তাই স্বাগতিকরা ফাইনাল খেলছে সে কারণেই। কিংবা তাদের প্রতিপক্ষ ক্রিকেট বিশে^র আর এক বড় নাম- ভারত বলে! ভারতীয় নারীরা অবশ্য এবারই প্রথম ফাইনালে খেলছে। এমসিজির গ্যালারি তাই নারী দিবসে পারপল নয়, হয়তো নীল সমুদ্রে রুপ নিতে পারে। তাদের টেক্কা দিতে সবুজ-হলুদের ঢেউ জল্লোস নয়, অজি ‘জনোচ্ছ্বাস’ দেখা যেতে পারে।
বিশ্ব নারী দিবসে বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াঙ্গনের জন্য ভাল কোন বিজ্ঞাপণ হতে পারতো এমন কোন খবর নেই। অন্তত এ বছর। তাই একটা দিনে নারীদের নিয়ে একটু বেশি চিৎকার-চ্যাচামেচি করে কী লাভ! একটা দিন নয়, বছরের ৩৬৫ই শুধু নয় এই লিপ ইয়ারের ৩৬৬ দিন-ই হোক নারীও জন্য। নারী-পুরুষ সবার জন্য। পৃথিবীটা অর্ধেক নারীর বা অর্ধেক পুরুষের নয়, আগামী পৃথিবী হোক শুধুই মানুষের। সেই মানবিক বিকাশ ক্রিকেটারদের মধ্যেও আসতে হবে। নারী-বিশ^কাপের ফাইনালে খেলছেন অ্যাসলে হিলি। তাঁর পাশে থাকার জন্য সাউথ আফ্রিকা সফর থেকে উড়ে এসেছেন তাঁর স্বামী অস্ট্রেলিয়ান জাতীয় দলের তারকা পেসার মিচেল স্টার্ক। সিরিজের শেষ ম্যাচ না খেলে দেশের নারী ক্রিকেটারদের পাশে থাকার জন্য স্ট্রার্কের উড়ে আসার অনুমতি দিতে কিন্তু দ্বিধা করেনি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। কিংবা অস্ট্রেলিয়ান টিম ম্যানেজমেন্ট।
নারী দিবসে নারী টি-টোয়েন্টির ফাইনালে কোন বল বাইশ গজে পড়ার আগেই দারুণ একটা স্ট্রোক খেললেন মিচেল স্টার্ক। নারী বিশ^কাপের বড় এক বিজ্ঞাপণই হয়ে থাকলেন তিনি। পরিবর্তন বুঝি এভাবেই, এই পথেই আসবে।
লেখক: সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।
ক্রিকেট ক্রিকেটারদের বেতস টি-টোয়েন্টি নারী ক্রিকেটের বিশ্বকাপ নারীর সমঅধিকার