কোভিড-১৯: সংক্রামক রোগে মৃতদেহ ব্যবস্থাপনা
২২ মার্চ ২০২০ ১৮:৪০
নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ, এখন যে রোগের স্বীকৃত নাম কোভিড-১৯ (COVID-19), সেটি নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব সবচেয়ে সংকটজনক সময় অতিক্রম করছে। চীনে সর্বপ্রথম পাওয়া এ রোগের প্রকোপ এখন ছড়িয়েছে ১৮৮ টি দেশে এবং এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা পার করেছে তেরো হাজারের সীমারেখা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন দেশ তাদের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছে; এর মধ্যে রয়েছে কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের মতো পদক্ষেপ। অনেকগুলো দেশই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে জনসমাগম নিষিদ্ধ করেছে, জনগণকে ঘরে থাকতে বাধ্য করছে এবং প্রয়োজনে জেল-জরিমানাও করা হচ্ছে। অভূতপূর্ব এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব এখন কেবল রোগজনিত সংকট নয়, বরং মুখোমুখি হয়েছে দীর্ঘকালব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের।
আরেকটি সংকটও বিশ্বের অনেকগুলো দেশকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে, সেটি হচ্ছে কোভিড-১৯ রোগে মৃত ব্যক্তিদের মৃতদেহের সৎকার।
সংক্রামক রোগ, অর্থাৎ ছোঁয়াচে রোগ- এক একটি এক একভাবে ছড়ায়। কোভিড-১৯ রোগ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় হাঁচি- কাশির মাধ্যমে। রোগতত্ত্বের ভাষায় যেটিকে বলা হয় ড্রপলেট ট্রান্সমিশন (droplet transmission)। মৃতদেহ থেকে droplet infection ছড়ানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ, কিন্তু যেহেতু এই করোনা ভাইরাস বাতাসে তিন ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, যারা এই মৃতদেহের সংস্পর্শে আসবেন, তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি- এমনটা বলা যায়।
সংক্রামক রোগ যাতে না ছড়ায়, তার জন্য সচেতনতা তৈরি এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি দেশগুলোকে মৃতদেহ সৎকারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সংক্রামক রোগ, যে রোগে মৃতদেহ থেকেও সংক্রমণ ছড়ানোর উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে, সেসব রোগে মৃত দেহগুলির ব্যবস্থাপনা হতে হবে বিশেষ, যাতে মৃতদেহ থেকে মানবসমাজে সংক্রমণ না ছড়ায়।
আমরা যদি দৃষ্টি ফেরাই পৃথিবীতে আগত মহামারীগুলোর ইতিহাসে, সেখানে শত শত এমনকি হাজার হাজার মৃতদেহের সৎকার কিভাবে করা হয়েছিলো? এ ব্যাপারে প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় চীনে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সে দেশে একটি ব্যাপক আকারের মহামারী হয়েছিলো। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মাটির নিচে একসঙ্গে শত শত দেহাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন- ঐ মহামারীর সময় এক একটি বাড়িতে মৃতদেহ ঢুকিয়ে গোটা বাড়িগুলোই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এ মহামারীর কারণ আজও অজানা।
৪৩০ খ্রিস্টাব্দে গ্রীসে টাইফয়েডে মারা যায় এক লাখেরও বেশি মানুষ। ইতালিতে এবং সাইপ্রাসে ১৬৫ থেকে ১৮০ খ্রিস্টাব্দে প্লেগ রোগে প্রাণহানি ঘটে ৬ লাখেরও বেশি মানুষের। ১৬৬৫ সালে ‘গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’-এ ইংল্যান্ডেও মারা যায় প্রায় ১ লাখ মানুষ। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু-তে পৃথিবীর প্রায় এক চতুর্থাংশ অধিবাসীর মারা যায়। এ সকল মহামারীর সময় মৃতদেহ সৎকারের প্রচলিত নিয়মকানুন মানা যায়নি সঙ্গত কারণেই, কোথাও গণকবর খুঁড়ে শত শত দেহ মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে, কোথাওবা একসাথে দেহগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ঘটে ইবোলা এপিডেমিক, যাতে প্রায় ১১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগে মৃতদের সৎকারের জন্য একটি নির্দেশনা প্রকাশ করে, যেটি অন্যান্য সংক্রামক রোগে মৃত্যুর ক্ষেত্রেও নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। এ নির্দেশনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মৃতের নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ দাফনের জন্য বারোটি ধাপ উল্লেখ করে। এগুলো হলো:
১. মৃতদেহ ব্যবস্থাপনার জন্য দল গঠন ও জীবাণুনাশক প্রস্তুত করতে হবে
২. প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করতে হবে
৩. মৃতের বাড়িতে (অথবা যে হাসপাতালে মৃত্যু, সেখানে) গিয়ে মৃতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দাফনের প্রস্তুতি ও মৃতদেহ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকির ব্যাপারে জানাতে হবে
৪. যে দলটি মৃতদেহ দাফন করবেন, তার সদস্যরা পিপিই (Personal protective equipment) পরিধান করবেন
৫. মৃতদেহ রাখার বিশেষ ব্যাগে মৃতদেহ রাখতে হবে
৬. মৃতদেহের ব্যাগটি কফিনে রাখতে হবে (ধর্মীয় রীতি না থাকলে কফিন ব্যবহার অত্যাবশকীয় নয়) (ব্যাগ অথবা কফিন আর কখনোই খোলা যাবে না)
৭. মৃতের বাড়ির অথবা হাসপাতালের পরিবেশ জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে
৮. বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা নিতে হবে
৯. সমাধিস্থলে মৃতদেহের কফিন অথবা ব্যাগ নিরাপদে নিয়ে যেতে হবে
১০. মৃতদেহের কফিন অথবা ব্যাগ সমাধিস্থ করতে হবে
১১. সমাধিস্থলে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রার্থনার জন্য সময় নির্ধারণ করতে হবে এবং
১২. সকল কার্যক্রমের পর মৃতদেহ ব্যবস্থাপনার দলটি কর্মস্থলে প্রত্যাবর্তন করবেন।
এ নির্দেশনার বিস্তারিত অংশে বলা হয়েছে- মুসলিম ব্যক্তির মৃতদেহের ক্ষেত্রে গোসলের পরিবর্তে পানি ছাড়া অজু করানো যাবে। পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ থাকলে সেলাইবিহীন সাদা সুতি কাপড় কাফনের কাপড় হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ রোগ ছড়িয়েছিলো প্রথম যে দেশটিতে, অর্থাৎ চীনে, সেখানকার ন্যাশনাল হেলথ কমিশন এ বছর ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ একটি নির্দেশনা জারি করে। এতে বলা হয়- কোনো প্রকারের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই কোভিড-১৯ রোগে মৃত ব্যক্তির দেহ দ্রুততম সময়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এজন্য এমনকি মৃতের পরিবারের সম্মতিরও প্রয়োজন হবে না। এই নির্দেশনা যদিও বিতর্কের সৃষ্টি করে। এরকম বিতর্ক ব্রিটেনেও তৈরি হয়েছে ‘ইমার্জেন্সি করোনাভাইরাস বিল’ নিয়ে। আগামী ২৩ মার্চ এ বিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়ার কথা রয়েছে। এ বিল নিয়েও তৈরি হয়েছে বিতর্ক। কারণ এতেও কোভিড-১৯ রোগে মৃত ব্যক্তিদের দেহ পুড়িয়ে ফেলার কথা বলা হয়েছে, যেটি ব্রিটিশ সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক ধর্মের মানুষের ধর্মীয় আচার পালনের যে স্বাধীনতা রয়েছে, তার পরিপন্থী।
আমাদের দেশেও প্রত্যেক ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মৃতদেহের সৎকার করে থাকেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাকে কিছুটা পরিমার্জন করে বাংলাদেশে সংক্রামক রোগে মৃত ব্যক্তির সৎকারের জন্য কিছু নিয়ম পরিমার্জন ও কিছু নিয়ম সংযোজন করা হয়েছে।
সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে এ রোগ বা রোগসমূহে মৃতদেহের বিশেষ ব্যবস্থাপনা বা সৎকার। এটি অন্যান্য সংক্রামক রোগের মতো কোভিড-১৯ রোগের জন্যও প্রযোজ্য। এ রোগের মৃতদেহের নিরাপদ সৎকার রোগটি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হবে- এটা আশা করা যায়। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করছেন, বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন, তাদের দায়িত্ব হবে- মৃতের পরিবারকে কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে মৃতদেহের নিরাপদ সৎকার সম্বন্ধে অবহিত করা, মৃতদেহের মর্যাদাপূর্ণ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং ঝুঁকি এড়িয়ে মৃতের পরিবারকে ধর্মীয় রীতি পালনের সুযোগ করে দেওয়া।
করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মরদেহ ব্যবস্থাপনা মরদেহের সৎকার সংক্রামক রোগ