ডাক্তারদের সুরক্ষা দেবে কে?
২৮ মার্চ ২০২০ ১৫:৩০
শিক্ষার জন্য বর্তমানে মেলবোর্নে অবস্থান করছি। যেখানে প্রশাসনিকভাবে করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য দেশটির হাসপাতালগুলোতে একদিকে যেমন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, ঠিক তেমনি ডাক্তারদের জন্য সময়োপযোগী বিভিন্ন ব্যবস্থা এবং সুবিধা দেওয়া হচ্ছে যেন তারা সাধারণ জনগণকে সর্বোত্তম চেষ্টা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আজকের এ বিষয়টি নিয়ে লিখছি।
করোনাভাইরাস এ বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। চারজন ডাক্তারকে কোয়ারান্টিনে পাঠানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এদেশে রোগ নির্ণয়ের কিট সীমিত, থানকুনি পাতায় করোনা সারার গুজব, হাসপাতালের দুরবস্থা, ডাক্তাররা প্রয়োজনীয় পোশাক না পেলেও অন্যরা পিপিই পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে- ইত্যাদি যখন একের পর এক শোনা যাচ্ছে তখন প্রথম প্রশ্ন থেকে যায়, যারা চিকিৎসা দেবেন সেই ডাক্তাররা সঠিকভাবে সুরক্ষিত হবেন তো?
চীন হয়তো অতি অল্প সময়ে হাসপাতাল তৈরি করতে পেরেছে এবং বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাইরাসটির মোকাবেলা করতে পেরেছে। ইতালিতে ইনটেনসিভ কেয়ারের শয্যাসংখ্যা এবং ভেন্টিলেটরের অভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় 8 লাখ বেড রয়েছে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসার জন্য এবং প্রায় এক লাখের মতো ভেন্টিলেটর রয়েছে। তবুও ধারণা করা হচ্ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করবে। উন্নত দেশগুলোর এই যখন অবস্থা সেখানে আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোর কি অবস্থা? সব দেশেই প্রায় ৭৫ ভাগ উপলব্ধি করছে যে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের অভাব রয়েছে, সেখানে আমাদের তো জনবহুল দেশ। এখানে হাসপাতালের অভাব থাকা স্বাভাবিক হলেও আমাদের মানসিকতার ব্যাপারটাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এই করোনাভাইরাস এর জন্য পৃথিবীর সকল দেশ আজ হুমকির সম্মুখিন। চীনের উহান থেকে যাত্রা শুরু আজ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। WHO একে প্যানডেমিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এখনও আবিষ্কার হয়নি সঠিক প্রতিষেধক। যদিও জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষেধকের কথা বলছে তবে সেগুলো এখনও পরীক্ষাধীন অবস্থায় রয়েছে। এটি যেন মহামারী আকারে ছড়াতে না পারে তাই সব দেশের সরকার সবাইকে ভিড় এড়িয়ে চলতে বলেছে। লোক হয় এমন জায়গা থেকে দূরে থাকতে বলেছে। মুখে মাস্ক পরতে ও পরিষ্কার পরিচ্ছনতা বজায় রাখতে বলা হয়েছে। সব সময় হাত-মুখ পরিষ্কার পানি অথবা সাবান দিয়ে ধুতে বলা হচ্ছে।
যদিও সবকিছু মেনে চলা আমাদের মত উন্নয়নশীল এবং বহু জনসংখ্যা দেশের জন্য কতটুকু সম্ভব তা বর্তমানে পত্র পত্রিকার পাতা খুললেই বোঝা যায়। যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য ছুটি ঘোষণা করেছে। যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা সহজেই আক্রান্ত না হয় এবং তারা যেন বাড়িতে অবস্থান করে। যদিও পত্র-পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই এসব কথা শুনছে না বরং তারা ঘুরতে যাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে কিংবা চায়ের দোকানে ভিড় জমাচ্ছে। এমনকি দেখা যাচ্ছে ছুটির আনন্দে শহর ফাঁকা হচ্ছে ঠিকই তবে ভিড় জমছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। লঞ্চ ট্রেনের ছাদে চড়ে মনের আনন্দে গ্রামে যাচ্ছে ছুটি কাটাতে।
আমরা সবসময়ই সময় থাকতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারিনা। দিন শেষে তড়িঘড়ি করে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাই তখন দেখি সময় প্রায় শেষ। এই করোনাভাইরাসের আবির্ভাব কিন্তু আজ নয় প্রায় তিন থেকে চার মাস আগের। তখন থেকেই যদি আমরা দেশে কীভাবে এটাকে মোকাবেলা করা যায়, হাসপাতালগুলোতে কীভাবে সর্বাধিকসংখ্যক সিটের ব্যবস্থা করা যায় সে বিষয়ে ভাবতাম, তাহলে হয়তো এই মুহূর্তে আমাদের জন্য অনেককিছু সহজ হত।
কিন্তু তখন আমরা ছিলাম পুরোপুরি উদাসীন। যেন কিছুই হয়নি। এমতাবস্থায় আমাদের দেশের ডাক্তারার জাতীয় যেকোন দুর্যোগে যে ভূমিকা পালন করে চলেছেন সেটি অবশ্যই সম্মানের দাবিদার। তাদের সঠিক ঢাল তলোয়ার নেই ঠিকই, এমনকি নেই রোগ প্রতিরোধকারী পোশাক আশাক। রাষ্ট্র তাদের ক্ষেত্রে সে ব্যবস্থা এখনো সঠিকভাবে করে দিতে পারেনি, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। এমনকি এমনও দেখা গেছে কিছুদিন আগে ডেঙ্গুর আবির্ভাবে যখন ডাক্তাররা তাদের জীবন দিয়েও সাধারণ জনগণের জীবন রক্ষা করেছে, দিনরাত পরিচর্যার মাধ্যমে নিজের জীবন বিপন্ন করে অন্যের জীবন বাঁচিয়েছেন- একবারও কিন্তু শোনা যায়নি এই ডাক্তারদের গাড়ি বাড়ি (যা সাধারণত কোন খেলোয়ার, শোবিজ-এর কেউ একটু ভালো করলেই দেওয়া হয়) দিয়ে কিংবা মাসিক বেতন বাড়িয়ে, কিংবা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের সম্মানিত করতে! অথচ এই আমাদেরই একটু পান থেকে চুন খসলে ডাক্তারদের উপর চড়াও হতে সময় লাগে না!
চীনে যেসব ডাক্তাররা দীর্ঘদিন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হাজার হাজার রোগীকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাদের আজ বীরের উপাধি দেওয়া হচ্ছে, সম্মান জানানো হচ্ছে। সেখানে সকল প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে সরকারি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে যেন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যায়। অথচ আমাদের দেশের ডাক্তারেরা সারা গায়ে পলিথিন জড়িয়ে নিজেদের কর্তব্য পালন করছে। তাদের ন্যূনতম জীবনরক্ষাকারী পোশাকের জন্য একের পর এক বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলছেন এবং লিখছেন।
অন্য দেশের জায়গায় আমাদের হয়েছে উল্টোটা। কিছু করার আগেই যেকোনো মহামারীতে আগেই শোনা যায় মোটা অংকের বরাদ্দের কথা। হয়তো সব সময় বরাদ্দ দেয়া হয়, যদিও সব সাধারণ জনগনের টাকা। তবুও সেই বরাদ্দ থেকে সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসা কিনা? হাসপাতালের জন্য সঠিক যন্ত্রাংশ কেনা হচ্ছে কিনা সেগুলো পরে আর জানা যায় না। শোনা যাচ্ছে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চীনের মতো খুব কম সময়ে আমরাও নাকি সেভাবে হাসপাতাল বানাতে পারবো। প্রশ্ন হচ্ছে চীনের মহামারির সময়ে সেভাবেই কম সময়ে আমাদের হাসপাতাল বানাতে হবে কেন? আগে থেকেই এ ব্যবস্থা নেয়া যায়না কেন? এখনি বেশকিছু হাসপাতালকে সেভাবে প্রস্তুত করা যেতে পারে না! এসব হাসপাতাল প্রয়োজনের সময় শুধুমাত্র করোনাভাইরাস নয় বরং অন্যান্য যেকোনো সময় কাজে লাগবে। কেন আমরা এভাবে চিন্তা করতে পারিনা? কেন আমরা আগে থেকেই পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারিনা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে?
আবারও ডাক্তারদের প্রসঙ্গে আসা যাক। ডাক্তার ঠিকমত চিকিৎসা দিচ্ছেন কিনা সে বিষয়ে কথা বলার আগে ভাবুন তাদেরও পরিবার-পরিজন, সন্তান আছে। চিকিৎসা তারা অবশ্যই দেবেন এই অঙ্গীকার নিয়েই তারা এই পেশায় এসেছেন। কিন্তু আপনারা যখন ছুটি কাটাচ্ছেন নিজেদের রোগ মুক্তির আশায়, তখন তারা আপনাদের সেবা করছে আর আপনাদের ভালোমতো চিকিৎসা করার জন্য তাদের সুরক্ষার কি কোন ব্যবস্থা জরুরী নয়? এমনকি অনেক উপজেলা পর্যায়ের ডাক্তারদের ন্যূনতম হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং পরিধেয় পোশাক পর্যন্ত নাই। এখন রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত দেশের প্রত্যেকটি জেলা-উপজেলার সকল পর্যায়ের হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। তা নাহলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির আরও বাড়বে। কারণ, যে শিক্ষকরা আপনাকে শেখাবে তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ না থাকলে তারা শেখাবে কীভাবে? বাংলাদেশের প্রতিটি হাসপাতালে থার্মাল ডিটেকশন ক্যামেরা থাকা সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা সকলেই জানি বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উদারতার অভাব নেই। তিনি দূরদর্শী সম্পন্ন। তার চিন্তার গভীরতার ব্যাপ্তি যথেষ্ট সুদূরপ্রসারি। দেশের জনগণের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা তার রক্তের মধ্যে মিশে আছে, যার উদাহরণ আমরা সব সময় দেখতে পেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে তার চিন্তার সুফল আমরা সেই সময়ে সঠিকভাবে পাব যখন তার চারপাশের নীতিনির্ধারকেরা সুস্থ মন মানসিকতা আর সুপরিকল্পনা নিয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবেন এবং তার বাস্তবায়ন করবেন সাধারণ জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে। শুধুমাত্র লোক দেখানো মতপ্রকাশ, একে অন্যকে দোষারোপ, অমার্জিত বক্তব্য, মোটা অংকের প্রজেক্ট হয়তো সব সময় সুফল বয়ে আনবে না। সময় উপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন হবে আমাদের দেশের জন্য এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি কার্যকর।
লেখক- মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের পিএইচডি গবেষক, অস্ট্রেলিয়া