Wednesday 11 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাভাইরাস: বাস্তবতা বনাম আমাদের ধারণা


২৯ মার্চ ২০২০ ১০:০১

নোভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) নিঃসন্দেহে এ শতাব্দীতে গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম। কোনো ধরণের সামরিক যুদ্ধ নয়, নয় কোনো পারমাণবিক অস্ত্র কিংবা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ; সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের ক্ষুদ্র এক মাইক্রোঅর্গানিজমের কাছে পৃথিবী আজ অসহায়। খালি চোখে দেখা যায় না, অথচ কোনো এক অদৃশ্য শক্তি রূপেই গোটা পৃথিবীকে সে অচল করে দিচ্ছে। বিশ্বের প্রায় সবক’টি দেশ এক হয়েও রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে এ ক্ষুদ্র অণুজীবটির কাছে। এই ভাইরাসটি জন্য সমগ্র পৃথিবী যেন মৃত্যুপুরী। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাসটি আজ অ্যান্টার্টিকা ছাড়া গোটা পৃথিবীতেই বিস্তার লাভ করেছে এবং প্রতিনিয়ত মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।

কী সেই নোভেল করোনাভাইরাস, যা মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে? করোনা শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘ক্রনিক’ থেকে এসেছে। যার সরল বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় দীর্ঘস্থায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাস্টিকসের পরিভাষায় ক্রনিক বলতে সেই সব রোগকে বোঝায় যার প্রভাবে কোনো এক রোগী দীর্ঘ মেয়াদে (ন্যূনতম) কোনো ধরণের শারীরিক জটিলতা ভোগ করে থাকেন; কিন্তু তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় না। ক্রনিক ডিজিস প্রতিরোধে কোনো ধরণের ভ্যাক্সিনও নেই। উদাহরণস্বরূপ আর্থ্রাইটিসকে আমরা ক্রনিক ডিজিসের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। কেননা আর্থ্রাইটিস একটি দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা এবং এখন পর্যন্ত সেই অর্থে আর্থ্রাইটিসের কার্যকরী কোনো চিকিৎসাও নেই। কিন্তু করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনাভাইরাস মানুষের শরীরে সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং মানুষের ফুসফুস এবং অনেক সময় পাকস্থলিতেও বিশেষ ধরণের প্রদাহ সৃষ্টি করে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট রোগের নাম কোভিড-১৯, যার সঠিক চিকিৎসা এখন পর্যন্ত বের করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এই ভাইরাস প্রতিরোধে এখনও কার্যকরী কোনো ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়নি। তাই কোভিড-১৯ কে আমরা বিশেষ ধরণের করোনিক ডিজিস বলতে পারি, যা খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়। যেহেতু এই ভাইরাসের টাইপটি আমাদের সবার কাছে নতুন তাই এ ভাইরাসকে ‘নোভেল করোনাভাইরাস’ অভিহিত করা হয়। আবার যেহেতু এ ভাইরাসটি মানুষের শরীরের শ্বাসতন্ত্রে তীব্রভাবে প্রদাহের সৃষ্টি করে তাই অনেকে একে ‘Severe Acute Respiratory Syndrome’ বা সংক্ষেপে সার্স-২ ভাইরাস নামে অভিহিত করে থাকেন। অন্যভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, করোনাভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছে ইংরেজি শব্দ ‘ক্রাউন’ থেকে। যার বাংলা প্রতিশব্দ ‘মুকুট’। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে এ ভাইরাসটি অনেকটা মুকুটের মতো দেখায় বলে এরকম নামকরণ করা হয়েছে বলে অনেকের দাবি।

আমাদের শরীরে যখন জ্বর আসে তখনই আমরা ধরে নিই যে, আমাদের শরীরে কোনো একটি ইনফেকশন হয়েছে। সাধারণভাবে করোনাভাইরাস যখন মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয় তখন জ্বর আসাটা স্বাভাবিক এবং সেইসঙ্গে সর্দি ও কাশির উপসর্গও দেখা যায়। এ কারণে অনেকে নোভেল করোনাভাইরাসকে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাধারণ কোনো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস যদি সর্বোচ্চ মানের ছোঁয়াচেও হয় তা একজন মানুষ থেকে সর্বোচ্চ বারো জন সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি এক সঙ্গে ২৭ কিংবা ২৮, এমনকি একসঙ্গে ৫৭ জনকেও সংক্রমিত করতে পারেন। জার্মানির একটি বিখ্যাত ইউটিউব চ্যানেল ‘কুর্জটজগেসাগট-ইন অ্যা নাটশেল’ যারা মূলত বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন ভিডিও সম্প্রচার করে, তাদের প্রকাশিত ভিডিও অনুযায়ী করোনা ভাইরাস ছড়ায় মূলত হাঁচি-কাশি অথবা পারস্পরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে। কোনো পৃষ্ঠতলে এ ভাইরাস কতোক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। এমনকি বায়ুবাহিত কোনো মাধ্যমে এ ভাইরাসের জীবনকাল সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা সঠিকভাবে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তারপরও ধারণা করা হয় যে, নাক দিয়ে এ ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। পাশাপাশি এ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত কোনো রোগীর সংস্পর্শে আসার পর যদি আমরা আমাদের শরীরের কোনো অংশ বিশেষ করে চোখ কিংবা নাক অথবা আমাদের মুখ স্পর্শ করি তাহলেও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। করোনাভাইরাস মূলত আমাদের শরীরের শ্বাসতন্ত্র বিশেষ করে অন্ত্র, প্লীহা কিংবা ফুসফুসের ওপর বিশেষভাবে সংবেদনশীল। তবে সম্প্রতি অস্ট্রিয়ার গ্রাজেতে এক মেডিকেল ইনস্টিটিউশনের গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই ভাইরাস আমাদের পাকস্থলিকে সংক্রমিত করতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে জ্বর কিংবা সর্দি-কাশির মতো উপসর্গ নাও দেখা দিতে পারে। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির পেটে ব্যথা এবং পরিপাকজনিত জটিলতার শিকার হতে পারেন। নির্দিষ্ট পোষকদেহের বাইরে এই ভাইরাস জড় এবং নিষ্ক্রিয়। তাই কেবলমাত্র একটি জীবিত কোষে প্রবেশ করলেই ভাইরাস সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে।

আমাদের ফুসফুস কয়েক মিলিয়ন অ্যাপিথিলিয়াল কোষ দ্বারা গঠিত। অ্যাপিথিলিয়াল কোষ মূলত আমাদের শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ ও মিউকাসের বহিরাবরণ হিসেবে কাজ করে। করোনাভাইরাস এই আবরণের একটি নির্দিষ্ট গ্রাহক কোষের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং অন্যান্য ভাইরাসের মতো গতানুগতিক ধারায় তার জেনেটিক উপাদান প্রবেশ করায়; যার প্রভাবে কোষটির ভেতরে এ জেনেটিক উপাদানের অনুলিপি সৃষ্টি হয় ও তা পুনর্বিন্যাসিত হতে থাকে। অচিরেই এ কোষটি মূল ভাইরাসের অসংখ্য অনুলিপিতে ভরে উঠে এবং তা একটি ক্রান্তি পর্যায়ে এসে মূল কোষকে বিদীর্ণ করে বাইরে বের হয়ে আসে এবং আশেপাশের কোষগুলোকে একইভাবে আক্রান্ত করে। এ প্রক্রিয়াকে রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়া বলা হয়। এতে আক্রান্ত কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। দেখা যায় যে, এক সপ্তাহ কিংবা দশ দিনেই এ ভাইরাস আমাদের ফুসফুসের কয়েক মিলিয়ন কোষকে আক্রান্ত করতে পারে যার প্রভাবে আমাদের ফুসফুস কয়েক কোটি ভাইরাসে পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এই সময় আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ্য বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তা তার ইউমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। যখন আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোষগুলো কিংবা আমাদের রক্তে থাকা লিম্ফোসাইট শরীরের ফুসফুসে এসে পৌঁছায় তখন করোনাভাইরাস এসব কিছু কোষকে সংক্রমিত করতে পারে। গোটা পৃথিবীর মানুষ যেভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে-অপরের সঙ্গে যুক্ত, ঠিক তেমনি আমাদের শরীরের বিভিন্ন কোষগুলোও সাইটোকাইনস নামক এক ক্ষুদ্র প্রোটিনের মাধ্যমে একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। তাই প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়াই এর প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে আমাদের এ রোগপ্রতিরোধ কোষগুলো অতিপ্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকে। ফলে কোষগুলোর মাঝে অতিরিক্ত উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় যা আমাদের রোগপ্রতিরোধ কোষগুলোকে লড়াইয়ের উন্মাদনায় ফেলে দেয়।

কিছু কিছু বিজ্ঞানীর মতে, এ উন্মাদনার ফলে মানব মস্তিষ্কের তাপ নিয়ন্ত্রণকারী অংশটি অর্থাৎ হাইপোথ্যালামাস অংশটি উদ্দীপ্ত হয় যার প্রভাবে জ্বর আসে। দুই প্রকারের কোষ এ ধরণের প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যথা: নিউট্রোফিলস, যারা মূলত একইসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আক্রান্ত কোষের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং এক ধরণের অ্যানজাইম নিঃসরণ করে। এই অ্যানজাইমের প্রভাবে আক্রান্ত কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, যদিও এর ফলে কিছু সুস্থ্য কোষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরেক ধরণের প্রতিরক্ষা কোষ হচ্ছে কিলার টি-সেল, যারা মূলত অটোফেগি প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রিতভাবে আক্রান্ত কোষগুলোকে ধ্বংস হওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে এরা এতো বেশি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়ায় যে তারা আশেপাশের সুস্থ্য কোষগুলোকেও আত্মহত্যার জন্য নির্দেশ দেয়। যতো বেশি প্রতিরোধক কোষ ছুটে আসে, ক্ষতির পরিমাণ ততোই বৃদ্ধি পায়। আর তত বেশি সুস্থ্য ফুসফুস টিস্যু তারা মেরে ফেলে। এই প্রক্রিয়া এতটাই গুরুতর হতে পারে যে, মাঝে-মধ্যে ফুসফুসে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। যা ফাইব্রোসিস নামে পরিচিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ আবার তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ফিরে পেতে আরম্ভ করে। যার প্রভাবে সংক্রমিত কোষগুলো মারা যেতে থাকে এবং ভাইরাসে নতুন করে সংক্রমণের সম্ভাবনা নস্যাৎ হতে শুরু করে। যাদের ইমিউন সিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী তাদের অনেকে এ পর্যায়ে এসে সুস্থ্ হয়ে যায়। তবে যাদের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম, বিশেষ করে কারও যদি ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকে অথবা কারও যদি শ্বাসজনিত কোনো সমস্যা থাকে তাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করে। তখন লক্ষ লক্ষ অ্যাপিথেলিয়াল কোষ মারা যায় এবং সেইসঙ্গে ফুসফুসের সুরক্ষাকারী আস্তরণটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে অ্যালভিওলাই অর্থাৎ বাতাসের যে থলির মাধ্যমে আমরা শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে থাকি তা বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়। এতে রোগী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং তাদের শ্বাসকার্যে বিভিন্ন ধরণের জটিলতার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় রোগীর শ্বাসকার্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং তখন কৃত্ৰিম শ্বাস-প্রশ্বাস বা ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। ইতোমধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর হাজার হাজার ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত, এমন সময় লাখো ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ও বংশবিস্তার তার শরীরে নতুন জটিলতার সৃষ্টি করে। অনেক সময় এ সকল ব্যাকটেরিয়া ফুসফুসের প্রাচীরকে ছিন্ন করে রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে। এমনটি ঘটলে মৃত্যু অনেকটাই অনিবার্য।

অস্ট্রিয়ার গ্রাজের মেডিকেল ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, কোনো কোনো সময় ফুসফুসের কোষে এ ভাইরাসটি কাঙ্ক্ষিতভাবে বংশ-বিস্তার ঘটাতে না পারলে তারা পাকস্থলিতে চলে আসে। এবং পাকস্থলি কোষে একইভাবে সংক্রমণ ঘটায়; যার প্রভাবে ডায়ারিয়া কিংবা পাকস্থলিতে বড় ধরণের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই অনেক সময় কোনো ধরণের জ্বর, গলাব্যথা কিংবা সর্দিকাশি ছাড়াই সরাসরি ডায়ারিয়া কিংবা পাকস্থলির কোনো জটিলতাও হতে পারে করোনাভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ।

সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ক্ষেত্রে জ্বর, সর্দিকাশি কিংবা গলাব্যথার পাশাপাশি অন্য কোনো উপসর্গ তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না। আর করোনাভাইরাস যেহেতু একটি আরএনএ ভাইরাস, তাই এর মিউটেশনের হারও অনেক বেশি। এ কারণে ভাইরাসটি দ্রুত তার টাইপ পরিবর্তন করতে পারে। যদিও সব সময়ই যে মিউটেশন অর্থাৎ আরএনএ’র জিনোমের সিক্যুয়েন্সের পরিবর্তন আমাদের জন্য ক্ষতিকারক হবে তেমনটি নয়। আর যেহেতু এ ভাইরাসটি নতুন তাই এ রোগীর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোনো ওষুধ তৈরি হয়নি। যদিও অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসের দেহে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না। তবে অনেকে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় অ্যাজিথ্রোমাইসিনের কথা বললেও সুনির্দিষ্টভাবে এক্ষেত্রে এর কার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যেহেতু কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের সঙ্গে ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়া থাকে তাই সেকেন্ডারি হিসেবে অ্যাজিথ্রোমাইসিন ব্যবহার করা গেলেও একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। কেননা অ্যাজিথ্রোমাইসিন অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক এবং অনেকের শরীরই এ ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক নিতে পারে না। ফলে ক্লোরোকুইনিনের কার্যকারিতা নিয়ে এখনও বিজ্ঞানীরা দ্বিধা-বিভক্ত।

করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের সমাজে বেশকিছু ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন: অনেকেই বলে থাকেন যে, আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন এ ভাইরাস কেবলমাত্র কন্ঠনালী কিংবা গলায় অবস্থান করে এবং এ সময় লেবুর রস, ভিনেগারসহ অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খেলে ভাইরাসটি আর ফুসফুসে আক্রমণ করতে পারে না। কিন্তু এ ধারণাটি ভুল। এটি ঠিক যে, লেবুর রস কিংবা ভিনেগারের জীবাণুনাশক ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু ভাইরাসের লক্ষ্য হলো বংশবৃদ্ধি করা। আর এ কারণে সে চাইবে তার বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত মাধ্যম। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যদি বলি, তাহলে ফুসফুস, প্লীহা কিংবা অন্ত্রে যতটা দ্রুত সম্ভব সংক্রমণ ঘটায়। আবার অনেকে ধারণা করে থাকেন যে, ৮০ দশমিত ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে এ ভাইরাসটি জীবিত থাকতে পারে না। কিন্তু এ ধারণাটিও ভুল। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। যদি তাদের এ দাবি ধারণা সত্যি হয়, তাহলে কোনো মানুষই করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতো না। পাশাপাশি আরও একটি ধারণা আমাদের অনেকের মাঝে প্রচলিত রয়েছে যে কেবলমাত্র ষাট কিংবা সত্তর ঊর্ধ্বদেরই এ ভাইরাসে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। স্লোভেনিয়ায় গত ২৫ মার্চ দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, দেশটিতে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫২৮ জন। এবং এদের একটি বড় অংশের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছর। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ভাইরাসের সংক্রমণে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের একটা অংশের মানুষও মাঝ বয়সী।

কারও শরীরে কোভিড-১৯ ধরা পড়লে তাকে নিয়মিত পরীক্ষা করারও প্রয়োজন নেই। তবে যেটি করা যেতে পারে সেটি হলো, নির্দিষ্ট সময় পর পর তার শরীরে লিম্ফোসাইট এবং ইএসআর পরীক্ষা করা। কেননা কোনো ব্যক্তি কোনো ধরণের ইনফেকশন দ্বারা আক্রান্ত হলে তার শরীরে এমনিতে লিম্ফোসাইট এবং ইএসআর অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এরপর যখন আবার তার শরীরে লিম্ফোসাইট এবং ইএসআরের মাত্রা স্বাভাবিক রেঞ্জে নেমে আসবে সে সময় হয়তোবা আবারও তাকে কোভিড-১৯ এর জন্য পরীক্ষা করা যেতে পারে। কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে শুরু করে একজন রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণা দাবি করছে। যেমন: স্লোভেনিয়ায় প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত করা হয় ৪ মার্চ; কিন্তু ২৬ মার্চ পর্যন্ত কেউ সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফিরেছেন তেমনটি কিন্তু নিশ্চিত করে বলা হয়নি। অস্ট্রিয়া কিংবা ইতালির দিকে লক্ষ্য করলে এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট প্রমাণ পাবেন। যদি আপনি লক্ষ্য করেন যে, দেশ দুটিতে প্রথম কবে কোভিড-১৯ এর রোগী শনাক্ত করা হয়েছিল এবং পাশাপাশি প্রতিদিন নতুন করে কতজন এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং কতজনকে পূর্ণাঙ্গভাবে সুস্থ ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে এ দীর্ঘ সময় মানুষের শরীরের অ্যান্টিবডি ভাইরাস এবং সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করার ফলে শরীর অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ্ মনে হওয়ার পরেও একটি লম্বা সময় পর্যন্ত তাকে অন্য কোনো ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ কিংবা দ্বিতীয়বার করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

আমরা জানি যে, কোনো ভাইরাসের বহিরাবরণ ক্যাপসিড লিপিড এবং প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত যৌগ লিপোপ্রোটিন দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে; যা মূলত একটি অ্যাসিডিক যৌগ। তাই এ ধরণের ভাইরাসের মোকাবিলায় সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত পরিষ্কার করা একটি কার্যকরী সমাধান হতে পারে। সাবান হচ্ছে উচ্চতর ফ্যাটি অ্যাসিডের সোডিয়াম বা পটাশিয়াম লবণ যা সহজে ভাইরাসের বহিরাবরণকে ধ্বংস করে দিতে পারে। পাশাপাশি কোনো ব্যক্তি যদি মনে করেন যে, তিনি করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত, তখন তাকে যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। এবং বেশি করে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার ও ভিনেগার গ্রহণ করতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ এ সময় আমাদের সঙ্গে রাখতে হবে। যেমন: প্যারাসিটামল অথবা কারও যদি শ্বাস-প্রশ্বাসে কোনো সমস্যা থাকে তাহলে সব সময় তার সঙ্গে নেবুলাইজার রাখতে হবে। খুব বেশি জরুরি প্রয়োজন না থাকলে এ সময় কারও বাসা থেকে বের না হওয়াই উত্তম। কারণ করোনাভাইরাস হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। তাই বাহিরে গেলে সব সময় মাস্ক পরতে হবে। সব সময় পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হবে। পরিস্থিতি যদি খারাপের দিকে যায়, তখন নিকটস্থ হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত হ্যান্ড গ্লাভস পড়ার অভ্যাস করতে হবে। কেননা অনেক সময় কোনো বস্তুর পৃষ্ঠতল স্পর্শ করলে তার মাধ্যমেও ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা যখন গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায় এবং রোগী নিজের থেকে নিঃশ্বাস গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন কৃত্রিম শ্বাস অথবা ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যে হারে এ ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সে হারে কোনো দেশে আইসিউ কিংবা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকে না। এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, জার্মানিতে প্রায় আট কোটির মতো লোক বসবাস করে। কিন্তু সেখানে সব মিলিয়ে ভ্যান্টিলেশনের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ৪৮ হাজার। অস্ট্রিয়াতে এ সংখ্যা ৮ হাজারের কাছাকাছি। অর্থাৎ প্রয়োজন অনুপাতে আইসিউ কিংবা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা কোনো দেশেই নেই। এ কারণে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ্পে কন্তেকে বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছে যে, সকল রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সামর্থ্য তার দেশের নেই।

একমাত্র সচেতনতাই পারে আমাদের সকলকে এ রোগের বিস্তার থেকে রক্ষা করতে। তাই নিজেকে সচেতন হতে হবে এবং পাশাপাশি অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সবাইকে সব সময় সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া

করোনাভাইরাস কোভিড-১৯


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর