এ রাষ্ট্রই আমার
৩০ মার্চ ২০২০ ১৬:০২
করোনাভাইরাস সংকটের শেষ কোথায়, তার উত্তর কারও কাছে নেই। বিশ্বের সব সংস্থা, গবেষক টানেলের শেষ আলোটা খুঁজছেন। বাংলাদেশে আমরা খুঁজছি একটা স্বস্তির জায়গা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমরা (বাংলাদেশ) এখন বিপদের মধ্যগগণে। আক্রান্তের হিসাব, আক্রান্ত সময়ের হিসাব, সামাজিক সংক্রমণের মাত্রা— সবকিছুর হিসাব কষে বলা হচ্ছে, সামনে আরও কিছুদিন বিপদ চোখ রাঙাবে। তাই এই সময়টুকু আরও বেশি সাবধানতার।
সরকার কী করছে, সেটা সরকারের হিসাব। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ কী করছি, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শুধু সরকার কোনো দেশেই একা কোনো বড় বিপদ সামলাতে পারে না। আমাদের মতো দেশে তো সেটা আরও অসম্ভব। পায়ে পায়ে নানা সীমাবদ্ধতা।
সেখানেই আশা জাগাচ্ছে অনেক কিছু। প্রথমে আসি মানবিক সহায়তা প্রসঙ্গে। করোনায় লকডাউনে সবচেয়ে বেশি সংকটে দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ। যাদের একদিন পথে না নামলে চুলা জ্বলে না, তাদের জন্য এ এক ঘোর অন্ধকার সময়। একজন রিকশাচালক, পথের ভিখারি, রাস্তার ধারে ঘুমানো মানুষ কিংবা দিনমজুর, যাদের সামনে-পেছনে স্বস্তি নেই, দু’মুঠো অন্ন জোগানোর কেউ নেই, সেই মানুষগুলোর জন্য সংখ্যায় যাই হোক, কিছু মানুষ পথে নেমেছেন। যার যা সাধ্য, হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। দিচ্ছেন নানা ধরনের সহায়তা। কেউ চাল-ডাল জোগাড় করছেন, কেউ স্যানিটাইজার বানাচ্ছেন। কেউ মাস্ক পৌঁছে দিচ্ছেন বিপন্ন মানুষের হাতে। তাদের কেউ নামতে বলেনি। নিজেরাই নেমেছেন।
গত দুই সপ্তাহ ধরে এমন টুকরো টুকরো অনেক ছবিই আমরা দেখছি। ছোট ছোট সংগঠন, কখনো ব্যক্তি— এমন অনেক মানবিক হাত। কেউ রাত জেগে অসহায় মানুষের জন্য ত্রাণ সামগ্রী তৈরি করছেন, কেউ নিজ উদ্যোগে ফিল্ড হাসপাতাল বানাতে চান, কেউ তার প্রতিবেশী দরিদ্র মানুষগুলোকে একমাস খাওয়াতে চান। কেউ তার গৃহকর্মীকে ছুটি দিয়েছেন সবেতন। কিংবা কোনো কোনো বাড়ির মালিক তার ভাড়াটিয়াদের ভাড়া মওকুফ করে দিচ্ছেন বা কমিয়ে দিয়েছেন। উদ্যোগগুলো হয়ত ক্ষুদ্র। কিন্তু এই সংকটে সেই ক্ষুদ্র সহায়তাটুকু যারা পাচ্ছেন, সেটা যে কত বড়, কেবল তারাই সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করছেন।
এই যে হোম কোয়ারেনটাইন নিশ্চিত করা, আইনশৃঙ্খলা— এমন নানাকিছু সামলানোর মধ্যেও হটলাইনে কল পেয়ে বাজার নিয়ে মানুষের দুয়ারে ছুটে যাচ্ছে পুলিশ। হোম কোয়ারেনটাইনে থাকা লোকজনের বাসায় ফল নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বাহিনী। এটাও তো আশা জাগানিয়া মানবিক ছবি! কিংবা সরকারি উদ্যোগ নিশ্চিত হওয়ার আগেই সামর্থ্যের মধ্যে চিকিৎসক বা বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের জন্য পারসোনাল প্রোটেকশন ইক্যুইপমেন্ট বানিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। কেউ ব্যক্তি উদ্যোগেই ব্লিচিং সলিউশন বানিয়ে পরিচ্ছন্ন করছেন এলাকার বাড়িঘর। এসবই মানুষের নির্ভেজাল মানবিতার ছবি।
মানুষকে সামাজিক বা ব্যক্তি দূরত্ব বজায় রাখতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাতে লোক জড়ো হওয়ার সুযোগ নেই। সেই অজুহাতে অনেক জনপ্রতিনিধি ঘরে বসে আছেন। নামছেন না। যাদের ভোট নিয়ে তারা চেয়ারে বসেন, তাদের দুঃখের খবর রাখছেন না। পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। কিছু ব্যতিক্রমও যে নেই, তা নয়। তারা এখনো সংখ্যায় কম। এ কারণে মানুষের দুঃখ আছে। কষ্ট আছে। সেই কষ্টটাকেই আশার আলোয় রাঙাচ্ছেন কিছু মানবিক মানুষ। কিছু মানবিক হাত। কিছু মানবিক সংগঠন-সংস্থা।
টানা ছুটি ঘোষণার পর পরিবহন জংশনগুলোতে জনস্রোত, হোম কোয়ারেনটাইনের নির্দেশনা না মানা, জনসমাগমে পরিহারের পরামর্শ উপেক্ষা করা— এসব হতাশার বিপরীতে দেখুন, অনেক গ্রাম নিজেরাই লকডাউন করে দিয়েছেন স্থানীয়রা, শুধু সংক্রমণ ঠেকাতে। পুলিশ বা প্রশাসনের কর্মকর্তারাই বলছেন, অনেক এলাকায় যেসব প্রবাসী কোয়ারেনটাইন মানছেন না, সেই তথ্যও স্থানীয়রা জানিয়ে দিচ্ছেন। এখন সবকিছু বন্ধ। কিছু কিছু উদাহরণ বাদ দিলে বেশিরভাগ মানুষই তা মানছেন। কষ্ট হলেও মানছেন। এগুলোও কী কম ইতিবাচক! তার মানে মানুষ ধীরে ধীরে হলেও সচেতন হচ্ছে। আতঙ্ককে জয় করার চেষ্টা করছে।
এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে, যা গুচ্ছবন্দি করলে এমন একটা বুকভরা আশার বাংলাদেশের ছবি দাঁড়ায়, যেটা সত্যিকারের মানবিক বাংলাদেশের ছবি। এটা সত্যিকারের রাষ্ট্র বাংলাদেশের ছবি, যা আমরা সব সংকটে দেখি। বন্যায়, খরায়, সাইক্লোনে, মহামারিতে এই ছবিই বড় হয়ে ওঠে। নানা অনিয়মের বেড়াজালে যেখানে রোজ আমরা দেশকে গালি দেই, নিজেদের সমালোচনায় মুখর থাকি, সেখানে বারবার সুড়ঙ্গের শেষ আলোর মতো খড়কুটো খুঁজি। নেতিবাচক সব সরিয়ে একটু ভালো খুঁজি। পেয়েও যাই। এ কারণেই বাংলাদেশ সব সংকটে জেতে। সব সংকট কাটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এবারও উঠে দাঁড়াবে। হাতে হাত রেখে মানবিক বন্ধনে সব আধার কেটে যাবে। কারণ, এটাই আমার মানবিক রাষ্ট্র-বাংলাদেশ। মানবিক মানুষগুলোকে টুপিখোলা অভিবাদন।
লেখক: রিজিওনাল এডিটর, চ্যানেল ২৪