মহামারিতে মসজিদে জড়ো হওয়া ইসলামের শিক্ষা নয়
২ এপ্রিল ২০২০ ২০:৫৭
মহামারির সঙ্গে মুসলমানদের পরিচয় নতুন নয়। ১৮শ হিজরি থেকে শুরু করে ৭৪৯ বা ৮৩৩ হিজরিতে প্লেগের আক্রমণে মারা গেছেন বহু মুসলিম। ইতিহাস জানায়, ২১৯ হিজরিতে প্লেগের আক্রমণে গোটা মিশর প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এমন কোনো বাড়ি ছিল না, যেটি আক্রান্ত হয়নি। ২২৮ হিজরিতে আজারবাইজানে প্লেগের আক্রমণে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল যে সবার দাফনের জন্য পর্যাপ্ত কাফন পর্যন্ত ছিল না। ৪০৬ হিজরিতে প্লেগের আক্রমণে বসরার গোরস্থানে আর স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। এমনও হয়েছিল যে পরিবারের সবাই মারা গেছেন। পাড়া-প্রতিবেশীদের খবর দেওয়ারও কেউ নেই। রাস্তাঘাটে পড়েছিল মরদেহ।
এরপর ৪৪৮ হিজরির ভয়াবহ মহামারি নিয়ে লিখতে গিয়ে ইমাম আদ দাহাবি (রহ.) লিখেছিলেন, মিশর আর আন্দালুসে এমন এক প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল যা মানুষ আগে কখনো দেখেনি। এ এমন এক ভয়াবহ দুর্যোগ ছিল যে কোনো মুসল্লি না থাকার কারণে মসজিদগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ৭৭৯ হিজরিতে আল মাক্বরিজি লিখেছেন, এ এক এমন ভয়াবহ মহামারি ছিল যে মসজিদগুলোতে আজান দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। বেশিরভাগ মসজিদই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় একই সময়ে প্লেগের ভয়াবহতায় সিরিয়ার দামেস্ক শহর ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মুরব্বিরা সিদ্ধান্ত নিলেন, শহরের বাইরে গিয়ে সবাই জমায়েত হয়ে সম্মিলিতভাবে দোয়া করবেন। কিন্তু এর ফল হলো ভয়াবহ। আরও দ্রুত ছড়াতে শুরু করল প্লেগ। মৃত্যুহার বেড়ে গেল জ্যামিতিক হারে।
৮৩৩ হিজরির কায়রো। শহরের প্লেগের প্রাদুর্ভাবে দিনে ৪০ জনের মতো মারা যাচ্ছেন। শহরের লোকজন ঠিক করলেন, শহরের বাইরে সবাইকে নিয়ে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করবেন। আমাদের দেশে কিছুদিন আগে লক্ষ্মীপুরে হয়ে যাওয়া ‘দোয়ায়ে শিফা’ যেমন ছিল, অনেকটা তেমনি। এরপর সপ্তাহ না ঘুরতেই ৪০ জন ছাড়িয়ে দিনে হাজারের বেশি মানুষ মারা যেতে শুরু করলেন।
মহামারি প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, ‘এমন সময়ে তোমরা অসুস্থকে সুস্থদের মধ্যে মিলিয়ে ফেলবে না।’ কিন্তু আবেগতাড়িত হয়ে সেই সময়ের মানুষরা রাসুলাল্লাহর (সা.) শিক্ষা ভুলে এমন কাজ করেছিলেন, যা রোগের সংক্রমণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
হিজরি ১৮ সালে মুসলিমরা বাইজেন্টাইন রোমানদের সাথে লড়াই করছিল। উমর ইবন আল-খাত্তাব (রা.) তখন আমিরুল মুমিনিন, খিলাফায়ে রাশেদিনের দ্বিতীয় খলিফা। সেই সময় ইমাউস প্লেগ নামে রোগের প্রাদুর্ভাব হয় সিরিয়ায়। প্রায় ২৫ হাজার মুসলিম এতে শহিদ হয়েছিলেন। আক্রান্তদের মধ্যে মুয়াজ ইবন জাবাল (রা.), আবু উবাদাহ আমির ইবন আল-জাররাহ’র (রা.) মতো বিখ্যাত সাহাবিরাও ছিলেন।
অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবির ইন্তেকালের পর প্লেগ উপদ্রুত জনপদে মুসলিমদের নেতা আমর ইবন আল-আস (রা.) সবাইকে ডেকে বললেন, ‘মনে রাখবে, প্লেগ আগুনের মতো। সবাই একসঙ্গে থাকলে তা সবাইকে ধ্বংস করে দেবে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলে সবাইকে ধ্বংস করতে পারবে না।’ তিনি সবাইকে আদেশ দিলেন জনপদ ছেড়ে পাহাড়ে বা উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়তে।
আমর ইবন আল-আস’র (রা.) এই আদেশ শুনে একজন সাহাবি ভাবলেন, এ তো দুর্বল ঈমানের লক্ষণ। কাপুরুষের মতো সিদ্ধান্ত। সাহাবি এর প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আমি রাসুলাল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গী ছিলাম। আল্লাহর কসম, আপনি ভুল করছেন। আপনি আমার গাধার চাইতেও বেশি বিভ্রান্ত।’ স্থিতধী আমর ইবন আল-আস এমন অপমানের পরেও ক্রুদ্ধ হলেন না। শুধু বললেন, ‘আমি আপনার উত্তর দিয়ে আপনার কথাকে মহীয়ান করব না। আপনাকে শাস্তিও দেবো না।’ সে সময়কার মুসলমানেরা আমরের আদেশ পালন করেছিলেন।
দুর্যোগের সময় আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া ইসলামের শিক্ষা নয়। বরং ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় মাথা খাটিয়ে বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত নিতে। প্লেগের সময় পাহাড়ে আর উপত্যকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুসলিমরা নিশ্চয়ই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েননি। উপরন্তু তীব্র অপমানজনক সমালোচনার পরও মুসলমানদের নেতা আবেগতাড়িত না হয়ে সবার জন্য যেটা মঙ্গলজনক সেই সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী করোনা তাণ্ডবের এই সময়ে ভারতের দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় একটি মসজিদে তবলিগের জমায়েতের পর ২৪ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছেন। মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে সাতে পৌঁছেছে। ১৩ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত দিল্লিতে দেশটির তাবলিগ-ই-জামাতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় মারকাজ নিজামুদ্দিনে প্রায় দুই হাজার মানুষ একসঙ্গে অবস্থান করেন। এরপর এ ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানে তবলীগ জামাতের মারকাজে ২৭ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত। মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ হয়েছে তবলীগ জামাতের একটি ইজতেমা থেকে।
ঢাকায় প্রথম করোনায় মৃত্যু হয়েছে খুব সম্ভবত মিরপুরে। যে দু’জন ইন্তেকাল করেছেন, তারা খুব সম্ভবত মসজিদে পরস্পরের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। এভাবেই সংক্রামক রোগের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়। ৭৪৯ বা ৮৩৩ হিজরির প্লেগে গুটিকয়েক মুসলমানরা আবেগতাড়িত হয়ে শহরের বাইরে গিয়ে দুয়ায়ে শিফার আয়োজন করেছিলেন। এর পর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমরাও আল্লাহ’র রাসুল (সা.)-এর সাহাবিদের চেয়েও বড় আর সহিহ মুসলিম হয়ে গেলে একই পরিণতির সম্মুখীন হব। ইসলাম নির্বুদ্ধিতা সমর্থন করে না। সুরাহ বাক্বারায় আল্লাহ স্পষ্ট নিজেদের ধ্বংস করতে বা ধ্বংসাত্মক কাজ করতে নিষেধ করেছেন।
মহামারির সময়ে মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য মিছিল করার মধ্যে নির্বোধের আবেগ থাকতে পারে, ইসলামের জ্ঞান নেই। যেই আলেম তার জামাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেন, তার জ্ঞান সেই লোকটির মতো, যিনি আমর ইবন আল-আস’কে (রা.) গালাগাল করেছিলেন।
কমিউনিটি সংক্রমণ রুখতে হলে সব ধরনের কমিউনিটি সমাবেশ বন্ধ করতেই হবে। এরই মধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। বিপণী কেন্দ্র বন্ধ হয়েছে। মুজিববর্ষের সব অনুষ্ঠান স্থগিত হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের সমাবেশ বন্ধ হয়েছে। পহেলা বৈশাখের সব সমাবেশ স্থগিত হয়েছে। কিন্তু সব নির্দেশনার পরও ধর্মীয় সমাবেশ কি বন্ধ হয়েছে? লকডাউনের মধ্যেও সারাদেশে পাকিস্তানের অনুকরণে একযোগে মাঝরাতে আজান দিয়ে বিভিন্ন গুজবের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। প্রতিনিয়ত এই ভাইরাসটিকে ‘মুসলিমবান্ধব’ বলে প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। অথচ ইসলাম কখনোই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর শিক্ষা দেয়নি।
মহান আল্লাহ তায়ালা সারাপৃথিবীকে মুসলিমদের মসাল্লা বানিয়েছেন। দুর্যোগের সময় সাহাবারা যা করেছিলেন, আসুন আমরাও তাই করি। তারাই ইসলামকে সবচেয়ে ভালো বুঝতেন। যারা ধর্মের নামে মানুষকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করছে, তাদের দরকার হলে কোয়ারেনটাইনে রাখুন। ধর্ম নিয়ে, মানুষের আবেগ নিয়ে নিজেদের পকেট ভরার সময় এটা নয়। দয়া করে আপনাদের সৃষ্টি করা বিভ্রান্তি ধর্মজ্ঞান আর ধর্ম ব্যাবসার জন্য সাধারণ মুসলিমদের মৃত্যুর মুখে ফেলবেন না। দেশের নেতারা আর ধর্মগুরুরা বোধহীন অমানুষের মতো কথা বলতে শুরু করলে আশার শেষ আলোটাও নিভে যায়। আলো নেভার আগেই দয়া করে এই পাগলামি বন্ধ করুন।
আজ যদি আমরা একটু সতর্ক হই, নিজেদের আবেগের ওপর রাসুলাল্লাহ (সা.) উপদেশকে অগ্রাধিকার দেই, তবে হয়তো এই ভয়ংকর পরিণতি থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাজত করবেন। আসুন, আবেগতাড়িত না হয়ে বাড়িতে বসেই আল্লাহর সাহায্য চাই। আমাদের পূর্বজ আর রাসুলুল্লাহর সাহাবিদের জীবন থেকে আমরা শিক্ষা নেই।
মুসল্লির অভাবে মসজিদগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই নিজেদের হেফাজত করি, যেন আমাদের সাময়িক ত্যাগ মসজিদগুলোকে, আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করে। এমন যেন না হয়, আমাদের পরের প্রজন্ম আল্লাহকেই ভুলে যাবে এই ভেবে যে ধর্ম আমাদের এমন অন্ধ করে দিয়েছিল যে আমরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলেছি। ইসলাম যা শেখায় না, তার মধ্যে আবেগ থাকলেও কল্যাণ নেই।
আর এভাবে ধর্মকে প্রচলিত বোধবুদ্ধির বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর বিপদ করোনাভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহ। এটা ধর্মীয় শিক্ষার একদম বিপরীত। এই দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী ধর্মপ্রাণ, কিন্তু ধর্মশিক্ষা বর্জিত। শিক্ষার এই অভাব তাদের ধর্মের ব্যাপারে আবেগপ্রবণ করে, ধর্ম পালন করার ব্যাপারে নয়। তাতে ধর্মের নামে অধর্মটাই হয় বেশি। এর ফায়দা নেয় ধর্মব্যবসায়ী আর ক্ষমতা ব্যবসায়ীরা। আর দুর্যোগের সময় এর প্রভাব হয় ভয়াবহ। মানুষ তার স্বাভাবিক চিন্তা, বোধবুদ্ধিকে অগ্রাহ্য করতে শুরু করে।
সারাবিশ্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও আমাদের কিছু হবে না— এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপজ্জনক ধারণা। এই ধারণা আপনার ঈমানের শক্তির প্রমাণ দেয় না, আপনার নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়। ওহুদের যুদ্ধে রাসুলাল্লাহ (সা.) আহত হয়েছিলেন, একই যুদ্ধে তার চাচা হামজাহ (রা.) নিহত হয়েছেন। জীবিত অবস্থায় জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া আবু উবায়দাহ আজ-জাররাহ (রা.) নিহত হয়েছেন প্লেগে। একই প্লেগে নিহত হয়েছেন রাসুলাল্লাহ (সা.)-এর অত্যন্ত প্রিয় সাহাবি মুআজ ইবন জাবাল (রা.)। উমর ইবন আল খাত্তাব (রা.) নিহত হয়েছিলেন আততায়ীর হাতে মসজিদে নববিতে ফজরের নামাজের ইমামতি করার সময়। বিপদ থেকে আমরা কেউই নিরাপদ নই। বিপদের সঙ্গে আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের কোনো সম্পর্কও নেই। যেই বিপদ আপনাকে আল্লাহ’র কাছে নিয়ে আসে, সেটা আপনার জন্য আশীর্বাদ। আর যেই বিপদ আপনাকে রাসুলাল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা ভুলিয়ে নিজেকে ও পুরো সমাজকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়, সেই বিপদ আপনার জন্য আজাব।
বিপদে বুদ্ধি হারানো খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। কিন্তু বুদ্ধি হারিয়ে এমন কাজ করা যে আমাদের শারিরীক ও আধ্যাত্মিক ক্ষতি হবে, এমনটা মোটেও কাজের কথা নয়। আজ থেকে ৭০০ বছর আগের মানুষরা হয়তো না জেনে নিজেদের বড় ক্ষতি করে ফেলেছেন। কিন্তু আমরা তো জানি। বুঝি অনেকটাই। তারপরেও কেন এমন হঠকারিতা?
ইসলাম ধর্মের নামে নির্বোধের মতো আচরণকে সমর্থন করে না। অতি আবেগ মানেই সেটা ধার্মিকের লক্ষণ নয়। মানুষের আধ্যাত্মিক ও শারীরিক বিপদ হয়— এমন কাজ করা মুসলিমের জন্য হারাম, এমনকি সেটা ইসলামের নামে করা হলেও।
দয়া করে যা শুনেছেন, শুনছেন— তা যাচাই-বাছাই না করে ছড়াবেন না। মনে রাখবেন, ইসলামে গুজব ছড়ানোও হারাম। বিপদে বুদ্ধি হারিয়ে নিজের ও অন্যের ক্ষতি হয়— এমন কাজ করবেন না। কারণ ইসলামে নিজের ও অন্যের ক্ষতি করাও হারাম। দয়া করে ধর্মের নামে মনগড়া নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রচার করবেন না। ইসলাম এই অভ্যাসকে বর্জন করে এবং এর কঠিন পরিণতির বিষয়ে মুসলমানদের বারবার সাবধান করে দিয়েছে। আসুন আমরা তাই করি যাতে মানুষের কল্যাণ হয়। ধর্মের কল্যাণ হয়।
আমাদের জীবদ্দশায় মুসলিমরা এর চেয়ে বড় আধ্যাত্মিক সংকটে পড়েছিল কি না, আমার জানা নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো এতোটা হতবিহ্বল আর হতোদ্যম বোধ করিনি। একজন শিশুকে তার মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে যেমন বোধ হয়, একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিমকে মসজিদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে সেও একই রকম অসহায় বোধ করে। সারা পৃথিবীতে আজ একটার পর একটা মসজিদ বন্ধ হচ্ছে। করে দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশে জুমার নামাজ হলেও মসজিদে নববি আজ বন্ধ। কী যে অদ্ভূত অপার্থিব তীব্র এক যন্ত্রণা! কোনো শত্রুর আক্রমণে নয়, কোনো শাসকের রোষানলের জন্য নয়, আমাদের নিজেদের রক্ষার জন্য আজ নিজেদের সবচেয়ে আরাধ্য আর নিরাপদ জায়গাটাও বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। আল্লাহর ইশারার সামনে কী অসহায় আমরা।
বাংলাদেশের প্রতিটি মুসলিমকে যদি এই ভয়াবহ মহামারি থেকে রক্ষা করতে হয়, আমাদেরও এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিপদের সময় এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়াই রাসুলাল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা। আমাদের সমাজ, প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত আমাদের অগ্রজ প্রজন্মরা নিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের প্রজন্মকে রক্ষা করতে নিশ্চয়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার শক্তি আমাদের দেবেন।
যত যৌক্তিকই হোক, মসজিদে না যেতে পারার বেদনা প্রতি মুহূর্তে হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ হবে। এই রক্তক্ষরণের মধ্যেও কঠিন ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক, যেন প্রতিটি মুসলিম আল্লাহ’র ইচ্ছায় নিরাপদ থাকতে পারেন এবং সমাজের সব মানুষকে নিরাপদ রাখতে পারেন।
আল্লাহ’র ওয়াস্তে বাড়িতে থাকুন। আসুন আমাদের বাড়িগুলোকে মসজিদ বানিয়ে নেই আপাতত। বাড়ির দেয়ালগুলো আল্লাহ’র জিকিরে মজবুত হোক। বাড়ির প্রতিটি কক্ষ পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক। আমাদের ঈমান আমাদের রবের ওপর বিশ্বাস এবং নির্ভরতায় পরিপূর্ণ হোক। এই দুর্যোগ ক্ষণস্থায়ী হোক। আল্লাহ’র সাহায্য প্রার্থনা করুন, নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে নিরাপদে রাখুন। সম্ভব হলে দান করুন। যাদের কাজে যেতেই হয়, তাদের সাহায্য করুন যেন তারাও বাড়ি থাকতে পারেন। আপনার পরিবারের যে সদস্য, যে আত্মীয়, যে প্রতিবেশী, যে বন্ধু চক্ষুলজ্জায় সাহায্য চাইতে পারছেন না, তাদের আত্মসম্মানে আঘাত না দিয়ে তাদের সাহায্য করুন।
বিপদের সময় যদি আমরা ধর্মের দোহাই দিয়ে নির্বোধের মত আচরণ করি, আমাদের সন্তানরা ধর্মকেই আমাদের নির্বুদ্ধিতার কারণ মনে করে ধর্ম থেকে দূরে সরে যাবে। আপনি যদি ধর্মভীরু মুসলমান হোন, আপনি নিজেকে কী করে ক্ষমা করবেন— যদি আপনি বেঁচে থাকেন আর আর সন্তান ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় আপনার হঠকারী, আবেগতাড়িত এই সিদ্ধান্তের জন্য?
লেখক: সমাজকর্মী