‘টেস্ট’ আর ‘লিস্ট’; দুইয়ের সমন্বয়ে লড়ব করোনাযুদ্ধ
৬ এপ্রিল ২০২০ ১২:১৩
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরামর্শ দিয়েছে, প্রতিটি দেশে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সনাক্তে টেস্ট বা রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষার পরিমাণ বাড়াতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে “টেস্ট টেস্ট টেস্ট” আমরা করতে পারিনি অনেকদিন। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, আইইডিসিআর প্রক্রিয়াগত দিক থেকে ঠিক পথ অনুসরণ করেছে। তবে সমস্যা একটা হয়েছে বটে। বিভাগীয় পর্যায়ে টেস্টিং এর সুবিধা পৌঁছাতে আমাদের বেশ কিছুটা সময় লেগে গেছে।
করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার হারে আমরা বিশ্বে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সর্বনিম্ন (প্রতিদিন গড়ে ১০টি টেস্ট)। তবে যা-ই হোক, এখন বিভাগীয় পর্যায়ে কিছু টেস্টিং সেন্টার খোলা হয়েছে। পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য টেস্টের পরিধি আরো বাড়ানো হবে বলে জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তরফ থেকে।
আশার কথা হলো, ৩ এপ্রিলে ৫৫৩টি স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে। আগের তুলনায় বেশ দ্রুতই! কিছু ব্যাপার আছে, কখনোই না হওয়া থেকে অন্তত দেরিতে হওয়া ভালো। এক্ষেত্রে না হয় আমরা সেটিই মেনে নিই। তবু খেয়াল রাখতে হবে, রোগের তীব্রতা অনুযায়ী যেন পরীক্ষার এলাকাভিত্তিক বরাদ্দের ঘাটতি না হয়।
অন্যদিকে করোনার আঘাত শুধু রোগী বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর আসেনি, এসেছে দরিদ্রদের পেটেও। সীমিত অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কারণে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপকহারে কমে গেছে। খাদ্য আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারছেন না দেশের ছয় কোটি দিনমজুরের একটা বড় অংশ। বিপদে পড়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতের নিয়োজিত দেশের ৮৫ শতাংশের বেশি শ্রমিকের উপর নির্ভরশীল পরিবারসমূহ।
করোনাভাইরাসের কারনে অর্থনৈতিক এই প্রকোপ সামলাতে সরকারী সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর বাড়ানো হয়েছে। খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি, ভিজিডি ও ভিজিএফ এর মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ের আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি নগর পর্যায়ে দরিদ্রদের জন্য বাড়ানো হচ্ছে ন্যায্যমুল্যে ও এমএস চাল বিক্রির পরিধি। যদিও এই মুহূর্তে সামনের তিন মাসের কথা বিবেচনা করলে শুধু খাদ্য সহায়তা যথেষ্ঠ নয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর তথ্য মতে, দেশে নিম্ন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১২.৯ শতাংশ (প্রায় তিন কোটি)। মনে রাখা দরকার, এই মুহূর্তে দারিদ্রসীমার উচ্চ রেখার নিচে অবস্থান করা সবাই (২৪.৩ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে চার কোটি) খাদ্য ও আয়ের ঝুঁকির মুখে রয়েছেন।
পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে আর এনজিওগুলোর মাধ্যমে ত্রাণ ও অর্থ বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুরুর দিকে তাদের কার্যক্রম বেশ সুন্দরভাবে চললেও এখন বেসরকারি উদ্যোগকে চাহিদা মেটাতে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিতরণের স্থানে নিরাপত্তাকর্মী না থাকলে অনেক ক্ষেত্রে হইচই হচ্ছে। ত্রাণ হাতে না পেয়ে আফসোস নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন দূর থেকে আসা দরিদ্র রিকশাওয়ালা, ভিখারি, বয়স্ক আর প্রতিবন্ধি নারী-পুরুষ। অভাবের তাড়নায় আর ত্রাণের আশায় হুড়োহুড়ি করতে থাকা মানুষের কারণে কিছু জায়গায় ভীষণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও হাহাকার শুরু হচ্ছে। এই মহৎ উদ্যোগগুলোর ইতিবাচক উদ্দেশ্য নিয়ে কোন সংশয় নেই কিন্তু এরূপ পরিস্থিতি এই অভাবের মুহূর্তে খুবই স্বাভাবিক। প্রশংসনীয় ব্যাপার হল, বেসরকারি এইসব উদ্যোগকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বাগত জানিয়ে অনুমতিপূর্বক বিতরণের কথা বলা হয়েছে। এতে নিরাপত্তাজনিত শংকা ও সুবিধাপ্রাপ্তির পুনরাবৃত্তি কমে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
কিন্তু আশংকার কথা হচ্ছে এখনও নগর পর্যায়ের দরিদ্রদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই। তাই বহু জায়গায় ট্রাকে করে চলছে ত্রাণ বিতরণ- যা করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিবেচনায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
করোনাভাইরাস নিয়ে ইসরায়েলি লেখক ও চিন্তাবিদ ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি সম্প্রতি বলেছেন, ‘এখন এমন সব কাজ আমাদের দ্রুততার সাথে কয়েকদিনের মধ্যে করতে হবে, যা স্বাভাবিক সময়ে করতে কয়েক বছর লেগে যেত’(ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, মার্চ ২০২০)। বাংলাদেশেও এই মুহূর্তে এই তালিকা তৈরিতে এমন কিছু সমন্বয় প্রয়োজন, যা পূর্বে বাস্তবায়ন করতে বেশ বেগে পেতে হত। খুব দ্রুত কর্মসূচি গ্রহন করতে হবে আর কাজ পরিচালনায় শৃঙ্খলা আনতে হবে।
প্রথমত, নগর পর্যায়ের হতদরিদ্র ও বর্তমান পরিস্থিতিতে অভাবে থাকা ব্যক্তিদের তালিকাটি দ্রুত শেষ করা দরকার। নগর পর্যায়ের ১৮.৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্র (উচ্চ দারিদ্র্যসীমায় অবস্থান করে: বিবিএস, ২০১৬) এদের একটা বড় অংশ ভাসমান হওয়ায় তালিকা করার কাজটি ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। তাই সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তালিকা প্রস্তুতের কাজটি এখনও ধীরগতিতে চলছে। জেলা প্রশাসন, সংসদ সদস্যের কার্যালয়, উপজেলা/থানা প্রশাসন আর নেতৃবৃন্দ, ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিশনার আর রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় এই তালিকা দ্রুত তৈরি করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, বড় এনজিওগুলোর কাছ থেকে তাদের নগরভিত্তিক দারিদ্র্য-বিমোচন কর্মসূচির অভাবীদের তালিকা সংগ্রহ করতে হবে। এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে সরকারকে সহযোগিতা করা খুব জরুরি।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের তথ্যমতে, ব্র্যাক এরই মধ্যে অন্যান্য ব্যক্তিপর্যায়ের সাহায্য-উদ্যোগগুলোকে তাদের ‘নগর দারিদ্র্য-বিমোচন কর্মসূচি’ থেকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে । ব্র্যাকসহ অন্যান্য এনজিওগুলোকেও সরকারের সাথে এরকম তালিকাগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ভাগাভাগি করতে হবে।
তৃতীয়ত, সাময়িক স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগগুলোও গত একমাসে অসহায় গোষ্ঠীর এলাকা চিহ্নিত করেছে। তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা ও সহযোগিতা নিতে পারে স্থানীয় প্রশাসন, যার মাধ্যমে তালিকা প্রণয়নের কাজটিতে গতি আনা সম্ভব। তাছাড়া, অতিসত্ত্বর এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো নিয়ে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করে অভাবীদের একটি সম্মিলিত তালিকা প্রস্তুত করা প্রয়োজন। দেখা যাচ্ছে, একই পরিবারের দুই-তিনজন সদস্য ত্রাণ নিচ্ছেন। এই ঘটনায় বাকি অভাবী ব্যক্তি ও পরিবার বঞ্চিত হতে পারে।
যেসব এলাকায় সরকারি সহযোগিতা অপ্রতুল মনে হচ্ছে, সেসব এলাকা চিহ্নিত করে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে কার্যক্রম পরিচালনা করলে তাদের কাজ আরও ফলপ্রসূ হবে। ধনী ও অবস্থাসম্পন্নদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ আরো জোরদার করে এলাকাগুলোতে পরিবারভিত্তিক বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত।
এই মূহুর্তে সম্মিলিত ডাটাবেইজের মাধ্যমে কাজটি করা সম্ভব। শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি এনজিওকে নেতৃত্ব দিতে হবে এই ডাটাবেইজ তৈরির প্রক্রিয়াতে। কষ্ট হলেও মানতে হবে, এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষে সকল দরিদ্রকে কয়েকমাস ব্যাপী সাহায্য করা কঠিন হতে পারে। তাই বেসরকারি উদ্যোগগুলো স্বল্পকালীন ও মধ্যমকালীন সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে।
চতুর্থত, মনে রাখতে হবে, এই তালিকার মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উপযোগিতা রয়েছে। কয়েকমাস ধরে একই দরিদ্র পরিবারকে খাবার এবং অর্থ সরবরাহ করতে হবে। তাই তালিকায় সুবিধাভোগী ট্রেসিং বা চিহ্নিত করতে তাদের এনআইডি নম্বর, ফোন নম্বর (যদি থাকে) সংগ্রহ করা প্রয়োজন বা কোন সাময়িক কার্ড প্রদান করা প্রয়োজন। কিছু জেলায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিন্তু পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে। বলা হয়েছে, ওএমএস চাল ক্রয়ের সময় এনআইডি দেখাতে হবে। একই পরিবারের তিন-চারজন প্রাপ্তবয়স্ক যদি এনআইডি কার্ড দেখায়, তাহলে কিভাবে সমাধান হবে?
এ ও মনে রাখতে হবে, এই অভাবের সময় ধনীরা যেরকম খাদ্য মজুদ করছে, সামনের কয়মাসের অনিশ্চয়তার শংকায় দরিদ্ররাও সে কাজ করতে পারেন। তাই পরিবারভিত্তিক ভাবে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। গ্রাম পর্যায়ের প্রায় ৭০ লক্ষ হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনায় “ট্রেসিং” পদ্ধতি এরই মধ্যে অনেকটাই সফল হয়েছে। নগর পর্যায়ে বাড়তি খেয়াল রাখতে হবে, ছিন্নমূল পথশিশু, প্রতিবন্ধি, রাস্তায়-ফুটপাথে বসবাসরত ভাসমান গোষ্ঠী যেন বাদ না পড়ে। এদের অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেই। বেশ কিছু জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য এরই মধ্যে একটি হটলাইন চালু করা হয়েছে- যারা লাইনে দাঁড়িয়ে চাল লজ্জাবোধ করছেন, তাদের উপকারে আসবে এটি। এদের নাগরিক তথ্যও সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে তাদের ভবিষ্যতেও সহযোগিতা করা যায়।
পঞ্চমত, গ্রাম পর্যায়ে এরই মধ্যে চাল বিতরণে কিছু ব্যর্থতার খবর পাওয়া গেছে। তাই বিপথে যাওয়া যুবনেতাদের ব্যাপারে স্থানীয় নিবেদিতপ্রাণ নেতৃবৃন্দকে এখন ভীষণ সতর্ক হতে হবে। ভিজিডি, ভিজিএফ ও খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির কারণে গ্রাম পর্যায়ে হতদরিদ্রদের তালিকা তৈরি আছে। এখানে দরকার সতর্কতার সাথে বরাদ্দকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন।
নগর পর্যায়ের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর একটা সরকারি তালিকা ভবিষ্যতের জন্যও অত্যন্ত জরুরি। প্রাথমিকভাবে এতে কিছুটা ভুলভ্রান্তি থাকবে, কিন্তু তা নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটক তাঁর এক লেখায় ভারতের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা ভুল কাউকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, কিন্তু ভুলবশত কোন প্রবল অভাবী লোককে বঞ্চিত করতে পারিনা।’
কথাটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ খুব স্বাভাবিক- ক্ষুধা আর অভাবের কারণে কাউকে মরতে দেখার মত কষ্ট আমরা এই মুহূর্তে পেতে চাই না।
তাই আসুন, কার্যক্রমগুলোকে গুছিয়ে নেই। অভাবীরা বঞ্চিত না হোক। ‘টেস্ট’ চলতে থাকুক, পাশাপাশি একটা কার্যকরী ‘লিস্ট’ও তৈরি হোক! যত যাই হোক, এই যুদ্ধে আমরা সবাই একসাথেই লড়ছি।
লেখক: গবেষণা বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি)