তরঙ্গের জলঘূর্ণি ও করোনাতঙ্ক
১৩ এপ্রিল ২০২০ ১৯:৩২
রাত দ্বি-প্রহর তখন। সাড়ে তিন বছরের আমাদের আত্মজ তরঙ্গ, ভীতস্বরে ঘুমের মধ্যে বলতে লাগলো, ‘মা আমার হাত ধুতে হবে ‘ লাইট জ্বেলে প্রথমেই বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাবা তোমার হাতে কী হয়েছে?’ তখন সে ঘুমঘোরেই বললো, ‘হাতে করোনা জার্মস, ক্লিন করতে হবে।’
সকালসন্ধ্যা, দিনরাত, ঘরেবাইরে সর্বত্র এখন একটাই আলোচনা। ভয়ংকর ভাইরাস কোভিড-১৯ বা করোনার বিস্তৃতিতে আমরা সবাই আতংকিত। আর ইত্যবসরে অবুঝ শিশুমনকে দুমড়ে দিচ্ছে বড়দের আতংক আর আলোচনা।
হামাগুড়ি শেষে হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শেখার পর থেকেই দরজায় কলিংবেলের শব্দে উল্লসিত শিশু তরঙ্গের বাবার কাছে ছুটে আসা ছিল নিত্যদিনের আনন্দ। এখন বাবা ঘরে ঢুকলেই অদৃশ্য শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহতের প্রস্তুতিতে পালিয়েছে শিশুর উচ্ছ্বাস। আনন্দের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে উৎকণ্ঠা। জীবাণুমুক্ত হবার প্রক্রিয়া শেষে পিতাপুত্রের আলিঙ্গনের সুযোগ হয় প্রায় ঘণ্টাখানেক পর। তাও পিতার চেহারায় মনে থাকে অনেক উদ্বেগ।
মা- বাবার মুখে মহামারি করোনা, বাসার বড়ছোট, সবার মুখে করোনা, টিভিতে করোনা, মোবাইলে করোনা, হাতে করোনা, চুলে করোনা, চোখে করোনা, মুখে করোনা, বাসে-ট্রেনে করোনা, লঞ্চ-প্লেনে করোনা, আকাশে-বাতাসে করোনা, ভাসছে করোনা, ভাসাচ্ছে করোনা, ভাবাচ্ছে করোনা। জীবন মৃত্যুর মাঝে এখন কেবলই করোনা করোনা আর করোনা ভাইরাস।
যে কোনো দুর্যোগ ও মহামারিতে সবচেয়ে বিপন্ন ও সংকটাপন্ন পরিস্থিতির শিকার হয় শিশু ও বৃদ্ধরা। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট যেকোন ক্রান্তিকালে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। দেশে বর্তমানে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৭ শতাংশ শিশু। বিশ্বব্যাপী করোনার এই ভয়াবহতা শিশুদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বাংলাদেশে লক্ষাধিক দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত, ছিন্নমূল, পথশিশু রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। মাদ্রাসা, এতিমখানা, শিশু নিবাসে থাকা শিশুদের প্রতি বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন অত্যাবশ্যক। করোনার আগ্রাসী তাণ্ডবে বিশ্বব্যাপী বাতাস ভারী স্বজন হারানোর আর্তনাদে। বিশ্বের বড় শহরগুলো এখন মৃত্যুপুরী, আকাশে বাতাসে শ্মশানের নিস্তব্ধতা আর হাহাকার। প্রান্ত থেকে কেন্দ্র সর্বত্র পরাক্রমশালী ভাইরাসের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের গল্প।
অথচ এই পরিস্থিতিতেও মানুষ নামধারী কিছু দ্বিপদী জন্তুর জান্তবতা থামেনি। সেদিন কেরানীগঞ্জে দশ বছরের শিশু ত্রাণ আনতে গিয়ে হয়েছে ধর্ষিত। কেউ কেউ আবার এই মহামারিতে শিশুদের ব্যবহার করতে চাইছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ত্রাণ সংগ্রহ ও ভিক্ষাবৃত্তিতে। অভিশাপ দিচ্ছি এই নরপশুদের।
শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত অধিকাংশেরই আলাপচারিতার বড় অংশ জুড়েই মৃত্যু, মহামারি, আতংক, আশংকা, হতাশা, নিরাশার নেতিবাচক বিষয়গুলো। সচেতন, অসচেতন কিংবা অবচেতন অবস্থায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে শিশু মনে।
করোনার কারণে দেশে দেশে মৃত্যুর বিভীষিকার চিত্র শিশুদের মনে ভীতি সঞ্চার করছে। স্কুল বন্ধ থাকায় কিংবা বাসার বাইরে যেতে না পারার কারণে চার দেয়ালে বন্দিত্বে বিদ্রোহী হচ্ছে শিশুমন। মোবাইল, ট্যাব, টিভি দেখাসহ ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার বৃদ্ধির আসক্তিতে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
বিষণ্ণতা, অনিরাপত্তা, উৎকণ্ঠায় অনেক শিশু হারাচ্ছে উদ্দীপনাশক্তি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমার পাশাপাশি আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ‘আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার এন্ড ডেভেলপমেন্ট’ বিঘ্নিত হলে শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হবে। প্রজন্মের উত্তরাধিকার শিশুরা দুর্বল চিত্তের মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে যা কখনোই কারো কাম্য নয়।
লকডাউনের এই সময়ে শিশুদের প্রতি সার্বিক মনোনিবেশ করে তাদের সাথে পরিবারের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এর আগে যাদের সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেবার সুযোগ হয় না, এখন সর্বোচ্চ সময়টা সন্তানকে দিতে পারেন। যেহেতু বাচ্চারা বাসার বাইরে যেতে পারছে না, তাদের সাথে নিয়মিত খেলাধুলা করা এবং সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
এটা সত্য যে, বর্তমান বাস্তবতায় স্বস্তিতে সকল বিষয়ে মনোনিবেশ সহজসাধ্য নয়। কিন্তু আমরা শিশুদের সামনে হতাশা ও উদ্বিগ্নতা যতই প্রকাশ করবো তারা ততই শঙ্কিত হবে এবং অনিশ্চয়তায় ভুগবে। শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং কল্যাণের কথা চিন্তা করে হলেও তাদের সামনে ভালো থাকার অভিনয়ের চেষ্টাটা তো শুরু করতে পারি। শিশুকে সচেতন করতে হবে অবশ্যই সঙ্গে সে যেন আতঙ্কিত না হয় সে খেয়ালটাও রাখা কাম্য।
মনোজগতে আশাবাদ এবং দুঃখবাদ পাশাপাশি চলমান। চারপাশের ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে এর প্রভাব পরিবর্তিত হয় । প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পরিবেশকে নিজের অনুকূলে রাখতে হলে আশাবাদী হতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমস্যাকে সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করার প্রত্যয়ের বিকল্প নেই। সম্ভাবনার সোনালী সূর্য শিশুদের আলোকোজ্জ্বল আগামী হতাশার ধূসর অন্ধকারে যেন নিমজ্জিত না হয় সে বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বিশ্বপতি, ধরণীতে নিশ্চয় করোনার প্রাদুর্ভাবজনিত করুণ কান্না থামিয়ে দিবেন। ধূসর অন্ধকার কাটিয়ে আলোকিত ভোর আসবেই। সবুজের বুকে সহাস্যে শিশুদের বিচরণে বিশ্ব পাবে প্রাণের স্পন্দন। আমার আপনার ভুলে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হচ্ছেনা তো এটা ভাবতে হবে এখন থেকেই। বেলা বয়ে যাচ্ছে কিন্তু। কোন আতংক নয়, সুন্দরের প্রত্যাশা ও প্রত্যয় নিয়ে প্রভাত হোক প্রতিটি শিশুর।
পরিশেষে কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে চাই- ‘চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ। প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি। নবজাতকের কাছে, এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার