করোনাযুদ্ধ, হাতে সময় নেই একদমই
১৩ এপ্রিল ২০২০ ২১:৫৪
করোনার মহামারীর সময়ে সরকারী ছুটি বাড়ানো হলো ২৫শে এপ্রিল র্পযন্ত। এই গৃহবন্দিত্বকে এখনো `ছুটি’ কেন বলা হচ্ছে তার জবাব কে দেবে? প্রথম থেকেই এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা হচ্ছে অনেক। সে যাই হোক, সকলকে ঘরের ভেতরে রাখা এখন প্রধান কাজ। এ ব্যাপারে সরকারী উদ্যোগ, ব্যবস্থাপনার যথেষ্ট পরিচয় মিলছে গনমাধ্যমে। সরকারের সদিচ্ছা আর তৎপরতা নিয়েও সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
আঠারো কোটি মানুষকে ঘরে আটকে রাখার কাজটা নেহায়েত সহজ নয়, সেটা আমরা বেশ বুঝতে পারছি। সামনের দিনগুলোতে এই লকডাউনকে আরো দৃঢ় করতে হবে। করতেই হবে। সাধারন মানুষের এর চাইতে জরুরী আর কোন কাজ যেন না থাকে। থাকলেই মহাবিপদ।
আইন শৃংখলা রক্ষাকারী, সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সাথে পাড়া-মহল্লার সেচ্ছাসেবী জনগনকেও সোচ্চার হতে হবে। একে অন্যকে বোঝাতে হবে। তবে বিভিন্ন জরুরী প্রয়োজনে মানুষকে বাইরে আসতেই হয়। সচেতন আর সাবধান হলে এই বাইরে যাওয়াটা কমানো যায় অনেকাংশেই। খাবারের সংস্থান করা বাইরে যাবার পেছনে অন্যতম কারন, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ বিস্তৃতির আশংকায় সকল মহল উদ্বিগ্ন। যথাসাধ্য ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের বিভিন্ন শাখা ব্যস্ত ও কর্মচঞ্চল। তবে বাস্তব কর্মপরিচালনা ও পরিকল্পনায় এখনো সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে করোনা মোকাবেলা ও উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য ও অবশ্য করনীয় নিয়ে আগাম প্রস্তুতির প্রয়োজন।
চলমান স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা বাড়ানো
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো স্বাস্থ্যসেবা দেবার জন্য সরকারের সাথে যুক্ত হয়েছে। এদেরকে অনতিবিলম্বে যথাযথ কার্যকারিতার মধ্যে আনতে হবে, নিশ্চিতভাবে। সকল সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে সার্বক্ষনিক সেবাদান নিশ্চিত করতে হবে। ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়াকে মোকাবেলা করতে অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা প্রয়োজন। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী এই কার্যক্রমের আওতায় আনা য়েতে পারে। ইতিমধ্যেই বসুন্ধরা গ্রুপ এর পক্ষ থেকে আইসিসিবি এর হলগুলোকে ‘আইসোলেশন ইউনিট’ হিসেবে প্রস্তুত করার উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
মৃত্যুর তালিকা যদি আরো দীর্ঘ হতে থাকে তবে মৃতদেহ সৎকারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার প্রস্তুতি রাখতে হবে। ফিল্ড হাসপাতাল এবং মৃতদেহ ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকাস্থ পুরাতন বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থাপনাসহ বিশাল উন্মুক্ত এলাকা অথবা যে কোন বড় খেলার মাঠ বা স্টেডিয়াম ব্যবহার করা যেতে পারে।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা
বিষয়টি আলোচনার শীর্ষে রয়েছে, যার সাথে আপোষ করবার কোন সুযোগ নেই। সরকারী ব্যবস্থাপনায় ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার প্রচেষ্টা চলছে। এই প্রচেষ্টা আরো বেগমান করতে হবে। এইসব নিরলস আর সাহসী যোদ্ধাদের মনোবল সমুন্নত রাখতে সরকারী উদ্যোগ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। এই ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রনোদনা ও সামাজিকভাবে উৎসাহ প্রদান অত্যাবশ্যক। গনমাধ্যমে এই বিষয়ে উৎসাহব্যঞ্জক প্রচারনা করতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে দৈনিক দায়িত্ব পালন শেষে প্রতিটি ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থকর্মীর জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এই ক্রান্তিকালে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে পরিবারে প্রতিদিন ফিরে যাওয়াটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও বিপজ্জনক ব্যাপার। এই বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের সকল দেশেই গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয়েছে। এই ‘আইসোলেশন’ অবস্থানের সময় সকলের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
অস্থায়ী আবাসন ব্যবস্থাপনার আওতায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আবাসিক হোটেলকে আনা যেতে পারে। এই ধরনের ব্যবস্থাপনার উদাহরণ আমাদের প্রতিবেশী দেশেই দেখা যাচ্ছে।
খাদ্য সরবরাহ ও খাদ্য নিরাপত্তা
খোলাবাজারে খাদ্য সামগ্রীর সরবরাহ চলমান ও বেগমান রাখতে হবে। এ পর্যন্ত খোলা বাজারে সরবরাহের তেমন কোন ঘাটতি দেখা যায়নি দু’এক জায়গার ব্যতিক্রম ছাড়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে। এগুলো মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীদের ছলা-কলা, সরকারকে কঠিন হাতে দমন ও নিয়ন্ত্রন করতে হবে। বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রন ও সরবরাহ স্থিতিশীল থাকলে নূন্যতম ক্রয়ক্ষমতা যাদের থাকবে তারা হয়তো কয়েকমাসের এই ক্রান্তিকাল পার করতে পারবে। সমস্যা হলো হত দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠি, যারা প্রতিদিনের রোজগার দিয়ে খাবারের সংস্থান করে। এই অবরুদ্ধ সময়ে এদের রোজগার শূন্যে নেমে গেছে। এদের কোন সঞ্চয় নেই।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কপর্দকহীন জনগোষ্ঠির জন্য দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। সরকারকে এই গুরুদায়িত্ব পালনে অনতিবিলম্বে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সাথে সাথে কাঁধে কাঁধ মেলাতে হবে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে, জনসেবামূলক এনজিওসহ অপরাপর অবস্থাপন্ন জনগনকেও। নইলে দুর্ভিক্ষ সমাসন্ন। আর একটা ১৯৭৪ আমরা কেউ দেখতে চাই না।
এই প্রান্তিক জনগোহঠিকে আগামী দুই মাস বা তিন মাস নিয়মিত খাদ্য সরবরাহের জন্য কার্যকরী পরিকল্পনা আর লাগসই পক্ষেপ নিতে হবে এখনই। কোথাও কোথাও এ ধরণের কার্যক্রমের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তবে তা সুসংগঠিত নয়। এই ব্যবস্থাপনা বাস্তবিক পরিসংখ্যান নির্ভর, স্বচ্ছ এবং দুর্নীতি মুক্ত রাখতে জাতীয় পর্যায়ের একটি মনিটরিং কমিটিকে শক্তহাতে পরিচালনা করবার দায়িত্ব দেয়া হোক। এখানে স্মরন রাখতে হবে যে আমাদের দেশে প্রশাসনিক নেটওয়ার্ক বা অরগানোগ্রাম তৃনমূল জনগোষ্ঠি পর্যন্ত সন্নিবেশিত ও সুসংহত। রাজনৈতিক অভিলাষ বাস্তবায়ন করবার কারনেই নিজ এলাকার জনগোষ্ঠির অবস্থান ও বিশদ পরিসংখ্যান আছে প্রতিটি জনপ্রতিনিধি, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাতে। বর্তমান আপদকালে এই নেটওয়ার্ক কাজে লাগাতে পারলে শৃংখলার সাথে সকল দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে খাবারের জন্যেই মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে হয় সবচাইতে বেশী। আর ক্ষুধার্ত মানুষ নিয়মকানুন গ্রাহ্য করে না, মৃত্যু ভয়েও ভীত হয় না। তবে হ্যাঁ, এই বিশাল দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে খাদ্য সরবরাহের অর্থনৈতিক সংগতি কি আছে আমাদের সরকারের? এই প্রশ্নের জবাব পেতে অনেক গবেষনার প্রয়োজন আছে।
এই কাজটি অর্থনীতিবিদরা ভাল করতে পারবেন আমি নিশ্চিত। দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করে একটি গ্রহণযোগ্য আর্থ-সামাজিক মডেল আমাদের উপহার দেবেন যা সরকার গ্রহণ করে এগিয়ে যাবে।
জাতীয় অর্থনীতি ও আপৎকালীন প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান
বিশ্বব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৪% জনগন দরিদ্র অথবা দ্রারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। সংখ্যার বিবেচনায় সংখ্যাটি প্রায় চার কোটি। প্রতিদিন এই চার কোটি মানুষকে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করতে জনপ্রতি ৩০ টাকা হিসেবে দৈনিক প্রয়োজন ১২০ কোটি টাকা। একমাসে প্রয়োজন ৩৬০০ কোটি টাকা । দু’মাসে ৭২০০ কোটি টাকা। সরকারের তহবিল থেকে এই অর্থের সংস্থান করা গেলে তা নিশ্চিন্ত করতে পারে সকলকে। আর যদি সেটা না হয়, বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন উপায়ে অর্থের যোগান দেয়া যেতে পারে। এই ব্যাপারে সরকারের নীতিমালা সুষ্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে।
এ বিষয়য়ে সরকারের কয়েকটি মেগা প্রজেক্টের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বার্ষিক বাজেট প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্ধ হয়েছে ৩.৮৭ বিলিয়ন ডলার যা ৩২০০০ কোটি টাকার সমান। (সূত্রঃ ঢাকা ট্রিবিউন, ২৫ জুন ২০১৯)। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৩ নম্বর টার্মিনাল নির্মানসহ অন্যান্য অবকাঠামো সম্প্রসারনের জন্য একনেক-এ অনুমোদন হয়েছে ২১০০ কোটি টাকা। (সূত্রঃ দি ফিনানসিয়াল এক্সপ্রেস, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯)। একনেক জানুয়ারী ২০২০ পর্যন্ত প্রায় ১২ টি সভা করেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম সভাতেই ১৩ টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অনুমোদন করে ৭৭০০ কোটি টাকা । (সূত্রঃ দি ফিনানসিয়াল এক্সপ্রেস, ৯ জুলাই ২০১৯) । -শুধু প্রথম সভাতে অনুমোদিত প্রকল্পসমূহ স্থগিত রাখলেই সারা দেশের অভাবী চার কোটি মানুষকে তিন মাস খাবার দেয়া যাবে। বিমানবন্দর সম্প্রসারন আর প্রতিরক্ষা বরাদ্দতো থাকলই।
জাতীয় দুর্যোগকালে এই সকল বরাদ্দ স্থগিত রেখে সমূহ অর্থ জনগনের জীবন বাঁচাতে ব্যবহার করা যায় কি? দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির চাকা আবারো গতিশীল হবে। প্রকল্পগুলো আবারো প্রাণ ফিরে পাবে শক্তিশালী সরকারের দৃঢ় নেতৃত্বে আর ষোল কোটি মানুষের দৃপ্ত জয়গানে।
করেনা আক্রমণ থেকে বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠিকে প্রাণে বাঁচানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতে হবে। হাতে সময় নেই একদমই।