করোনাযোদ্ধা ডা. মঈন স্মরণে কিছু করুন
১৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:১১
মানবিক চিকিৎসক মো. মঈন উদ্দিন আর নেই। সবাইকে শোকে ভাসিয়ে করে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার এই মৃত্যু হৃদয় বিদীর্ণ করার মত। আমরা শোকাহত। সিলেটবাসী শোকাহত। পুরো দেশ শোকাহত। চিকিৎসা দিতে গিয়ে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত হয়েছেন। তার এই পরাজয় একক কোন পরাজয় নয়। মনে হয় তার সঙ্গে আমরাও পরাজিত হয়ে গেছি অনেকখানি। শোকস্তব্ধ আমরা।
চিকিৎসকদের প্রতি আমাদের অনুযোগ আছে, অভিযোগ আছে। তবে সেই অভিযোগ যতটা না বাস্তবের, তারচেয়ে হুজুগের। আমরা নিত্যদিন নানা সমস্যায় চিকিৎসকদের শরণ নিই। আবার সেই চিকিৎসকদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে যাওয়ার পর কেউ কেউ অস্ফুট উচ্চারণে যেসব শব্দ-বাক্য ব্যবহার করেন সেগুলো খুব হাওয়া পায়। বাতাসের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছড়িয়ে যায় সেসব। ফলে চিকিৎসকদের নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবার বিপরীতে অজ্ঞাত কারণে আমরা যে সকল কটূক্তির শব্দ ব্যবহার করি তা হয় জনপ্রিয়ধারার। ফলে কারো কারো মুখে নিঃসৃত ‘কসাই’ শব্দটার ব্যাপ্তি বাড়ে। এই শব্দব্যাপ্তিতে করোনার এই সময়ে ‘পালিয়ে যাওয়া’ সম্বলিত যে অপপ্রচার ভেসেছে বাতাসে তার গতিও অনেক। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে যাচাইবিহীন পামরদের সেই অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চস্থান। ওখান থেকেও ভেসে এসেছে ‘পালিয়ে যাওয়া’ বিষয়ক অপপ্রচার কিংবা হুজুগে প্রচার। অথচ এটা যে অসত্য তার প্রমাণ ডাক্তার মঈন উদ্দিনের আক্রান্ত হওয়া থেকে এই বিয়োগান্তক ঘটনা।
ডা. মঈন উদ্দিন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই আক্রান্তের ইতিহাস আমাদের কাছে এখনও অজানা। যাদের প্রয়োজন ছিল জানানোর তারাও জানায়নি। হয়ত তারাও জানে না। এই না জানার মাঝে থাকতে পারে আগ্রহের অভাব; থাকতে পারে ব্যর্থতা। অথচ জানা জরুরি ছিল, অন্তত আরো অনেককে রক্ষা করতে। কারণ কোভিড-১৯ এর এই মহামারি একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায়। ফলে যার বা যাদের সংস্পর্শে তিনি এসেছিলেন তাদের মাধ্যমেই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। হতে পারে তার দ্বারাও আক্রান্ত হয়েছিলেন কেউ কেউ। তবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তিনি নিজেকে একাকী করে রেখেছিলেন। এই একাকী করে রাখাটা তার সতর্কতামূলক পদক্ষেপের অংশ।
তার মৃত্যুর অব্যবহিত পর জানা যাচ্ছে, ছুটির দিনগুলোতে গ্রামে তিনি বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতেন। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি স্যাম্পল হিসেবে যেসকল ওষুধ দিত তিনি সেগুলোও দিতেন সাধারন মানুষদের। নিজ এলাকায় করেছেন একাধিক মেডিকেল ক্যাম্প। সেখানে হাজার হাজার লোক চিকিৎসা সেবা পেয়েছে। এছাড়াও প্রাইভেট চেম্বারে যেখানে তিনি রোগী দেখতেন সেখানেও অসহায়দের জন্যে ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। তার এই ভূমিকা তাকে মানবিক ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। মানববাদে উদ্ধুব্ধ এই চিকিৎসকের এই সেবা প্রদানের ইতিহাস পরিবার থেকেই। ছিল পিতার কাছে সন্তানের অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতা। জানা যাচ্ছে, প্রয়াত পল্লিচিকিৎসক বাবার অনুরোধ কিংবা পরামর্শেই তিনি এমন ভূমিকা পালন করেছিলেন।
সিলেটের সুনামগঞ্জের সন্তান ডা. মঈন উদ্দিন ছাতক থেকে শিক্ষার্জনের পাঠ শুরুর পর সিলেটের এমসি কলেজ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ দিয়েই তার স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেছিলেন। স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ছিলেন মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। তার এই জ্ঞান কেবল অর্থ উপার্জনের জন্যে ছিল না, ছিল মানবসেবার জন্যে, যা তিনি জীবন দিয়েই প্রমাণ করেছেন।
সারাবিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে আক্রান্ত তখনও ডা. মঈন উদ্দিন মানবসেবা থেকে পিছু হটেননি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একজন মানবসেবী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে গেছেন। মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি তার এই নিবেদন শব্দ-বাক্যে প্রকাশের মত নয়। অশ্রুত-অলিখিত শব্দ-বাক্যই প্রাসঙ্গিক।
করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে করোনাযোদ্ধা ডা. মঈন উদ্দিনের চিরবিদায়ের পর সামনে আসছে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা। দোষারোপের বলও ঘুরছে, এঘর-ওঘর। তবে এই সময়ে যত আলোচনা, যত সমালোচনাই হোক না কেন তার অবস্থান আর ফেরার পর্যায়ে নেই। তার প্রাণপাখির সর্বশেষ স্পন্দন যখন থমকে গেছে, যখন তার চোখের আলো শেষবারের মত নিভে গেছে তখন তিনি আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন। হয়ত ওই সময়ে তিনি ভাবছিলেন, হয়ত কষ্টে বুজেছিলেন দুই চোখ; কী সে ভাষা সে আমাদের জানার আর সুযোগ নাই, থাকার কথাও নয় স্বাভাবিক ভাবেই।
তবে এই সময়ে তার ওই সময়টা নিয়ে আমরা যদি চিন্তা করে তবে ওখানে একটা কষ্টের নীল ছায়া এসে ভর করে। বেঁচে ওঠতে চাওয়া একজন মানবিক চিকিৎসককে আমরা যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি। এই দায় হয়ত এককভাবে আমাদের ব্যক্তি পর্যায়ে এসে পড়ে না, তবে দায় নিশ্চিতভাবেই দায়িত্বশীলদের যারা খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণ করেছেন। দায়িত্বশীলদের এই আচরণে রাষ্ট্রের ওপর গিয়ে পড়ে অবধারিতভাবে। এখানে দায়মুক্তির সুযোগ নাই কোনো। ডা. মঈন উদ্দিনকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে দ্রুত ঢাকায় স্থানান্তরের জন্যে যখন একটা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের দরকার পড়েছিল তখন তাকে তা দেওয়া হয়নি বা দেওয়ার ব্যবস্থা যারা করেননি তারা কোনোভাবেই এই দায় এড়াতে পারেন না। এই ব্যর্থতা, এই অবহেলার দায় নেবে কে? হয়ত আক্ষরিক অর্থে কেউ নিতে চাইবে না, কিন্তু ইতিহাস ঠিকই যাদেরকে দায় দেওয়ার তাদেরকে তা দেবেই!
ডা. মঈন উদ্দিন যেদিন মারা যান সরকারি হিসেবে সেদিনই দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা অর্ধশতে গিয়ে পৌঁছেছে। এই সংখ্যার মধ্যে তিনি প্রথম চিকিৎসক যিনি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। এরবাইরে আরো অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সংখ্যায় শতাধিক এবং কেবল চিকিৎসকের সংখ্যাই এখানে অর্ধশতাধিক। করোনা আক্রান্ত এত এত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মী তার শতাংশের হিসাবে দশের কাছাকাছি। এই হিসাব আঁতকে ওঠার মত। কারণ করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে যখন এত এত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মী আক্রান্ত হন তখন তাদের সুরক্ষা উপকরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বারবার বলছেন পর্যাপ্ত পরিমাণে বিতরণের কথা, কিন্তু এই কথাটাকে স্রেফ কাগুজে বলেই প্রমাণ হচ্ছে, সন্দেহ জাগছে এসবের মান নিয়েও।
যাই হোক, প্রয়াত চিকিৎসকের পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানিয়েছেন সরকার। বলছেন বীমার আওতায় আর্থিক অনুদানের কথা। এই দায়িত্ব নেওয়া, বীমার ব্যবস্থা মৃত্যুর পরের ঘটনা; মৃত্যু শব্দটাই এখানে হৃদয়বিদারক।
করোনাযুদ্ধের সেনানী ডা. মঈন উদ্দিনকে আর ফেরানোর উপায় নাই। মানববাদে উদ্ধুব্ধ হয়ে তার চিকিৎসা সেবা মানুষের মাঝে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। এই বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তার ঠিকানা সিলেটের হাউজিং এস্টেটের কোনো একটা রাস্তার নামকরণ করা হোক। এজন্যে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিটি করপোরেশনের মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ওসমানী হাসপাতালও এমন কোন উদ্যোগ নিতে পারে কোনোকিছু তার নামে নামকরণের মাধ্যমে। সিলেট সিটি করপোরেশনও সম্ভব কোন কিছু করতে পারে। এজন্যে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।