প্রবাসীরা অসহায় এখন, রাষ্ট্র পাশে দাঁড়াও
১৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:২৫
উন্নত জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে কাজ করে। সারাবিশ্বকে কর্মক্ষেত্র বানিয়ে ছুটতে থাকে স্বপ্নচারী মানুষ। গোটা বিশ্বজুড়েই এমন মানুষের দেখা মিলবে। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়া- সর্বত্রই রয়েছে বাংলাদেশি। প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী হয়ে কাজ করছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বিদেশে কাজ করে দেশের রেমিট্যান্স খাত সমৃদ্ধিতে রাখছেন বিশেষ অবদান। কিন্তু করোনাভাইরাস আতঙ্ক চতুর্মুখী সংকটে ফেলে দিয়েছে এসব প্রবাসী বাংলাদেশিদের।
করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্ব হয়ে পড়েছে স্থবির। থমকে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। বিশ্বের দুইশরও বেশি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণে টালমাটাল গোটা বিশ্ব। পরস্পর বিচ্ছিন্ন গোটা পৃথিবী।
আক্রান্ত দেশগুলোতে বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, অফিস-আদালত, কল-কারখানা। দেশগুলোতে লকডাউন বা জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে কিংবা এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যাকে এক কথায় বলা যায় অচলাবস্থা। ফলে টালমাটাল পুরো পৃথিবীর অর্থনীতি। এমন পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি।
বেশিরভাগ প্রবাসীর দিন কাটছে ঘরে বসে। অনেকের নিয়োগকর্তা বেতন, খাবার, বাসস্থান, ওষুধ ইত্যাদি দিলেও যাদের নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তা নেই, বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। সেই প্রবাসীরা পড়েছেন বিপাকে।
যারা স্থায়ী চাকরি করছেন তাদের দুশ্চিন্তা কিছুটা কম হলেও, অস্থায়ী শ্রমিকরা ইতোমধ্যে বেকার হয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন দৈনিক বা সাপ্তাহিক চুক্তিভিত্তিক কাজ করা শ্রমিকরা। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন পেটের তাগিদে বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশিরা। করোনা পরিস্থিতিতে দেশে টাকা পাঠানো তো দূরে থাক, রীতিমতো জীবন সংকটে পড়েছেন তারা।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অধিকাংশ প্রবাসী কর্মহীন হয়ে পড়ায় বেতন পাবেন না। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের মূল উৎস মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকরা। অনেক দেশ রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে প্রণোদনা দিলেও তা কতদিন চলবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের এখন প্রয়োজন ছাড়া বাংলাদেশে না আসার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ফলে উভয় সংকটে পড়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনার চাপও রয়েছে সরকারের ওপর। ফলে সিদ্ধান্ত সংকটে পড়েছে সরকারও।
প্রবাসীদের এমন সংকট বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে চরম প্রভাব ফেলবে একথা বলাই বাহুল্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণে রেকর্ড হয়েছে। অর্থবছরে প্রবাসীরা ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। যা অর্থবছর হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। কিন্তু করোনার প্রভাবে চলতি অর্থবছর রেমিট্যান্স খাতে চরম বিপর্যয়হবে বলে আশংকা সবার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এক হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসিরা। এর আগের বছর ২০১৬ সালে ছিল এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলার। ২০১৫ সালে আসে এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। আর ২০১৪ সালে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৯২ কোটি ডলার।
গত কয়েক বছর ধরেই রেমিট্যান্স খাতে প্রবাসী শ্রমিকেরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু করোনার কারনে কর্মহীন হয়ে পড়ায় নিজেরাই এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে রেমিট্যান্সের পরিমান একদমই কমে যাবে। সেই কারনে এই খাতের বিপরীতে আরেকটা খাতকে জোরদার করতে হবে। যাতে এই ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ করা সম্ভব হয়।
ইতালি প্রবাসী বাংলাদেশিরা শুধু করোনার আতঙ্কেই না, চাকরিও হারাচ্ছেন। সেখানে ২ লাখ ৬০ হাজারের মতো বাংলাদেশি আছেন। দেশটির বেশির ভাগ শহর এখন জনকোলাহল মুক্ত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তালা ঝুলছে। সুপার শপ, রেস্টুরেন্ট, নাইট ক্লাব সবই বন্ধ। সিনেমা হল, জাদুঘর সব বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। চরম সংকটে পড়েছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা।
এবার আসি প্রবাসি বাংলাদেশিদের মৃত্যুর বিষয়ে। করোনার কারণে মুত্যুুর মিছিলে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ১৪২ জনের অধিক বাংলাদেশি প্রবাসী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। যুক্তরাজ্যে ৪৮, ইতালিতে ৬ জন, কানাডায় ৪ জন, সৌদি আরব ও স্পেনে ৩ জন করে, কাতারে ২ জন এবং সুইডেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লিবিয়া ও গাম্বিয়ায় ১ জন করে মারা গেছেন। আক্রান্তের সংখ্যা না হয় বাদই দিলাম। এখন পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে মোট ৬৬৯ জন বাংলাদেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
একটি মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি পরিবার। প্রবাসে জীবনযাপন খুব কষ্টের। করোনাভাইরাস সেই কষ্টটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রবাসীরা বুঝতে পারছেন না- কী করবেন! ভবিষ্যৎ কি! এক অনিশ্চয়তার মধ্যদিয়ে দিন পার করছেন তারা।
করোনাভাইরাস রোধে সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথম থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করলেও সেখানেও ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাস। ফলে স্থানীয়দের মতো করোনা নিয়ে আতঙ্কে আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। এরই মধ্যে ওমরাহ ও ভ্রমণ ভিসা স্থগিত করেছে সৌদি সরকার। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যও ওমরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাইরে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে স্থবিরতা নেমে এসেছে সেখানকার জনজীবনে। ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।
ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় সৌদি আরবে বসবাসকারী যারা ছুটি নিয়ে দেশে ফিরেছেন, তাদের সৌদিতে ফিরে যাওয়াতে কোনো বাধা নেই। তবে ওই ব্যক্তি যদি করোনা আক্রান্ত কোনো দেশে ভ্রমণ করেন তবে তা অবশ্যই জানাতে হবে। অবশ্যই মেডিকেল রিপোর্ট সাথে নিতে হবে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
করোনার কারনে এমন দুর্যোগে প্রবাসীদেরকে সহযোগিতা না করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরেও রেমিট্যান্স আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যা দীর্ঘদিন বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ভুগতে হবে।
এই অবস্থায় প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রবাসী শ্রমিকদের এই সংকটকালীন মুহূর্তে তাদের পাশে দাড়ানো উচিৎ। কারণ শ্রমিকদের আয়ের উপর বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভর করে।
তাছাড়া যেসব শ্রমিক দেশে এসেছেন তাদের জন্য আলাদা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারেন সরকার। তারা যাতে করোনা পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে ঠিক থাকে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদেরকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।