মুনাফা নয়, ভাবতে হবে দেশের কথা
১৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:৪১
বৈশ্বিক মহামারী আকার ধারণ করেছে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। এমন পরিস্থিতির কারণে সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। নিজের একটি অভিজ্ঞতা সবার সাথে শেয়ার করি- রংপুরের মিঠাপুকুরের ১৬ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়ন এলাকার এক ভাই কয়েকদিন আগে আমাকে ফোন করে আমাকে জানালেন যে, তার স্ত্রী ও কন্যা দুজনেই গার্মেন্টসে চাকরি করে। বেতন নিয়ে ঝামেলা করছে মালিক। এখন পর্যন্ত মার্চ মাসের বেতন পাননি তারা। বেতন নিয়ে গার্মেন্টস মালিকদের গড়িমসির কথা নতুন করে কিছু বলব না।
দেশের এমন পরিস্থিতিতে কারো হয়তো বা সক্ষমতা আছে, আবার কারো নেই। আশা রাখি বেতনটা দেওয়া হবে নিশ্চয়ই। কারণ বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকিং প্যাকেজেরও ঘোষণা দিয়েছেন। মালিকপক্ষ ইচ্ছা করলেই সরকারের দেয়া সুবিধা নিয়ে কর্মীদের বেতন দিয়ে দিবেন বলে আশা রাখছি।
কিন্তু একটি বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। গত ৪০ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা গার্মেন্টস শিল্প বিভিন্ন সময়ে দেশের ভাবমূর্তি সঙ্কটে ফেলেছে। গার্মেন্টস শিল্পে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের দিয়ে কাজ করানোর বিষয়ে বহির্বিশ্বের হর্তাকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে। প্রশ্ন তুলেছেন কর্মীদের মজুরি নিয়ে।
সবকিছু ছাপিয়ে তৈরি পোশাক শিল্পে একটা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক প্রস্ততকারক দেশ এখন বাংলাদেশ। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, করোনাভাইরাসের এই সময়ে সম্ভাবনাময় শিল্প খাতের কিছু সিদ্ধান্ত জাতিকে হতাশ করেছে। বিজিএমইএ-বিকেএমইএ’কে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কারখানা খোলা থাকবে কী, থাকবে না? বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে তারা। তা নিয়েই বিতর্কের শুরু।
বিষয়টা আলোকপাত করা দরকার- করোনাভাইরাস পরবর্তী পৃথিবীতে মানবাধিকার সংস্থাগুলো যদি প্রশ্ন করেই বসে, বাংলাদশের গার্মেন্টস মালিকেরা কি দায়িত্বশীল? উত্তর কী হবে! কতিপয় গার্মেন্টস মালিকের ভুলের কারনে মাশুল দিতে হবে পুরো শিল্পকে।
‘কর্মীদের দরিদ্রতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে লকডাউনের সময়ে তাদেরকে দিয়ে কাজ করিয়েছেন’, কর্মীদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে কেবল ব্যবসায়িক মুনাফার লোভে কাজ করিয়েছেন’ -এমন কারণ দশিয়ে যদি বিদেশি সংগঠন বা বায়ার আমাদের দেশের পণ্যকে বর্জন করে তখন কী হবে? কষ্টে গড়া গার্মেন্টস শিল্পকে বাঁচাতে পারবো?
কিছু গার্মেন্টসে বিদেশি অর্ডার আছে-এটা ঠিক। সময়মতো তা ডেলিভারি দিতে না পারলে সমস্যায় পড়তে হবে- এমন ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু বিশ্বজুড়েই যে করোনা পরিস্থিতি, এটাতো বুঝতে হবে। সবাই এখন জীবন বাঁচানো নিয়ে ব্যস্ত। অর্ডার নিয়ে এখন ভাবছে না তারা।
মহামারি পরিস্থিতিতে সামান্য ভুলের কারনে বড় ধরনের ব্র্যান্ড ইমেজ নষ্ট হতে পারে এমন ভাবনা কেউ ভাবছে না। এতো দিনের সব অর্জন অনর্থক হয়ে যাবে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো বিভিন্ন গার্মেন্টস খোলা। গত ৭ এপ্রিল বিজিএমই এর নিবন্ধন গার্মেন্টসই খোলা ছিল তিন শতাধিক। তাহলে নিবন্ধন ছাড়া গার্মেন্টস কী পরিমান খোলা থাকতে পারে? পরের দিন ৮ এপ্রিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বহু গার্মেন্টস খোলা ছিল। পুরো লকডাউনে থাকা নারায়ণগঞ্জেও রাস্তায় নেমে গার্মেন্টস কর্মীরা বেতনভাতার জন্য আন্দোলন করছে। এগুলো দুর্ভাগ্যজনক।
যিনি গার্মেন্টস ব্যবসা করেন বায়ারের অর্ডার ডেলিভারি দিয়ে তিনি মুনাফা উপভোগ করবেন। এটাই সাধারন কথা। কিন্তু কর্মীদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মুখে ফেলে সেই মুনাফা উপভোগ করা কী আদৌ সম্ভব?
সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য বর্তমানে যতো ক্ষতিই হোক না কেন সকল গার্মেন্টস আপাতত বন্ধ করতে হবে। কারণ দেশের সক্ষম জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব।
সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য বর্তমানে যতো ক্ষতিই হোক না কেন সকল গার্মেন্টস আপাতত বন্ধ করতে হবে। কারণ দেশের সক্ষম জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব।
গার্মেন্টস খোলা রাখার বিষয়ে একটি যুক্তি হলো- পিপিই বানানো। বিশ্বজুড়ে পিপিই সংকট। এমন সংকটে বাংলাদেশ যদি বিশ্বজুড়ে পিপিই সরবরাহ করে তবে বাহবা মিলবে। কিন্তু আসলেই কী তাই? পিপিই বানালেই শুধু হবে না। বিশ্ব বানিজ্য নিয়েও ভাবতে হবে। কর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও ভাবতে হবে। এসব কর্মী যদি অসুস্থ হয়ে যায় তবে করোনা পরবর্তি সময়ে কারা কাজ করবে?
পিপিই বানানোর আড়ালে অন্যান্য গার্মেন্টস আইটেম বানানোর অভিযোগও পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে একটি কথা বলতে হয়, পিপিই বানানোর আড়ালে যেসব গার্মেন্টস আইটেম যারা বানাচ্ছেন তারা সেসব রফতানি করবেন কোথায়? পন্য নিয়ে যদি বন্দর পর্যন্ত যাওয়াও যায়, সেই পণ্য নিয়ে জাহাজ কোন বন্দরে যাবে? এর উত্তর নেই কোন গার্মেন্টস মালিকের কাছে।
দেশের গার্মেন্টস শিল্পে উৎপাদিত পন্যের অধিকাংশই রফতানি হয় ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও উত্তর আমেরিকাতে। করোনার কারনে সেসব দেশের বর্তমান যে অবস্থা তাতে রফতানির আশা করাটাই এখন বোকামি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখন লকডাউন চলছে। গার্মেন্টস পন্য আমদানি নিয়ে তারা ভাবছে না।
একটা বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত অর্থবছরে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পন্য রফতানি করার কথা। ইতোমধ্যেই ২২ বিলিয়ন ডলারের পন্য রফতানি করতে সক্ষম হয়েছেন পোশাক শিল্পের হর্তাকর্তারা। এটি একটি বড় সফলতা। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, তিন বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। বাকি ১০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাকি আছে সেটা পূরণ করতে গিয়ে দেশকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বিশ্বব্যাপী বিপদটা কেটে গেলে সবাই যখন বানিজ্য মনোযোগ দিবে তখন বায়ারের কাছ থেকে সময় নিয়ে সব ঠিকঠাক ডেলিভারি দিতে পারলেই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
বিজিএমইএ, বিকেএমইএ সকল কর্মীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলেছেন। সেগুলো মান্য করে কাজ চালানোর জন্য গার্মেন্টস খোলা রাখা যেতে পারে বলেও বলছেন অনেকে। কিন্তু সেটা কী আদৌ সম্ভব?
একটা গার্মেন্টসে যেখানে ১০ থেকে ২০ হাজার লোক একসাথে কাজ করে সেখানে পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করা সম্ভব? ইচ্ছে থাকলেও তা করা সম্ভব না। শুধু কারখানার পরিবেশের কথা ভাবলেই হবে না। গার্মেন্টস কর্মীদের বাসস্থানের কথাও ভাবতে হবে। তারা কোথায় থাকে? তাদের অধিকাংশই থাকে বস্তিতে। সেখানে একসাথে বহু পেশার মানুষের গাদাগাদি করে বসবাস। বস্তিতে বসবাস করা কর্মীদের একজন আক্রান্ত হলে সংক্রমন পুরো কারখানার কর্মীদের মধ্যে ছড়িযে যাবে। তখন কী হবে? সে কথা ভেবেছেন কী?
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমি মনে করি, কর্মীদের স্বাস্থগত দিক, পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিবেচনা করে দেশের সব পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা উচিত। ১০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গিয়ে বাঙালির সম্ভাবনার অর্থনীতি ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলতে পারি না। কাউকে দোষ দেওয়ার পক্ষে আমি না। বিনয়ের সঙ্গে আহ্বান জানাই, আসুন আমরা সবাই লকডাউন মেনে চলি। দেশকে বাঁচাই। দেশের মানুষকে বাঁচাই।
লেখক: ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ