ত্রাণে পরিত্রাণ
১৬ এপ্রিল ২০২০ ১২:১০
“আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব
–ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব।।”
লেখাটি লিখতে গিয়ে আমার কবিগুরুর এই গানটি মনে পড়ছিল। গানের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগ না থাকলেও মিল আছে খানিকটা। কোনদিকে মিল তা পরে জানাচ্ছি। নোবেল জয়ী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সম্প্রতি করোনা ভাইরাস নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে নিজের মতামত দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে, ব্রিটিশ শাসনে দেশে প্রায়ই মন্বন্তর দেখা দিত। খেতে না পেয়ে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতেই আর ভয়াবহ মন্বন্তরের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি দেশে। বাংলায় শেষবার ১৯৪৩ সালে মন্বন্তর দেখা দিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে। তখন আমি ছোট। সবই নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৪৭–র পর দেশে খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। কারণ একটাই। আমাদের গণতন্ত্র।
’বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ। এই গণতান্ত্রিক দেশে মানুষ কি না খেয়ে আছে?
প্রশ্নটা আপনাদের কাছে। তবে এখন খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এই কথাটি আমার নয়। অর্থনীতিবিদদের। তারা শঙ্কা করছেন বিশ্বে করোনা পরিস্থিতির কারণে কম উন্নত দেশগুলোতে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন?
নিশ্চয়ই ভালো। দেশের সরকার প্রতিনিয়ত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে দশ টাকার চাল সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নিম্নশ্রেণিপেশার মানুষ যাতে খেতে পারে তার জন্য সেখানে চাল পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এখন বাস্তবতা কি বলে?
আমার ধারণা ছিল পরিস্থিতি ভালো। কিন্তু গণমাধ্যমগুলো বলছে পরিস্থিতি শুধু খারাপ নয়, ভয়াবহ খারাপ। কেন? কারণ নিম্নশ্রেণিপেশার মানুষদের জন্য সরকারি যে চালগুলো পাঠানো হয়েছে তা ব্যাপক হারে লুটপাট হচ্ছে। কোথাও আবার চুরির খবর প্রচার করায় সাংবাদিক পেটানোর ঘটনাও ঘটছে। তারও প্রমাণ দিচ্ছে গণমাধ্যম।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নে হতদরিদ্র মানুষের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ২৮৮ বস্তা চাল সরিয়ে নেয় উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গাজিউল হক, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নে ২৫ টন চালসহ আটক হয় আওয়ামী লীগের সভাপতি ইসরাইল জুবেল, বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় মধুপুর ইউনিয়নের দড়িহাঁসরাজের কৃষকলীগ নেতা মিঠু মিয়াকে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৫০ বস্তা চাল সহ আটক করা হয়, জামালপুর সদর উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে ৩৭ বস্তা চাল সহ আটক হয় উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুর রহমান, কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের দিগদাইড় ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ১০ টাকা কেজির ৬০ বস্তা চাল সহ আটক হয়, নাটোরের সিংড়া উপজেলায় ৬নং ওয়ার্ড সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন শাহ্ ত্রাণের ১৩ বস্তা চাল সহ আটক হয়।
গত কয়েকদিনে চুম্বক কিছু প্রতিবেদন আমি তুলে ধরলাম। সবারটা তুলে ধরলে আমার মূল লেখা শব্দ সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে। তবে এরমধ্যে কয়েকজন আবার ভিন্ন পন্থাও অবলম্বন করেছে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার ত্রাণ দেওয়ার ছবি তোলার পর ২৬টি পরিবারের কাছ থেকে তা কেড়ে নেয়। এই কাজটা বেশ সাহসী! এরচেয়েও অবশ্য সাহসী কাজ কেউ কেউ করেছে।
চাল চুরির খবর ফাঁস করায় ভোলায় সাংবাদিক সাগর চৌধুরীকে মারধোর করেছে বোরহানউদ্দিন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভপতি ও বড় মানিকা ইউপি চেয়ারম্যান জসিম হায়দারের ছেলে নাবিল হায়দার। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে সরকারি ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের কথা তুলে ধরায় সাংবাদিক শাহ সুলতান আহমেদকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পিটিয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান হারুন ও তার লোকজন।
একে তো চুরি, তার উপর আবার মারামারি। বাহ্, বেশ! এরা সবাই প্রশংসার দাবীদার! যখন দেশে খাদ্য সংকট প্রকট, হতদরিদ্র লোকজন খেতে পাচ্ছেন না তখন এইসব দলভারী করা লোকজন সরকারি চাল চুরি করছে। এরচেয়ে লজ্জার আর কি থাকতে পারে।
এইসব খবর শুনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লাইন দুটি আমার মনে পড়ছিল। দেশের এই সংকটে সবাই মানসিকভাবে পর্যুদস্ত। যেখানে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান মানুষকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেই জায়গায় সরকারি লোকজন সরকারি চাল মহোৎসবে চুরি করছে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, এরা কেন চুরি করে?
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের ঘটনা। তখন চারিদিকে দুর্নীতি যে জেঁকে বসতে শুরু করেছে তা টের পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল- ১৬ জন, ৯ এপ্রিল ও ২২ সেপ্টেম্বর- ২৬ জনসহ মোট ৪২ জন এমপিকে দুর্নীতির অভিযোগে দল থেকে বহিস্কার করতে বাধ্য হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে (মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী : ইতিহাসের পুনর্পাঠ, আলতাফ পারভেজ, পৃ:-৪২২)।
এতেও যখন কাজ হয়নি। তখন বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’
১৯৭১ থেকে ২০২০। এই বিশাল সময়ের মধ্যে চোর বা দুর্নীতিবাজদের চেহারা বদলে যায়নি। এরমধ্যে সময় পাল্টেছে, সরকার পাল্টেছে, সরকার প্রধানও পাল্টেছে কিন্তু চোর বা দুর্নীতিবাজরা একই রকম রয়ে গিয়েছে। গ্রীষ্ম থেকে হেমন্ত চোর বা দুর্নীতিবাজরা সর্বদা সজাগ। বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা চোর বা দুর্নীতিবাজরা সদা জাগ্রত।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশে তো কিছুই ছিলো না। তখনো চোর বা দুর্নীতিবাজরা যেভাবে দেশ থেকে চুরি বা লুটপাট করেছে, এখন করোনা পরিস্থিতিতেও তারা একই কায়দায় চুরি বা লুটপাট করছে। সংকট, সম্ভাবনা সব পরিস্থিতিতে তারা চুরি করছেই। এদের যে অভাব আছে তা কিন্তু নয়। তারা মূলত স্বভাবে চুরি করে। চুরি করাটা তাদের নেশায় পরিণত হয়ে গেছে।
আমি একটা বিষয় প্রায়ই ভাবি, দেশের এই সংকটে কিভাবে তারা চুরি করে? কিভাবে সরকারি চাল চুরি করে বাসায় বা গুদামে রেখে দেয়? তাদের পরিবার কি এইসব তথ্য জানে না? পরিবারের লোকজন কিছুই বলে না? এইসব প্রশ্ন আমার মাথায় প্রতিনিয়ত ঘুরতে থাকে। আমি এর কোনো উত্তর খুঁজে পাই না।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার মতামতে কিছু পরামর্শ দেন, সরকারি গুদামে মজুত করা চাল–ডাল-গম এখন বিলিয়ে দেওয়া হোক জনসাধারণের মধ্যে। অন্তত এই লকডাউনের দিনগুলোতে যাতে খাবার জোটে তাঁদের।
যেই জায়গায় পৃথিবীর সকল দেশ তাদের জনগণ বাঁচানোর জন্য উপর্যুপরি বিভিন্ন পরিকল্পনা নিচ্ছে, সেই জায়গায় বাংলাদেশে সরকারি দলের লোকজন আনন্দের সাথে গরীবের মুখের খাবার চুরি করছে। এরা যে একদিনে এতো বড় চোর বা দুর্নীতিবাজ হয়েছে তা কিন্তু নয়। তারা প্রতিবার সরকারি বিভিন্ন জিনিস চুরি করতে করতে এই পর্যায়ে এসেছে। যদি শুরুতেই তাদের কঠিন শাস্তি দেয়া হোত তবে করোনা সংকটে তারা চাল চুরির কথা ভাবতেই পারতো না।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি পৌর এলাকার আলম শেখের মেয়ে আফরোজা খাতুন (১০)। দুস্থ এ পরিবারটির সন্তান আফরোজা আত্মহত্যা করেছে মূলত ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে।ঘটনাটি বিশ্বাস করা যায়? বিশ্বাস না করলেও ঘটনা সত্য।
আলম শেখ জানায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রশাসনের কড়াকড়ি চলছে। তাই দশদিন ধরে কাজ যেতে পারেনি। জমা টাকায় ৪/৫দিন সংসার চললেও গত কয়েকদিন কার্যত অনাহারে ছিলেন শিশুসহ পরিবারের সদস্যরা। এ সময় তারা সরকারি অথবা বেসরকারি সহায়তা পাইনি। কেউই খোঁজ নেয়নি।
১০ এপ্রিল বিকেলে আফরোজা কয়েক দফা খাবার চেয়েছে তার বাবার কাছে। খাবারের বদলে শুনতে হয় ধমক। একদিকে ক্ষুধার যন্ত্রণা অপরদিকে বাবার ধমক। কষ্টে আফরোজা আত্মহত্যা করে।দশ বছরের আফরোজা খাতুন করোনা সংকটে আত্মহত্যা করেছে খাবারের জন্য! এইটা সত্যি একটা ইতিহাস হয়ে থাকলো। এই ইতিহাসের দায় সেইসব চাল চোরদের, দলীয় নেতাকর্মীদের, তথা সরকারের। এই দায় থেকে মুক্তি কখনোই মিলবে না।
২০২০ সালের ৩১শে মার্চ থেকে ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক একটি জরিপ চালায়। ৬৪ জেলায় ২ হাজার ৬৭৫ জন নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে তারা জরিপ পরিচালনা করে। তাদের জরিপ বলছে, নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঘরে থাকার নির্দেশনা মানতে গিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমছে এবং তাদের ১৪ শতাংশের ঘর খাবার শূন্য হয়ে পড়েছে।
তবে কি আমরা ধরে নিবো, দশ বছরের আফরোজা খাতুনের মতো এই ১৪ শতাংশ মানুষও না খেয়ে মারা যাবে। আশা করি তখনো চাল চোরদের বোধদয় হবে না। এইসব জঘণ্য সংবাদ শুনতে শুনতে কবিগুরুর মতো আমিও বলবো,
“আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব–
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব।।”