Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেমন হবে করোনা পরবর্তী পৃথিবী


২২ এপ্রিল ২০২০ ১৮:২০

করোনা পরবর্তী পৃথিবী কেমন হবে? সবকিছু কি আগের মতো থাকবে? নাকি পুরোপুরি বদলে যাবে? আমাদের সামাজিকতা, পারিপার্শ্বিকতা, আচরণ, ব্যবহার, সম্পর্কের ধরন কেমন হবে?

এই বিষয়ে অনেক তাত্ত্বিক গবেষণা হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক তথ্যচিত্র। তবে আমি আলোচনা করব আমার, আপনার মতো সাধারণ মানুষদের ভাষায় সেই দিনগুলো কেমন হতে পারে তার একটি ভাষাকল্প।

হাত মেলানো, কোলাকুলি

কল্পনায় গিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে ভাবুনতো কয়েক মাস পরের কথা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শেষ হলেও আপনি কি আর স্বাভাবিকভাবে আগের মতো করে কারো সাথে হাত মেলানো কিংবা কোলাকুলি করতে পারবেন?

বন্ধুর সাথে দেখা হলেই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরা, অফিসে ঢুকেই সহকর্মীর হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়া, পাড়ার ছোট ভাইটার কাঁধে হাত চাপড়ে সাহস দেয়া, কিংবা পরীক্ষায় ভালো করায় কাজিনের মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দেয়ার মতো বিষয়গুলো হয়ত আর আগের মতো ফিরে আসবে না। আমাদের আন্তরিকতা, অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ, সংস্কৃতির চালচিত্রে বড় ধরণের পরিবর্তন আসবে বা এসে গেছেই তা লক্ষণীয়।

পাল্টে যাবে দেখা করার গল্পও

গত দশ বছর ধরেই সীমিত আকারে অনলাইন কনফারেন্স কল চলছে বাংলাদেশে। যাতায়াতের খরচ, ভিসা প্রাপ্তির সমস্যার কথা চিন্তা করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনলাইনে কাজ করিয়ে নেয়ার নানা উপায় বের করে নিয়েছেন। বাংলাদেশেও সেসবের ব্যবহার হচ্ছে বেশ। অফিসের সহকর্মীদের মধ্যে দ্রুত আলোচনা সেরে নেয়ার জন্য হোয়াটসঅ্যাপ, বন্ধুদের সাথে ঈদে ঘোরাঘুরির ছক ঠিক করার জন্য ভাইবারে আড্ডা, সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অফিসের সহকর্মীদের সাথে মিটিং করার জন্য স্কাইপ কিংবা জুমের ব্যবহার ইত্যাদি শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। তবে সেটা খুব বড় আকারে না। অনেক আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দেখা সাক্ষাতের মাধ্যমে হয়ে আসছে।

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাসের কারণে অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে যাবে বইকি ইতিমধ্যেই বেড়ে গেছে। আগামীতে সময় বাঁচানোর জন্য মানুষ সামনাসামনি দেখা-সাক্ষাত এড়িয়ে যাওয়ার এই বিকল্পকে বেশী বেছে নিবে- এটা বলাই বাহুল্য। মিটিং, সেমিনার ইত্যাদিতে অংশ নিতে ৩-৪ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া, নাস্তা-পানি-দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা, ব্যানার-পোস্টার বানানো ইত্যাদি ঝামেলা কমে আসবে-বলাই বাহুল্য।

অনলাইন যোগাযোগে সময় ও অর্থ ব্যয় কমে আসবে। তাছাড়াও শারীরিক নৈকট্যের মাধ্যমে রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়া রোধ, কিংবা কোন বিষয়ে খোলা মনে মতামত প্রকাশের প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি বিবেচনা করবে আগের চাইতে অনেক বেশী। অনলাইন, ফোন কল, জুম, স্কাইপ কিংবা চ্যাট হয়ে যাবে নতুন দিনের ‘চলো দেখা করি’।

অফিসের সময়ঘণ্টা পাল্টে যাবে

সপ্তাহে ৬ দিন, সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা অফিস- দেশ ও জাতির জন্য কতটা জরুরী? ১৯৯৬ সালের যখন বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি ১ দিন থেকে বাড়িয়ে ২ দিন করার আলোচনা শুরু হয়েছিল, তখন চারিদিকে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। আলোচক-সমালোচকদের মুখে তখন ‘বাংলাদেশ গরীব দেশ, সম্ভব হলে প্রতিদিনই কাজ করা দরকার, এমন সব আলাপ শুনেছি বহুবার। শুনে আসছি- অফিসে নির্ধারিত সময়ের পর যারা যতক্ষণ বেশী থাকেন, তাদের মূল্যায়ন তত বেশী। পরিবারকে সময় দেবার চাইতে সময়টুকু অফিসকে দেয়া যেন আমাদের সমাজে ‘পারফরমেন্স ইন্ডিকেটর’।

রাত ১২টায় মেইল আসলে আপনি যদি রাত ১টায় উত্তর দিয়ে দেন, তবে আপনি বেশী দক্ষ অফিসার। অথচ এই অতিরিক্ত কাজ যে মূলত আপনার পারফর্মেন্সে ক্ষতি করে, আপনার মানসিক স্বাস্থ্যকে ভঙ্গুর করে, অফিসে বেশী সময় ব্যয় করার জন্য আপনি পরিবার বা বন্ধুদের সময় দিতে না পেরে, তাদের কাজ থেকে দূরে সরে যান, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন, ফলে অফিসের কাজ ভালোভাবে করতে পারেন না, এই বিষয়গুলো আমাদের দেশে অন্তত খুব কম প্রতিষ্ঠানই বোঝে।

বিজ্ঞাপন

করোনার কারণে অফিসের কাজ যেহেতু অনলাইনেই চালিয়ে নেয়া যাচ্ছে, আগামীতে হয়তো অফিসে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেবার প্রবণতা কমে আসবে বলে ধারণা। অতিরিক্ত কাজ করা যে আসলে ভালো নয়, বরং সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন, সেই আত্মপোলব্ধি হবে অনেক প্রতিষ্ঠানের। ‘হোম অফিস’ আসলে কাজের গতি বাড়িয়ে দেয় সেটি বুঝে এর প্রচলনও বাড়বে অনেক। ঘরে বসে কাজ করাকে উৎসাহিত করে জ্যাম, যাতায়াত খাতে সময় ও অর্থ ব্যয় কমানো সম্ভব হবে। ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্টাফকে রোস্টারে কাজ করিয়ে ছোট অফিস ভাড়া নিয়ে সাশ্রয়ও করার প্রচলন শুরু হবে ধীরে ধীরে।

কমে আসবে অস্ত্রের ঝনঝনানি

দেশপ্রেমের জন্য সীমান্তে যুদ্ধ করাই একমাত্র উপায় নয়, অস্ত্রের চাইতে স্টেথোস্কোপ ভালো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সারাবিশ্বে অস্ত্রের যে ঝনঝনানি, সীমান্তে সীমান্তে মানুষ হত্যার ধ্বংসযজ্ঞ- তার বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। করোনা-উত্তর পৃথিবীতে এই প্রতিবাদ আরও উত্তাল হবে। খাবার, ওষুধ না কিনে সরকারের অস্ত্র কেনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আরও প্রতিবাদী হবে জনগন। জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসাবিদ্যায় অর্থ বরাদ্দ না দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র, সামরিক যানবাহন কেনার ক্ষেত্রে সরকার তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধ থেকে শুরু করে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ও সামরিক বাহিনীকেই যেখানে মূলত দেশপ্রেমের মূল ধারক ভাবা হতো, সেখানেও আমূল পরিবর্তন হবে। চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, গবেষক, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, নার্স ইত্যাদি পেশার মানুষরাই হয়ে উঠবেন দেশপ্রেমের মূল প্রতীক। আমাদের সমাজে নার্সদের তেমন সম্মান করা হয় না, আগামীতে নার্সসহ হাসপাতালকর্মীদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হবে, সম্মান করা হবে। সেনাবাহিনী, পুলিশসহ অন্যান্য সশস্ত্রবাহিনীর গুরুত্ব বাড়বে দেশের আভ্যন্তরীণ সেবাকার্যে, সীমান্তে অন্য দেশের সাথে লড়াইয়ের জন্য নয়।

নারীনেতৃত্বই হবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

হাজার বছর ধরে চলে আসা পুরুষ নেতৃত্বের জায়গা ছেড়ে দেবার সময় এসেছে বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরেই আমরা দেখে আসছি, নারী- নেতা হিসেবে ভালো, ধীরস্থির, অবিচল-কঠিন এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা, সারাবিশ্বের পররাষ্ট্রনীতিতে হিলারি ক্লিনটনের দাপট, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেলের দৃঢ়তা, ভারতের স্থানীয় রাজনীতিতে মমতা ব্যানার্জির সাহসিকতা, সন্ত্রাস ও মৌলবাদ দমনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্ডা আরডার্নের অবিচল অবস্থান মানুষকে সাহস জুগিয়েছে।

বর্তমানে করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে তারা ছাড়াও সবচেয়ে সফল নেতৃত্বের জন্য ডেনমার্কের মেটে ফ্রেডেরিকসেন, আইসল্যান্ডের ক্যাটরিন, নরওয়ের আর্না সলবার্গ, তাইওয়ানের সাই ইং ওয়েন এবং সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী ফিনল্যান্ডের সানা মার্টিন প্রশংসিত হয়েছেন- যারা সকলেই নারী।

অন্যদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর কিন্তু করোনা মোকাবেলায় সমালোচিত ও ব্যর্থ নেতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন- যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যের বরিস জনসন, চীনের শি জিনপিং– সবাই পুরুষ। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে নাম নেয়া যায় ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর।

শুধু রাজনীতিতেই নয় সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন চিকিৎসা ও নার্সিংয়ে নারী কর্মীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। উন্নত দেশগুলোর গ্রোসারি স্টোর ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় জরুরী সেবাদানে নারীর ভূমিকাই অগ্রগণ্য। এছাড়া করোনা সংক্রমণের তথ্য বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় আক্রান্তের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ নারী। তাই সার্বিক বিবেচনায় করোনা-উত্তর পৃথিবীতে নারী নেতৃত্বে সুখ ও সমৃদ্ধি আসবে বলে প্রতীয়মান হয়।

একক আধিপত্য হারাবে যুক্তরাষ্ট্র

পৃথিবীতে বড় বড় নানা ঘটনার পর পরাশক্তির যে হিসেব-নিকেশ হয় তাতে বড় ধরণের পরিবর্তন হয়। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর পর বিশ্বক্ষমতার মানচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ১৯১৪ সালের আগের অপরাজেয় ক্ষমতাধর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ফ্রান্স সাম্রাজ্য তাদের আধিপত্য কিছুটা বজায় রাখতে পারলেও জার্মান সাম্রাজ্য, অষ্ট্রিয়া-হাংগেরি সাম্রাজ্য এবং রুশ সাম্রাজ্য ব্যাপকভাবে তাদের আধিপত্য হারায়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য, ইটালি, ফ্রান্স একচেটিয়াভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে দীর্ঘদিনের ক্ষমতা হারায়। এরপর স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নও দাপট হারায় আমেরিকার কাছে। গত প্রায় তিন দশক আমেরিকা সেই দাপট ধরে রাখলেও চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হচ্ছে। এবার আমেরিকার একক দাপটে আঘাত হানবে বৈশ্বিক সমষ্টিক শক্তি। করোনা-উত্তর পৃথিবীতে চীন ও রাশিয়া আমেরিকার একক দাপটের অবসান ঘটাবে এবং বিশ্ব অন্তত নিকট ভবিষ্যতের জন্য সুপার পাওয়ার কনসেপ্ট থেকে বের হয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে।

করোনার কারণে সামরিক শক্তির বিবেচনা থেকে সরে এসে পৃথিবীর সব দেশ যেভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে তা প্রশংসনীয়। এই করোনার কারণেই পৃথিবী দেখেছে কীভাবে আমেরিকা অন্য দেশের চিকিৎসা পণ্য ছিনতাই করে, পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী, চিকিৎসক থাকা সত্বেও করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়; কীভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট বিশ্বকে আশ্বস্ত করা তো দূরে থাক, প্রতিবেশী ক্যানাডার সাথে সুসম্পর্ক রাখতে ব্যর্থ হয়; কীভাবে নিজের দেশের মানুষের আস্থা বজায় রাখাও তার জন্য দুরূহ কাজ হয়ে উঠে! এটি মনে রাখা জরুরী যে, মহামারী কোন ভৌগলিক সীমারেখা মানে না।

সার্বিক বিবেচনায় করোনা-উত্তর সব দেশই তাদের প্রতিবেশী দেশ ও অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক পুনরায় ঝালিয়ে নেবে। আমরা নানা রকম নতুন অর্থনৈতিক, সামাজিক বলয় দেখতে পাবো, যেখানে আমেরিকা আর আগের মতো তাদের পরাশক্তির ভূমিকা বজায় রাখতে পারবে না।

নেতৃত্বে আসবেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা

রাজনীতিবিদদের শুধুমাত্র রাজনীতিতে নয়, বিভিন্ন বিষয়ে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা থাকতে হয়। করোনা তা বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের। করোনা পরিস্থিতিতে আমরা দেখছি, কিছু কিছু বিষয়ে অযোগ্যদের নেতৃত্ব দেবার কারণে নানা সংকটের তৈরি হয়েছে। করোনা সংকট চিন্তার বেশি জটিল আকার ধারণ করার পেছনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অকার্যকর ভূমিকা স্পষ্ট।

বাংলাদেশে আমরা দেখেছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব একজন চিকিৎসক কিংবা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের হাতেই থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব এমন কারো কাছে থাকতে হবে যিনি চিকিৎসক, নার্স, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একসাথে করে, তাদের মতামত ও প্রস্তাব বিবেচনা করে দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

বলা হচ্ছে করোনা চিকিৎসায় জার্মানি যতটুকু সাফল্য পেয়েছে, তার মূলে আছে তাদের চ্যান্সেলর, যিনি বিজ্ঞানী। অতিতে সেই পেশায় কাজ করেছেন।

সঠিক মানুষটিকে সঠিক জায়গায় না বসানোর অভিজ্ঞতা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আছে। সামনের দিনগুলোতে বিশেষজ্ঞ, গবেষক, শিক্ষক, বিজ্ঞানীরা তাদের যোগ্য স্থান ফিরে পাবেন এবং তারাই এগিয়ে নেবেন পৃথিবীকে।

ধর্মবিশ্বাস ও চর্চায় আসবে পরিবর্তন

সব ধর্মেই ‘শান্তির’ কথা বলা হয়েছে, কিন্তু গত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়- শান্তির চেয়ে যুদ্ধে ধর্মের ব্যবহার বেশী। গত কয়েক’শ বছরের সবগুলো যুদ্ধের শত্রু-মিত্রও মূলত নির্ণয় হয়েছে ধর্মকে কেন্দ্র করে। গত কয়েক হাজার বছরে একেক শতাব্দী দখলে রেখেছে একেক ধর্মের অনুসারীগণ। ফলশ্রুতিতে ওইসব সময়ে অন্যান্য ধর্মের মানুষ ভয়াবহ অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন।

করোনা সব ধর্মের খুঁটিই বেশ নড়বড়ে করে দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে কখনো ধর্মের প্রার্থনার দরজা যেমন- মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা একসাথে বন্ধ হয়নি। আবার একই সময়ে ধর্মের গোঁড়ামির কারণে একই সাথে এতো বেশী মানুষ মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়েনি।

করোনা-উত্তর পৃথিবীতে ধর্মগুলোর আধুনিকরণ হবে। ধর্মীয় উপসানয়গুলোতে শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে, বিকল্প পন্থায় ধর্মের আচার পালনের বিষয়গুলো আলোচিত হবে, এবং তা অনেক জায়গায় বাস্তবায়নও হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানভিত্তিক যে বিনিয়োগ তা কমে এসে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগে মানুষ বেশী আগ্রহী হতে পারে বলে ধারণা হচ্ছে।

মানুষের ধর্ম বিশ্বাস ও চেতনায়ও পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা প্রবল। মোল্লা, পুরোহিতদের কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করা কমে আসবে। মানুষ নিজের ধর্মগ্রন্থসহ অন্যের ধর্মগ্রন্থ ও গবেষণাপত্র পড়ে নিজের ধর্মের বিশ্বাসগুলোকে ঝালিয়ে নেবে। ধর্মীয় অজ্ঞতা ও গোঁড়ামির মূলে আঘাত আসবে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে।

অন্যদিকে কোথাও কোথাও ধর্মীয় গোঁড়ামি আরো শক্তিশালী হবে। সুতরাং একদিকে যখন আগামীর পৃথিবী নানাদিক থেকে প্রগতিশীল ও সহনশীল হবে, ঠিক তখন কোথাও কোথাও আরো বেশী ধর্মীয় সন্ত্রাস, লড়াই ও ঘৃণা বেড়ে যাবে- এমনটা আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পারিবারিক দূরত্ব কমবে, জয় হবে ভালোবাসার

গত কয়েক’শ বছর ধরে মানুষ নানা কারণে পারিবারিক কাঠামো থেকে সরে এসে ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল। বাবা-মার সাথে সন্তানের, নানী-দাদীর সাথে নাতি-নাতনীর, চাচা-মামাদের সাথে ভাগিনা-ভাতিজির দূরত্ব বেড়ে গেছে চোখে পড়ার মতো। মানুষ ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা বিবেচনা করে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছিল। জাগতিক সুখ-বিলাসের কারণে মানুষ তাদের আত্মীয়-স্বজনদের থেকে দূরে সরে গেছে অনেকটাই। কয়েক’শ বছর আগে পশ্চিমা বিশ্বে শুরু হওয়া এই সংস্কৃতি আস্তে আস্তে খুঁটি গেড়েছে আমাদের উপমহাদেশেও।

করোনার এই সময়েও আমরা দেখেছি কিছু মর্মান্তিক চিত্র। বৃদ্ধ বাবা-মাকে বনে জঙ্গলে ফেলে এসেছে পাষাণ সন্তানেরা। অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নিতে চায়নি কেউ। করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির জানাজায় উপস্থিত হবার জন্য অনুরোধ করেও পাওয়া যায়নি কোন আত্মীয়স্বজনকে। অন্যদিকে অসুস্থ সন্তানকে কেউ অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে রাজি হয়নি বলে বাবা তাকে কাঁধে নিয়ে গেছেন। আবার এও দেখেছি, অজানা অচেনা পুলিশ উপস্থিত থেকেছে মৃত ব্যক্তির জানাজায়। কোথাকার কোন মানুষকে পরম মমতায় চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন ডাক্তার ও নার্স। এটা তো সত্যি যে, রাত তিনটায় যিনি আপনাকে হাসপাতালে নেবেন, তিনিই আপনার আপনজন।

নতুন পৃথিবীতে মানুষের সম্পর্কে ভিত্তি হবে ভালোবাসা। পারিবারিক দূরত্ব আবার আস্তে আস্তে কমে আসবে। চাকচিক্যের এই পৃথিবীতে কে কাকে গাড়িতে ঘোরাতে নিয়ে যায়, কে কাকে ফাইভ স্টার হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে যায়, এবং তার পেছনে কাজ করা ভোগবাদী আগ্রহগুলো পরিষ্কার ধরা পড়বে সবার চোখে। নতুন পৃথিবীতে বাবা-মা, সন্তান, আত্মীয়েরা আবার কাছাকাছি হবে। মানুষ অনুধাবন করবে রাত তিনটায় যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দ্বিধা করে না, সেই আসল স্বজন, প্রকৃত পরিবার।

করোনা একদিন শেষ হবে। যারা বেঁচে থাকবেন, তাদের মনে থাকবে জ্বলজ্বলে স্মৃতি। করোনার সময়ে আপনি অন্যদের প্রতি কতটা মানবিক ছিলেন, আপনার সাথে বেঁচে থাকা মানুষগুলোই কেবল তা মনে রাখবে- তা নয়, মনে রাখবে আপনার সন্তান, আপনার পরিবার, প্রতিবেশী এবং আপনার নিজের সত্তা।

লেখক: সোশাল এন্ড বিহেভিয়েরাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টো

করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর