করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য
২৪ এপ্রিল ২০২০ ১৬:৪৯
বছরের শুরুতেই আমরা নতুন বছরের রেজ্যুলেশন করে নিয়েছিলাম। নিজের কাছে করেছিলাম কত রকমের প্রতিজ্ঞা, পণ। স্বাভাবিকভাবেই চলছিল সবকিছু। বছরের শুরুতেই চীনের উহানের ভাইরাসের খবর হালকা ধাক্কা দিলেও তখনো ঠিক টনক নড়েনি আমাদের।
করোনা নামক বৈশ্বিক মহামারী যখন বাংলাদেশে শনাক্ত হলো, তখন হঠাৎ করেই স্থবির হয়ে গেল স্বাভাবিক জীবন। দুশ্চিন্তা, ভয়, আতঙ্ক সব একসাথে ভর করল আমাদের। নিজে কী করব, পরিবারের কী হবে, বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনের কী হবে, কাজের প্রয়োজনে বাইরে বের হলে কী হবে, জরুরি সেবাপ্রদানকারী পেশার মানুষদের কী হবে ইত্যাদি ইত্যাদি-সব মিলিয়ে দুশ্চিন্তা অতি উদ্বেগে রূপ নিয়েছে।
অস্থিরতা, আতঙ্কিত হওয়া- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সবই স্বাভাবিক মহামারির সময়ে।
একটা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বোঝানো যাবে বর্তমানে মানুষের মনের অবস্থা- কয়েকদিন আগে মাঝরাতে উৎকন্ঠা নিয়ে একজন নারী কল করেছিলেন ‘মনের বন্ধু’র (মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান) হটলাইনে। করোনা নিয়ে খু্ব আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। রাতেও তার ঘুম আসছে না। সারারাত নিজের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, ভয়ে কাঁদেন। কীভাবে তিনি এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন বুঝতে পারছিলেন না। তখন ফোনের এ প্রান্তে থাকা ‘মনের বন্ধু’র মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন কীভাবে তিনি উদ্বিগ্নতা কমাবেন। প্রতিদিনই এমন ফোন কল করছেন অনেকেই।
ইউএনডিপির সহায়তায় ২৪ ঘন্টা ‘মনের বন্ধু’ বিনামূল্যে টেলি ও ভিডিও কাউন্সেলিং সেবা দিচ্ছে। হটলাইনে দিন-রাত প্রচুর ফোন আসে, ইনবক্সে লিখছেন তাদের মনের অবস্থা। তারা সাহায্য নিচ্ছেন মনোবিদদের। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে এমন পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের করোনাআক্রান্ত সবখানেই। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ, বিশ্বখ্যাত তারকাদের ছবি, ভিডিও দেখলে বোঝা যায় তারা করোনা পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন।
আরেকটি বিষয় নিয়ে আমাদের নিজেদের সাথে নিজেদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সেটি হলো- আমরা দীর্ঘ সময় বাড়িতে থেকে অভ্যস্ত না। এটা আমাদের কাছে একরকম যুদ্ধের মতো। রুটিন মাফিক বাইরে বের হয়ে কাজকর্ম শেষ করে আবার ঘরে ফেরার অভ্যাস আমাদের। করোনা আমাদের সেই অভ্যাসে হানা দিয়েছে।
বাধ্য হয়ে ঘরে থাকার কারনে নানারকম অনিশ্চয়তা ভর করছে মনে। ‘চাকরিটা থাকবে তো? কবে ঘর থেকে বের হতে পারবো? পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হবে না তো?’এমন হাজারো প্রশ্ন মনে ভিড় করে, ভয় লাগতে শুরু করে।
ঘরে থাকার কারনে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগে সময় একটু বেশি কাটাচ্ছেন। টুইটার, ফেসবুকে খবর দেখছেন কমবেশি সবাই, কোনটি ভুল-কোনটি সঠিক, মিথ্যা ভুয়া সংবাদেও আতঙ্ক বেড়েই যাচ্ছে। রাতে ঘুমাতে পারছেন না অনেকে। ভোরের দিকে ঘুমাচ্ছেন, দুপুরে ঘুম থেকে উঠছেন কেউ কেউ। যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
যে কোনো বৈশ্বিক মহামারী চলাকালীন সময় ও পরে মানসিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। কেননা, সেই সময়ে মনের ওপর খুব চাপ পড়ে। সেই মারাত্মক মানসিকচাপগুলো অনেক সময় অনেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, কমাতে পারে না। বিপত্তি ঘটে তখনই। তাই মনের ও মনোজগতের ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে সবারই।
একেক জন একেকভাবে নিজের ভালোলাগা খুঁজে নেন। নিজের মতো করে চাপমুক্ত থাকার উপায় বের করে নেন। তাই নিজের ভালোলাগাগুলো খুঁজে বের করে রুটিন করে নিতে হবে।
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা থেকে অন্যদের সাথে রাগারাগি, ধুমপান বা অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্যের দিকে ঝুঁকবেন না। বরং যদি এগুলোর অভ্যাস থাকে তাহলে এখনই ছেড়ে দেওয়ার্ উপযুক্ত সময়। এসব কোনোভাবেই আপনার অস্থিরতা কমাতে পারবে না। বরং বাড়িয়ে দেবে।
মহামারী, সংকটে ইতিবাচক থাকাটা সত্যিই কঠিন, কিন্তু জরুরী। ইতিবাচক থাকতে না পারলে আপনি নিজের জন্য ও অন্যের জন্য যা করতে চান, সেগুলো ঠিকভাবে করতে পারবেন না। সেকারণে নিজেকে ভালো রাখা খুব জরুরি। এ ছাড়া আরও যা করতে পারেন:
- নিজের জন্য একটা রুটিন তৈরি করে নিন। চেষ্টা করবেন সেটা মেনে চলতে। তবে সেটা করতে গিয়ে যেন মনের ওপর চাপ না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাবেন ও উঠবেন। পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে।
- যারা বাড়ি থেকে অফিস করছেন তারা কিছুক্ষণ পরপর ২ মিনিটের জন্য হলেও উঠে দাঁড়াবেন। ল্যাপটপ, কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ সরাবেন। বাড়ি থেকে অফিস করলেও পরিষ্কার পরিপাটি পোশাক পরবেন।
- বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা, লেখালেখি করা-যার যা ভালো লাগে তাই করুন। এমন অনেক কাজ আছে, যেগুলো আগে কখনো করেননি বা করার সুযোগ হয়নি, সেগুলো করার চেষ্টা করতে পারেন এখন। তাতে ক্ষতি তো কিছু নেই।
- নিজের দক্ষতা বাড়াতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন কোর্স করতে পারেন। পেয়ে যাবেন সার্টিফিকেট। এমন সুযোগ হয়তো পরে আর নাও পেতে পারেন। ঝালিয়ে নিতে পারেন নিজের সুপ্ত প্রতিভাগুলো।
- যাদের পরিবারে শিশু ও বয়স্কব্যক্তি আছেন, তাদের প্রতি বাড়তি যত্নশীল হবেন। শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দিন। ভুল তথ্য দিয়ে শিশুকে আতঙ্কিত করবেন না। বরং শিশুর উপযুক্ত করে তাকে সঠিক তথ্য দিন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম বেশ কার্যকরী। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও বলেছে, মানসিক চাপ কমাতে দিনে অন্তত দুইবার করে মেডিটেশন করা ভালো।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় শরীরের সুরক্ষার পাশাপাশি মনের সুরক্ষাও জরুরী। এর কোনো বিকল্প নেই। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে যেমন সচেতন থাকতে হবে, মানসিকভাবে সুস্থ থাকতেও তেমনটাই সচেতন থাকতে হবে। দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
করোনা পরিস্থিতিতে আপনাদের মানসিক চাপ মোকাবিলার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু’ কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি মেডিটেশন, আর্টথেরাপি, কর্মক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো, মানিয়ে নেওয়া, রাগ নিয়ন্ত্রণসহ ভালো থাকার বিভিন্ন বিষয়ে অনলাইন সেশন ও ফেসবুক লাইভ আয়োজন করছে। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন। মেডিটেশন বিশেষজ্ঞ ও মনোবিদেরা আতংক কমানো, উদ্বিগ্নতা কমানো ও মন শান্ত রাখার জন্য বাংলায় গাইডেড মেডিটেশন, মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন তৈরি করেছেন। ঘরে বসে করতে পারেন এমন যোগব্যায়ামের টিপসও দেওয়া হচ্ছে মনের বন্ধুর পক্ষ থেকে।
অনেক সময় আমরা প্রকৃতির প্রতি, নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি ও আশপাশের ছোট ছোট উপাদানের প্রতি কৃতজ্ঞ প্রকাশ করি না। আমরা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য থ্যাংকফুল মেডিটেশন, গ্রাটিচুড মেডিটেশন চর্চা করি তাহলে জীবন নিয়ে আমাদের অভিযোগ কমে আসবে। ইতিবাচক ভাবনা দিয়ে নিজেদের ভাবনার জায়গাগুলো আরও সুসজ্জিত হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বৈশ্বিক এই মহামারীর সময়ে নারীদের প্রতি সহিংসতা বেড়ে গেছে। এটা সত্যিই খুব আশঙ্কার ও হতাশাজনক। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। ঘরের সব কাজের দায়িত্ব তার কাঁধে না দিয়ে সবাই মিলে ভাগ করে কাজ করতে হবে। অনেক নারীকেই বাড়ি থেকে অফিস ও সংসারের কাজ দুটোই সামলাতে হচ্ছে-পরিবারের সদস্যদের তাঁদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে।
আতঙ্ক, হতাশা, অস্থিরতা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা দেখা দেয় কারো কারো। এমনটা অনুভব হলেই মনোবিদ বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। পরিবারের মানুষদেরও এ বিষয়ে বাড়তি সচেতন ও সর্তক থাকতে হবে।
‘মনের বন্ধু’র মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী, কাউন্সেলরেরদের মতো সারাবিশ্বের মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সবাইকে মানসিকভাবে ভালো রাখতে।
আমরা সবাই করোনামুক্ত সুন্দর সকালের অপেক্ষা করছি। সেই নতুন দিনে পরষ্পর পরষ্পরেকে আরো ভালোবাসব, শ্রদ্ধা করব, নিজের ও পরিবারের প্রতি যত্নশীল হবো। আমাদের মানবিকগুণগুলো আরও বেড়ে যাবে, সহমর্মী হবো।
করোনাকালে ও পরে মনের যত্ন নিতে যোগাযোগ করতে পারেন ‘মনের বন্ধু’র সাথে। যোগাযোগ করতে পারেন ফেসবুকে- www.facebook.com/AskMonerBondhu
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী, মনের বন্ধু
করোনাকাল করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য তৌহিদা শিরোপা মনের বন্ধু মহামারি মানসিক স্বাস্থ্য