Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাভাইরাস টেস্ট নিয়ে সহজ কথা


২৫ এপ্রিল ২০২০ ২১:৩৯

এক জগ পানিতে এক চিমটি লবন আর একমুঠো গুড় মিশিয়ে তৈরি করা হয় ওরস্যালাইন। কি সহজ একটা ব্যাপার তাই না! বছরের পর বছর লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচিয়ে যাচ্ছে এই ওরস্যালাইন। কিন্ত এমন সহজ সমাধান বের হওয়ার আগের অবস্থার কথা ভেবেছেন কী?

সীমিত সামর্থ্যের বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বেলাতেও নিশ্চই এমন সহজ সমাধানের অপেক্ষায় আছে মানুষ। তাইতো গরম পানির ভাপ, লেবু চা, তাপমাত্রা তত্ব বা গণস্বাস্থ্যের ৩০০ টাকার টেস্ট কিটের মতো যেদিকেই মিলছে সহজ সমাধান সেদিকেই ঝুঁকছে মানুষ। কে জানে করোনাভাইরাসের বিপরীতেও হয়তো আছে এমন কোনো সহজ সমাধান! কিন্তু বাস্তবতা হলো সহজ কোন সমাধান এখনো জানা নেই কারো।

বিজ্ঞাপন

ডায়রিয়া বা কলেরায় ব্যবহৃত ওরস্যালাইন যখন আবিষ্কার হয়নি, তখন এসব রোগেও মারা গেছে অনেক মানুষ । বছরের পর বছর গবেষণার পরই পাওয়া গেছে সহজ সমাধান।

আপাতত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার একটাই পথ। তা হলো- আক্রান্ত রোগীদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সংক্রমণ রোধ করা। আর কে আক্রান্ত বা কে আক্রান্ত নয় জানতে প্রয়োজন ল্যাব টেস্ট। এর বিকল্প কোন পথ নেই।

আরটি পিসিআর টেস্ট করে রোগীর শ্বাসতন্ত্রীয় নমুনায় ভাইরাসের আরএনএ সনাক্ত করার মাধ্যমে রোগী করোনায় আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। আরটি পিসিআরই করোনাভাইরাস সনাক্তকরণে আদর্শ পদ্ধতি। এখন পর্যন্ত এ টেস্টের আর কোনো ভালো বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। অ্যান্টিবডি ভিত্তিক কিছু টেস্ট আছে যা বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ অ্যান্টিবডি ভিত্তিক টেস্ট করছে বলে জানা যায়।

চীন থেকে অ্যান্টিবডি ভিত্তিক টেস্ট সামগ্রী বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। অ্যান্টিবডি ভিত্তিক টেস্টের সুবিধা হলো- এসব টেস্ট ল্যাবের বাইরেও করা যায়। অনেক টেস্ট আছে প্রেগন্যান্সি টেস্টের মতো বা ব্লাড গ্লুকোজ টেস্টের মতো, নিজে নিজেই করা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে সঠিকভাবে রোগের ডায়াগনোসিস করা যায় না। কারণ শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরী হতে কিছুটা সময় লাগে যা রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার পর এক থেকে দু‘সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। কাজেই অ্যান্টিবডি টেস্ট নেগেটিভ হলে নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে রোগী আক্রান্ত হয়নি। আরেকটি সমস্যা হলো- অ্যান্টিবডি টেস্টের গুণগত মান সবসময় ঠিকঠাক থাকে না। ইতিমধ্যে স্পেন এবং ভারত এ ধরণের লক্ষ লক্ষ টেস্ট কিট কিনে রোগের ভুল ডায়াগনোসিসের খেসারত দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এসব অ্যান্টিবডি ভিত্তিক টেস্টের কি কোনো উপযোগীতা নেই? উত্তর হলো আছে। এসব টেস্টেরও উপযোগিতা আছে। যেমন কোনো এলাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হচ্ছে কিনা তা বুঝতে এসব টেস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যাপক হরে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মধ্যে জনসংখ্যার কতভাগ করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে তা বুঝতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার করোনাভাইরাস রোগে কাউকে প্লাজমা থেরাপি দিতে হলে, ডোনারের রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে হবে- কি পরিমান অ্যান্টিবডি তৈরী হয়েছে তার শরীরে। অনেক বেশি পরিমান অ্যান্টিবডি না থাকলে ডোনারের রক্ত থেকে পাওয়া প্লাজমা কার্যকর হবে না।

সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা যেতে পারে- ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি বিশেষ করে আইজিজি (IgG) জাতীয় অ্যান্টিবডি তৈরী করার মাধ্যমে। যেসব রোগী ইতিমধ্যেই ভালো হয়ে গেছেন তাদেরকে খুঁজে বের করতে। তারা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিরাপদ এবং তারা সমাজের জন্যও নিরাপদ কারণ তারা আর অন্যদের সংক্রমিত করবে না।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে একদিকে সংক্রমণ ও প্রাণহানির আশঙ্কা, অন্যদিকে দিন এনে দিন খাওয়া হতদরিদ্র মানুষের অর্ধাহারে, অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর আশঙ্কা। এ অবস্থায় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে যারা অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধি হয়ে গেছেন তাদেরকে কর্মস্থলে ফেরার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তবে তার শরীরের অ্যান্টিবডি টেস্টের গুণগত মান অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

অ্যান্টিবডি টেস্টের গুণগত মানের ব্যাপারে আরেকটা বিষয় জেনে রাখা দরকার- এই টেস্ট সাধারণত ভাইরাসের প্রোটিন বা এন্টিজেনের বিপরীতে করা হয়। আমাদের শরীরে একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে অনেক রকম অ্যান্টিবডি তৈরী হয়। তবে সব অ্যান্টিবডিই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারে না। অ্যান্টিবডি ভাইরাসের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেয় কিনা তা নিশ্চিত করতে আরেক ধরণের টেস্ট রয়েছে যাকে বলা হয় সেরাম নিউট্রিলাইজেশান পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় রোগীর শরীরের সেরাম নিয়ে ল্যাবে ভাইরাসের কালচারের সাথে পরীক্ষা করে দেখা হয়, দেখা হয় রোগীর শরীরের অ্যান্টিবডি ভাইরাসকে নিউট্রিলাইজ করতে পারে কিনা। কিন্তু এ পরীক্ষা অনেক কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই সবচেয়ে ভালো হলো অ্যান্টিবডিভিত্তিক টেস্টকে বাজারজাত করার আগেই সেরাম নিউট্রিলাইজেশান পরীক্ষার সাথে তুলনা করে নেওয়া । সেরাম নিউট্রিলাইজেশান পরীক্ষার সাথে তুলনায় শতকরা ৯৫ ভাগ বা এর উপরে সেনসিটিভিটি ও স্পেসিফিসিটি পাওয়া গেলে বুঝতে হবে এসব টেস্ট এর গুণগত ম্যান ভালো এবং এসব টেস্টের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া বা রোগীর ইমমুনিটি পরীক্ষা করা নিরাপদ।

তবে আসল কথা হলো, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অ্যান্টিবডি ভিত্তিক টেস্ট নির্ভরযোগ্য নয়, আরটি পিসিআর টেস্টের উপরই নির্ভর করতে হবে আমাদের। নির্ভরতার কারনেই বিশ্ব জুড়ে আরটি পিসিআর টেস্টের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে দেখা দিয়েছে টেস্ট কিট ও রিএজেন্ট সংকট। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়।

এ পরিস্থিতিতে বিকল্প কি? প্রথমে জানা প্রয়োজন যে আরটি পিসিআর হলো একটা টেকনিক মাত্র। মূল বিষয় হলো ভাইরাসের আরএনএ সনাক্ত করা। প্রথমে স্যাম্পল থেকে আরএনএ এক্সট্রাকশন করা হয়। তারপর আরটি পিসিআর করা হয়। আবার ভাইরাসের আরএনএ সনাক্ত করার জন্য আরটি পিসিআরই একমাত্র পদ্ধতি নয়, যদিও আরটি পিসিআরই আদর্শ পদ্ধতি।

স্বাভাবিক অবস্থায় ক্লিনিক্যাল টেস্টিংয়ের জন্য আদর্শ পদ্ধতি ব্যবহার করাই কাম্য। কিন্তু দুর্যোগকালীন সময়ে বৃহত্তর স্বার্থে বৃত্তের বাইরে ভাবা প্রয়োজন। যেকোনো ক্লিনিক্যাল টেস্টের মূল বৈশিষ্ট হলো এর সেনসিটিভিটি ও স্পেসিফিসিটি। টেস্ট পদ্ধতিকে যে কোনো পরিবর্তন আনতে হলে তার আগে যাচাই করে দেখতে হবে মূল টেস্টের সেনসিটিভিটি ও স্পেসিফিসিটি প্রভাবিত হচ্ছে কিনা।

কয়েকদিন আগে আমাদের ল্যাবে আরএনএ এক্সট্রাকশন কিট শেষ হয় যায়, তথন আমরা বিকল্প পদ্ধতি ও রিএজেন্ট বের করার চেষ্টা করতে থাকি। অনেক চেষ্টায় পর একটা সহজ সমাধানও মিলে যায়। আমরা দেখেছি যে স্যাম্পলের সামান্য হিট ট্রিটমেন্ট করে ও ডাইলুশন করে সরাসরি আরটি পিসিআরে ব্যবহার করা যাচ্ছে এবং এতে টেস্টের পারফরম্যান্স খুব একটা প্রভাবিত হচ্ছে না। ১৩২ জন রোগীর নেসোফেরিঞ্জিয়াল সোয়াব নিয়ে পরীক্ষা করে শতকরা ৯৮ ভাগের উপরে সঠিক ফলাফল পেয়েছি। করোনাভাইরাসের আরটি পিসিআর এর ক্ষেত্রে মূল খরচটা হলো আরএনএ এক্সট্রাকশনে। কাজেই আমাদের নতুন এই সরাসরি পদ্ধতিতে টেস্টের খরচ অনেক কমে যাবে। আবার এ পদ্ধতিতে টেস্টের সময়ও কমে যাবে প্রায় এক থেকে দুই ঘন্টা।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এরকম অনেক ধরণের সমাধানের কথা ভাবা যেতে পারে। আরটি পিসিআর হলো এক ধরণের নিউক্লিইক অ্যাসিড এমপ্লিফিকেশন টেস্ট। এর বাইরেও আরো অনেক ধরণের এমপ্লিফিকেশন টেকনিক রয়েছে। সেসব টেকনিক কাজে লাগিয়ে এবং সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী উপাদান ব্যবহার করে ভাইরাসের আরএনএ সনাক্ত করা যায় কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। এজন্য দেশে কর্মরত বিজ্ঞানীদের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন উদ্ভাবনী শক্তির। মলিকুলার বায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি বা মাইক্রোবায়োলজি শিক্ষক, গবেষক এমনকি ছাত্রছাত্রীরাও বের করতে পারে জটিল বিষয়ের সহজ সমাধান। সেজন্য প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগের, প্রয়োজন উৎসাহ জোগানো নেতৃত্বের। তবে যেকোনো উদ্ভাবন বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যারা টেস্ট পারফর্ম করবে তাদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখতে হবে। টেস্ট প্রয়োগের আগে ক্লিনিক্যাল টেস্ট করার সুযোগ সুবিধা ও ট্রেনিং নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: পি.এইচ.ডি., ডি (এ.বি.এম.এম.), এফ.সি.সি.এম.
ক্লিনিকাল মলিকুলার মাইক্রোবায়োলোজিস্ট, সিদরা মেডিসিন
সহকারী অধ্যাপক, ওয়েল কর্নেল মেডিকেল কলেজ, দোহা

করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর