Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হিমালয় হিমু, যার সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরু লাশের স্তূপে


২৬ এপ্রিল ২০২০ ০৯:০৬

ঢাকা: গতবছর ২৪ এপ্রিল হিমালয় হিমু গত হয়েছেন। এর ঠিক আট বছর আগে এই দিনেই হিমুর সঙ্গে আমার গল্পের শুরু। পরিচয়টা গণজাগরণ মঞ্চের সময় হলেও বন্ধুত্বটা শুরু রানা প্লাজার লাশের স্তূপে। রানা প্লাজা ধ্বসের সময়টাকে সংবেদনশীল কিছু মানুষ মনে রাখতে চাইলেও তখনকার একজন উদ্ধারকর্মী চাইবে দিনগুলোকে ভুলে যেতে। মগজে যদি ‘ইরেজ অপশন’ থাকতো তবে রানা প্লাজার সময়টাকে ইরেজ করে দিয়ে হিমু দিব্যি বেঁচে থাকতো।

বিজ্ঞাপন

উদ্ধারকর্মী বাবুকেও মরতে হতো না, বাসের হেল্পার হিসেবে কাজ করা মানিক- যে আমাদের সঙ্গেই উদ্ধার কাজ করে গেছে তাকেও কয়েক বছর অস্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হতো না। সবাই ইরেজ চেপে ভুলে যেত সব। হিমু আজকে অনেকের ফেসবুকে কিন্তু বেঁচে থাকতে কেউ নিতে চায় নি তাকে, না সমাজ, না রাষ্ট্র, এমনকি পরিবারও নয়।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হবার অবকাশ, তাই বেলা করেই উঠতাম ঘুম থেকে। সেদিনও তেমনটাই হওয়ার কথা ছিল কিন্তু অনেক ফোন কল পেয়ে উঠে পড়ি, জানতে পারি রানা প্লাজা ধ্বসের বিষয়ে। সাভার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেই। যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি আর হিমু একসঙ্গে যাই, শরিফ, কৌশিক আর জাহিদ ভাই আগেই পৌঁছে গেছে।

অন্ধকার তখনো হয়নি কিন্তু ধ্বসে পড়া রানা প্লাজার ভিতরে যেন দুনিয়ার সব অন্ধকার ভর করেছে। যাওয়ার সময় চিন্তা করিনি কি করতে হবে কিন্তু যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার আর ভাবতে হয়নি কি করতে হবে! দুইপাশের দুই বিল্ডিং দিয়ে যে যেভাবে পেরেছি ভিতরে ঢুকেছি আর একজনকে নিয়ে বের হয়েছি। দেখেছি বাইরে ছবি হাতে স্বজনদের অপেক্ষা আর ভিতরে বেঁচে ফেরার আর্তনাদ। হিমু হয়তো আত্মহননের আগে সেই আর্তনাদ শুনতে পেত, সেই আর্তনাদে হয়তো নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি সে, তাই নিজে মরার রাস্তাও বেছে নেয় আর্তনাদে।

রানা প্লাজা ধ্বসের প্রথম দিনে আমরা সবাই অভূতপূর্ব যুদ্ধের ঢাল-তলোয়ারবিহীন কিম্ভূতকিমাকার উদ্ধার যোদ্ধা। মনে হয়েছিল এই রাষ্ট্রের যেন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, বাহিনী নেই, যাদের কাছে ঢাল-তলোয়ার ছিল তারা যেন দর্শক। আমি সেদিন দেখেছিলাম জনগনের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী উর্দিপরা বাহিনীর চেয়ে কতটা শক্তিধর। সেখানে স্বেচ্ছায় ঝুঁকি নিতে আসা প্রতিটা উদ্ধার কর্মীর লক্ষ্য ছিল পরিষ্কার, লক্ষ্য ছিল একটাই- জীবন বাঁচানো।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় দিনে আমাদের সঙ্গে আরও অনেকেই যোগ দেয়, সঙ্গে এলো কিছু উপকরণ। যা দিয়ে রড কাটা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেয়ালে গর্ত করা যায়, অক্সিজেন টিউব, মাথার হেলমেট। কিন্তু আমরা কি তখনো জানতাম আমাদের লাগবে পাতলা খিঁচুড়ি, যা সুরুজ মরার আগে খেতে চাইবে, আমাদের লাগবে ফোনের পর্যাপ্ত ব্যালেন্স যা দিয়ে সাজাহান মরার আগে নিজের ছয়মাসের বাচ্চার কান্না শুনতে চাইবে। আমাদের লাগবে হাত পা কাটার জন্য সার্জিকাল করাত, জীবিত মানুষের হাত পা কাটতে হবে তা কি জানা ছিল।

আমরা কি জানতাম মানিক আমাদের বলবে, ভাই কিছু নাই তো কি হইছে চলেন হেকসো ব্লেড দিয়ে পা কাটতে পারলেও মেয়েটা বেঁচে যাবে। আমরা কি জানতাম যে মৃতদেহ বের করার জন্য হাত ধরে টান দিলে হাত ছুটে চলে আসবে। আমাদের জানা ছিল না কিছুই।

আমার জানা ছিল না মানুষের মাংস আর রক্ত পচা গন্ধ কেমন হয়। আমার জানা ছিল না হেকসো ব্লেড দিয়ে কিভাবে হাত-পা কাটতে হয়। আমার জানা ছিল না মানুষের লাশে পোকা ধরে। আমার জানা ছিল না পাশে কয়েকটা লাশের ব্যাগে লাশ রেখেও ক্লান্তিতে কি করে চোখ বন্ধ হয়। কারোই কি জানা ছিল?

এখনো অতীত ভেবে মনে প্রশ্ন জাগে- কি করে পারলাম?

পেরেছিলাম হয়তো হিমুকে দেখে, মানিককে দেখে, শরিফ, কৌশিক, জাহিদ ভাইকে দেখে। পেরেছিলাম হয়তো শাজাহানের ছেলে জিহাদকে দেখে, আটকে পড়া বাবুল মৃধাকে দেখে, রুপালী কিংবা আকলিমা কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নাতনিকে খুঁজতে আসা ৭৩ বছরের ফরজ আলিকে দেখে।

আমি কখনই সাহসী ছিলাম না। হিমালয় হিমুরা আর রানা প্লাজার পরিস্থিতি আমাকেও সাহসী বানিয়েছিল। এদেশের মানুষ দুটো ঘটনায় মানুষ মানুষকে মনে রাখে। প্রথমটা হলো- দেশকে ট্রফি জেতালে, সেটা দুর্নীতি করে টাকা পাচারের ট্রফিই হোক কিংবা ক্রিকেট-ফুটবলের ট্রফি। দ্বিতীয়টা হলো- মরে গেলে।

তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের কখনো গোনায় ধরে না এই রাষ্ট্র। তাইতো রানা প্লাজায় আমার দেখা সবচেয়ে দুর্ধর্ষ উদ্ধারকর্মী হিমু রাষ্ট্রের কোনো দলিলে থাকে না। অকাতরে মেডেল দেওয়া এই রাষ্ট্র প্রায় শ’খানেক প্রাণ বাঁচানো উদ্ধারকর্মী হিমুর জন্য ইস্যু করে মাত্র একটা দলিল, তাও অস্বাভাবিক মৃত্যুর একটা ডেথ সার্টিফিকেট। মানিক পাগলপ্রায় হয়ে গেলেও তার জন্য রাষ্ট্র আসে না, রাষ্ট্রের কাছে যেতে হয়।

রাষ্ট্রের আর্মি, বিজিবি, পুলিশ থাকার পরেও দরকার হয় স্বেচ্ছাসেবকদের। দরকার হয়েছে রানা প্লাজা ঘটনায়, কিংবা বনানীর অগ্নিকাণ্ডে, আর এখন করোনার দুর্যোগে। স্বেচ্ছাসেবকরা কখনোই রাষ্ট্র থেকে কিছু পাওয়ার আশায় স্বেচ্ছাশ্রম দিতে যায় না। যায় দেশের টানে, মানুষের টানে, মায়ার টানে। রাষ্ট্র তা বোঝে না।

রানা প্লাজা ধ্বসের একবছর পর মৃত সুরুজের মা আমাকে বলেছিলেন ‘বাবা তুমি আমার সুরুজরে শেষবার দেখছো, অর সঙ্গে কথা কইছো, তুমি কি আমারে একবার আম্মা ডাকবা? আমার মনে হইব সুরুজ আমারে ডাকতাছে’। কিংবা অপরিচিত ইয়ানুরের কাছে একজন হিমালয় হিমুর পরম নির্ভরতার ‘হিমু মামা’ হয়ে ওঠা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।

লেখক: ব্যাংকার ও যুব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোক্তা

রানা প্লাজা লাশের স্তূপ স্বেচ্ছাসেবী

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে আগুনে পুড়ল ৫ দোকান
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৩৪

আরো

সম্পর্কিত খবর