Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা সারবে, মনের সংক্রমণ যেন না হয়


২৮ এপ্রিল ২০২০ ১৪:১৬

ভয়ংকর। আজকের বিশ্ববাস্তবতা বোঝাতে এই একটি শব্দের অতিরিক্ত আর কিছুই দরকার হয় না। এক অতিক্ষুদ্র জীবাণুকণা আমাদের কর্মমুখর পৃথিবীকে এক ঝটকায় ঘরবন্দী করে ফেলেছে। কাজ নেই দুনিয়াজুড়ে কোনো মানুষের। লকডাউন। অর্থনীতি স্থবির, নিশ্চিত মহামন্দা ধেয়ে আসছে মহামারি শেষে, সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ, ব্যর্থ দুনিয়ার সাধারণ মানুষ থেকে বিশ্বচালকগণ।

মহামারি। বিরাট থেকে বিরাটতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। দুনিয়াজুড়ে মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশেই দেড়শোর বেশি। আজ যারা সুস্থ, কাল সুস্থ থাকবে কিনা কেউ জানে না। আজ যারা বেঁচে আছেন, কাল থাকবেন কি না জানে না কেউ। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, করোনায় মৃত্যু। এটা এমন মৃত্যু যে, স্বজনের মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে একটু বিলাপ করারও কোনো সুযোগ নেই। শেষকৃত্যটুকু দেখারও সুযোগ নেই। মরদেহের শেষকৃত্য করবে প্রশাসন আর স্বেচ্ছাসেবকরা। অসুস্থ হলে স্বজনের শুশ্রুসা করারও কোনো সুযোগ নেই।

বিজ্ঞাপন

করোনার সংক্রমন কেবল শরীরে নয়, সংক্রমণ ধরেছে মনেও। বৃদ্ধা মা হাঁচি-কাশি দিয়েছেন, কিংবা শ্বাসকষ্ট আছে, ছেলেমেয়েরা তাকে ফেলে এসেছেন বনে। করোনা আক্রান্ত কিনা তাও নিশ্চিত না, কেবল লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন, এমন মরদেহ নিয়ে পুলিশ গেছে গ্রামে, শেষকৃত্য করার মতো লোকও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রোগী থেকে নিজের শরীরে ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কায় ডাক্তারি পেশা ফেলে ঘরে উঠে বসেছেন ডাক্তারবাবুদের অনেকে।কিংবা মানুষের এ মহাবিপর্যয়েও মানুষকে জিম্মি করে বাজারে পণ্যমূল্যে আগুন লাগিয়েছে অসৎ ব্যবসায়ীরা। সরকারি ত্রাণের চাল-ডাল লোপাট করেছে তৃণমূল পর্যায়ের কিছু জনপ্রতিনিধি। টিসিবির তেল খাটের নিচে লুকিয়ে রেখে ভবিষ্যতে লাভবান হতে চেয়েছে ব্যবসায়ী। এসব সংক্রমণ তো শরীরের না, মনের।

বিজ্ঞাপন

সংক্রমণে মহাবিপর্যয়ে পৃথিবীর মানুষ। সে বিপর্যয়কে পুঁজি করে মুনাফালোভীদের লকলকে জিভ, চোরের লোভ কিংবা দায়িত্ব ভুলে কেবল নিজের ভালোটুকু আঁকড়ে পড়ে থাকা- মনের এমন সংক্রমণ গ্রাস করে ফেলেছে বহু মানুষের।

বিপর্যয় তো সারাবিশ্বে। বাদ দিলাম বাকি পৃথিবীর কথা। নিজেদের দেশের দিকে তাকাই। এতোসব খারাপ উদাহরণ, মনের সংক্রমণের উদাহরণ। কিন্তু তার সংখ্যা কতো? নিতান্তই কম। বিপরীতে চারদিকে প্রচুর উপশমের গল্প, মানুষের মহত্বের গল্প।

শরীরের রোগ হয়তো সারবে, করোনা একসময় বিজ্ঞান আর চিকিৎসাবিদ্যার কাছে নিশ্চয়ই পরাজিত হবে। কিন্তু মনের সংক্রমণ দূর করতে না পারলে করোনা গেলেও তো মানবিক পৃথিবী আর ফিরবে না, বরং আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠবে আমাদের চারপাশ। তাই করোনা সারাতে, প্রতিষেধক আবিষ্কারে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিদরা যেমন দিনরাত এক করে কাজ করছেন, তেমনি সমাজের কিছু ডাক্তার থাকেন, সমাজের কিছু সাধক থাকেন, যারা সমাজের সব ক্ষত সারাতে কাজ করেন। এখন দায়িত্ব তাদের উপরেও এসে পড়েছে। সমাজের জন্য ভালোটা তাদের দিতে হবে।

অজানা, অচেনা এক রোগের সাথে লড়াই করতে ভীত সবাই। ভীত ডাক্তাররাও। থাকবেই। এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাইরাস, জীবাণুর আক্রমণ লেগেই থাকে। হাসপাতালে এতো এতো রোগী। তার বিপরীতে ডাক্তার ক’জন! ডাক্তাররা খুব স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। তার উপর করোনার মতো অস্বাভাবিক মারণরোগ। করোনা সংক্রমণের শুরুতে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীসহ চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট লোকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রি (পিপিই) দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা সত্বেও পালিয়েছেন কয়জন?  হাতেগোনা কয়েকজন বাদে সবাই কাজ করেছেন। ঝুঁকি নিয়েও পালন করেছেন নিজের পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব।

আমাদের অনেক ঘাটতি আছে, থাকবে। কিন্তু তার উর্দ্ধে উঠে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর সাথে একাত্ম হয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন শুরু থেকেই। তবে করোনাকালে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা দিচ্ছে ডাক্তার সংকট।

খুলনায় লিভারের ব্যধিতে আক্রান্ত এক স্কুলছাত্রকে নিয়ে কয়েক হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা দিতে পারেনি তার পরিবার, ছেলেটি মারা গেছে। এমন আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে। ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারও বন্ধ করোনার ভয়ে। কিন্তু এমন ডাক্তারও দেখেছি, যারা ফেসবুকে ব্যক্তিগত ফোন নম্বর উন্মুক্ত করে দিয়েছেন রোগীদের জন্য। এদের মধ্যে দুজন আমার সরাসরি পরিচিতি। একজন ডা. আলাউদ্দিন শিকদার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। আমার কলেজজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই সময়ে আমার শিশুপুত্রের জ্বর হলে বন্ধু আলাউদ্দিনকে ফোন করেই ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ছেলেকে সুস্থ করেছি। আরেকজন ডা. সুব্রত ঘোষ। আমরা একই ব্যাচের ছাত্র। রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজকর্মে আমার ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। সরাসরি পরিচিত নয়, এমন আরো অনেক ডাক্তারকে এমন করে সেবায় নিয়োজিত হতে দেখেছি।

আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-কমিটির তরফ থেকে ১৯৮ জন চিকিৎসকের ফোন নম্বরসহ তালিকা জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকেও বহু সংখ্যক রোগী বিনা পয়সায় টেলি-চিকিৎসা নিচ্ছেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তরফ থেকেও অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া ও অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের নেতৃত্বে ১০৮ জন চিকিৎসক দলের তালিকা ফোন নম্বরসহ প্রকাশ করা হয়েছে।

এসব ডাক্তার নিজেদের মনের সংক্রমণ ভেঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এই মহান চিকিৎসকরাই আবার শিকার হচ্ছেন অন্যদের মনের সংক্রমণে। করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া ডাক্তার-নার্সদের ভাড়া বাসায় থাকতে দিচ্ছে না কতিপয় বাড়িওয়ালা। এমন খবরও গত কদিনে আলোচনায় এসেছে।

সংক্রমিত বাড়িওয়ালাদের নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা পরাজিত করে নিজেদের বাড়ির ভাড়াটিয়াদের ভাড়া মওকুফ কিংবা হ্রাস করে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন বহু বাড়িওয়ালা। এমন উদাহরনও আছে।

ঢাকা নগরীতে বাড়িওয়ালারা সাধারণত সবচেয়ে ‘অমানবিক শ্রেণি’ হিসেবে পরিগণিত। সেখানে তাদের একজনও যদি মহৎ উদাহরণের সৃষ্টি করে, তবুও এই আকালে স্বপ্ন দেখার সাহস বাড়ে। আমার নিজের বাড়িওয়ালার কথাও বলতে হয়, তিনি তার পরিবারসহ সকল ভাড়াটিয়া পরিবারের সদস্যদের সর্বোচ্চ সুরক্ষার লক্ষ্যে নিজে প্রতিদিন নিয়ম করে সারা বাড়ি এবং আশপাশ পরিষ্কার করছেন, জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছেন, ভবনের সব বাসিন্দাদের নিয়ম করে প্রতিদিন খোঁজখবর রাখছেন।

আমাদের দেশে পুলিশ-র‌্যাব মানেই এক নিয়ত নেতিবাচক খবরের উৎস। কিন্তু এবার সব নেতিবাচকতাকে ম্লান করে দিয়ে সেই পুলিশ-র‌্যাব সদস্যরা প্রতিদিন ইতিবাচক খবরের শিরোনাম হচ্ছেন। অসুস্থ মানুষকে কোলে তুলে হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন। এমন দৃশ্য আমাদের সমাজে কল্পনা করাও যেন ছিলো অসম্ভব। কিন্তু এমন সব ঘটনাই ঘটছে বারবার।

কৃষকের ধানকাটা পরিদর্শনে গেছেন এক উর্ধ্বতন পুলিশকর্তা। নিজেই সেখানে নেমে গেছেন ধান কাটতে। হাতে হাতে পুলিশ সদস্যরা কৃষকের ধান কেটে গোলায় তুলে দিয়েছেন। করোনা সন্দেহে মারা গেছেন একজন, তার মরদেহ গ্রামের নিয়ে গেলে সৎকার করতে একজনও গ্রামবাসী এগিয়ে আসেনি। মুঠোফোনের টর্চ লাইট জ্বেলে কবর খুড়ে ইউএনওর ইমামতিতে পুলিশ সদস্যরা জানাজা পড়ে ওই মরদেহের শেষকৃত্য করেছেন।

ঘরে খাবার নেই, খবর পেয়ে ইউএনও ছুটে গেছেন খাবার নিয়ে। এমন খবরও কম নয়। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে অন্যান্য ক্ষেত্রের সরকারি কর্মকর্তারাও নিত্য সেবা দিয়ে চলেছেন এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে।

অনেক কর্মকর্তাই নিজ কর্মস্থলে থাকেন না। অন্যত্র থেকে যাতায়াত করেন। চলতি সাধারণ ছুটিতেও সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তাদেরকে নিজ কর্মস্থলে থেকে ত্রাণকাজ, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। যারা দূর থেকে যাতায়াত করতেন, তাদের অনেকেই এখন অফিসের টেবিলের উপর ঘুমিয়ে মানুষের প্রয়োজনে সরকারি দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি কর্মকর্তারা এসব উদাহরণ সৃষ্টি করছেন এই করোনাকালে।

কৃষক তার জমিতে ফসল ফলিয়েছেন। কিন্তু চাঁদা দাবি করছে কতিপয় দুর্বৃত্ত, পুলিশ তাদের ধরে এনে মাঠে দাঁড় করিয়ে ব্রিফিং দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন চাঁদাবাজির দিন শেষ। এবারের এই মহাসঙ্কটে পুলিশ, র‌্যাব, সরকারি কর্মকর্তারা মানুষের আস্থাহীনতার জায়গা থেকে আবারও ভরসায় জায়গায় ফিরে আসতে সক্ষম হচ্ছেন। বিপদের দিন শেষ হলেও তারা যেন তাদের এই অবস্থান ধরে রাখেন, এটা সবারই কাম্য।

পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তাদের কাজ বন্ধ করেননি। বর্জ্যের সাথে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। কিন্তু তাদের বিকার নেই। তারা নিষ্ঠার সাথেই ঝুঁকি নিয়ে বাসাবাড়ি-হাসপাতালের বর্জ্য পরিষ্কার করছেন। এটাও উদাহরন। আবার উদাহরন সৃষ্টি করেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, গ্লোভস, গামবুট বিতরণ করছেন তারা। নিজেদের পয়সায় কিংবা বন্ধুবান্ধবদের সংগৃহিত পয়সা একত্রিত করে এসব কিনে উপহার দিয়েছেন তারা।

ব্যাংকাররা প্রতিনিয়ত সেবা দিচ্ছেন গ্রাহকদের। করোনাকালে ব্যাংক বন্ধ নেই। সীমিত আকারে হলেও চালু আছে। ব্যাংকে যারা সেবা নিতে যাচ্ছেন, সেই গ্রাহকদের কেউ না কেউ হয়তো করোনা আক্রান্ত। কিন্তু সে ভয় উপেক্ষা করে ব্যাংকাররা কাজ করে চলেছেন। মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট, টেলিফোন ও কেবল লাইন সঞ্চালক ও পরিবেশকরাও গ্রাহকদের নিয়মিত সেবা দিয়ে চলেছেন। এমনই আরো বেশকিছু সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মীরা নিত্য সেবা দিয়ে চলেছেন মানুষকে। এদের প্রত্যেকেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই কাজ করে চলেছেন।

কাজ করে চলেছেন আমাদের গণমাধ্যমের বন্ধুরাও। ঘরবন্দী মানুষের কাছে প্রতি মুহূর্তের খবর পৌঁছে দিতে তাদের কোনো বিশ্রাম নেই। ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইটভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলোর উপর এই সময়ে মানুষের নির্ভরতা বেশি। ছাপানো সংবাদপত্রের প্রচার কমেছে, বেশ কয়েকটি বন্ধও হয়ে গেছে। বেতন না দিয়ে তাদের অনেককেই ছাঁটাই করেছেন গণমাধ্যমের মালিকপক্ষ। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীরাও আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল বাধ্য হয়েছে তাদের নিয়মিত সংবাদ সম্প্রচার বন্ধ করতে। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে এতো বেশি সংখ্যক সংবাদকর্মী আক্রান্ত কিংবা কোয়ারেন্টাইনে আছেন যে তারা অন্য প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে সংবাদ প্রচার করতে বাধ্য হচ্ছেন। সাংবাদিক বন্ধুদের এই অবদানও তো কোনোভাবেই ভুলে যাওয়ার উপায় নেই।

সংবাদ প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউ আবার বাড়তি সামাজিক দায়িত্বও পালন করছে এই সময়ে। অনলাইন সংবাদ পোর্টাল সারাবাংলা এবং তার পরিচালক প্রতিষ্ঠান গাজী গ্রুপকে দেখা গেছে চিকিৎসকদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী আমদানি করে বিভিন্ন হাসপাতালে বিতরণ করতে। এই আকালে এসব কাজের কোন কিছুই ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই।

সমাজে সবসময়ই কিছু মানুষ থাকেন, যারা ঘরে খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে বেশি পছন্দ করেন। তারা হলেন স্বেচ্ছাসেবী। তারাও বসে নেই। নিজেদের টাকায় কিংবা সামর্থ্যবানের কাছ থেকে সংগৃহীত টাকায় তারা নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী তথা খাবারের সঙ্কটে থাকা মানুষদের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন। আমার পরিচিত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এসব কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন ইতিমধ্যে।

কিছু স্বপ্নবাজ তরুণের উদ্যমী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। প্রতিদিন দেশজুড়ে হাজার হাজার মানুষের খাদ্য সংস্থানের কাজ করে চলেছে তারা। এক টাকায় আহার থেকে শুরু তাদের। আর এখন তাদের সাথে কাজ করছে বেশকিছু সংগঠন। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির সহায়তায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় খাবার বিতরণ করছেন তারা। বন্ধুবর পলাশ আহমেদ বিদ্যানন্দকে ব্যখ্যা দিয়ে বলেন, ‘পথহারা নাবিকের বাতিঘর’। সত্যিই তারা এই সমাজের, এই কালের বাতিঘরের কাজ করে চলেছে।

সুলতান আহমেদ নামে এক অগ্রজ সাংবাদিককে চিনি। নিজের ঘরে অভাব, কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই তার। সমমনা সাত সাংবাদিক মিলে গড়ে তুলেছেন ‘জার্নালিস্ট কনসার্ন জার্নালিস্ট ইনিশিয়েটিভ (জেসিজেআই)’ নামের একটি সংগঠন। গত এক মাসে তারা কয়েকশ পরিবারের কাছে উপহার হিসেবে খাদ্যসামগ্রি পৌঁছে দিয়েছেন।

রাজশাহী থেকে পিকআপ বোঝাই সবজি দিয়েছেন এক কৃষক। বিনামূল্যে। সেগুলো এনে তিন শতাধিক পরিবারের মধ্যে বণ্টন করেছে জেসিজেআই।

আমার বন্ধু সাগর সর্দার। নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান নাগরিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এ পর্যন্ত অন্তত দুই হাজার মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন রান্না করা খাবার। এখন তারা সুরক্ষা সামগ্রি নিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসকদের কাছে।

‘৪৫০ টাকায় এক সপ্তাহ’ শিরোনামে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে মাঠে নেমেছেন বন্ধুবর প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও পরিবেশকর্মি ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল। শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ, বস্তিবাসী, রিক্সাওয়ালা, হকার, গৃহকর্মীসহ এ পর্যন্ত চার শতাধিক মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন। কখনো চাল-ডাল-তেল-আটা-আলুর প্যাকেট, আবার কখনো রান্না করা খাবার।

সাভারের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও ডাক্তাররা মিলেও এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে আমার দুই অনুজ ডাক্তার আছেন। ডা. দেবাশীষ সাহা তন্ময় ও ডা. জয়দেব বসাক। তারা বহু পরিবারকে খাবার উপহার দিয়েছেন।

ছাত্র মৈত্রী, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন নিজ নিজ উদ্যোগে হাজার হাজার হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদন করে মানুষের মাঝে বিলিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীরাও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক বানিয়ে বিতরণ করেছেন হাসপাতালে ও সাধারণ মানুষের মাঝে।

বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজের সহযোদ্ধা সাদেক আহমেদ সৈকত বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা এই বিপদের দিনে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হিসেবে চিকিৎসকদের সহযোগী হিসেবে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন।

আমার সহযোদ্ধা ছোটবোন, চলচ্চিত্র নির্মাতা অপরাজিতা সঙ্গীতা তার বন্ধুদের নিয়ে মানুষের মুখে খাবার জোগানোর গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন। আমার আরো দুই সহযোদ্ধা ছোটবোন সুহাসিনী শ্রাবন্তী ও তানিয়া আহমেদ তন্বী প্রতিদিনই কোন না কোন এলাকায় মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। তানিয়া আমার পরিচিত বাড্ডার দশটি শ্রমজীবী পরিবার, লালবাগের এক সাংবাদিক পরিবার, ডেমরার এক শ্রমজীবী পরিবারের জন্য খাদ্য উপহার পাঠিয়েছেন। এই দুই বোন আবার স্বেচ্ছায় রক্তদাতা খুঁজে দেবার কাজেও আত্মনিয়োগ করেছেন।

রক্তদাতা খুঁজে দেওয়ার কাজ নিরলসভাবে করে চলেছেন মাহিন আব্দুল্লাহ, মহিউদ্দিন তোহা, দেওয়ান সাবরিনা মাসুক, কিশোর দাস ভূপেন নামের আরো কয়েকজন স্বপ্নচারীও। মাহিন আব্দুল্লাহ নিয়মিত মানুষের মুখে খাবার জোগানোর কাজেও নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।

ব্লাড ভলান্টিয়ার নামের একটি গ্রুপ আমি চিনি। মশিউর রহমান, অ্যামেলি রায়, অনিমেষ রহমান, অভ্রনীল অর্ক, শারমিলী শাম্মী, রাজীব পোদ্দার, টুটুল নিসার, তুষার অলোক, সাবরিনা সিরাজী, এমদাদুল হক তুহিন, অনির্বাণ শুভ, সুশোভন অর্ক, কল্যাণ দেব অর্ণব, কেএম শাওন, স্বপন হিমালয়সহ আরো কয়েকজন তরুণ নিজেদের কাজ ও সময়কে অতিক্রম করে মানুষের জীবন বাঁচানোর সাধনা করে চলেছেন।

বরিশালের বাসদ নেত্রী ডা. মনীষা চক্রবর্তী গরিবের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করেছেন। চালু করেছেন গরিবের বাজার।

সাম্প্রতিক সময়ে কতিপয় দুর্বৃত্তের অপকর্মের কারণে আমাদের দেশের ছাত্র রাজনীতির গায়ে যে কালি লেগেছিলো, তা দূর হয়েছে এই করোনাকালে। আমাদের স্বপ্নসাধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের পরিবার বিভিন্ন কারণে সঙ্কটগ্রস্ত, নিরবে নিভৃতে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের বাংলা নববর্ষের আপ্যায়ন খরচের ৫০ লক্ষাধিক টাকা তুলে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় ত্রাণ তহবিলে। এ যে কতোবড় সৌন্দর্য্য, তা বর্ণনাতীত। এখন তারা বিশ্ববিদ্যালয় চৌহদ্দির ভিতরে বা বাইরের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। ডাকসুর ভিপিকে যদিও এসব কাজে দেখা যায়নি, তবে নানা কারণে বিতর্কিত জিএস গোলাম রাব্বানী ক্যাম্পাসের এবং কাঁটাবনের প্রাণিসম্পদ মার্কেটের কুকুর, বিড়ালসহ প্রাণিদের দুঃসময়ে নিয়মিত খাবারে বন্দোবস্ত করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশের প্রায় সব অঞ্চলে কৃষকদের ধান কেটে গোলায় তুলে দেওয়ার কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য্য নিজেরাও ধান কাটতে নেমেছেন কৃষকের মাঠে। সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস গ্রামের বাড়িতে বসেও সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের পরিবার সমস্যাগ্রস্ত, তাদের বাড়িতে উপহার পাঠাচ্ছেন। বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও দুই/একটি এলাকায় ধান কাটতে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে দেশের ছাত্র রাজনীতি আবারও মানুষের আস্থার জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতির এই রূপই তো মানুষ দেখতে চায়।

বাংলাদেশ হাজারো সঙ্কট জর্জরিত। আমরা ইউরোপ-আমেরিকার মতো সম্পদশালী নই। এশিয়ার সিঙ্গাপুর, জাপান, কোরিয়া, চীন, হংকং এমনকি ভারতের মতোও নই। খুব অল্প জায়গায় বেশি সংখ্যক মানুষ নিয়ে বহু সমস্যা সঙ্গী করে আমাদের বাস। অনুন্নত দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে আমাদের উত্তরণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সঙ্কটের কাল আমাদের এখনও কাটেনি। আমরা চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এমন স্তরে নিয়ে যেতে পারিনি যেখানে দেশের সব মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য সঙ্কটকালেও আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। আমাদের শিক্ষার স্তর এমন জায়গায় পৌঁছেনি যে সব মানুষের মানবিক আচরণ আমরা নিশ্চিত করতে পারি। কিন্তু বারবার আমাদের দেশের একটা বড় অংশের মানুষ প্রমাণ করেছেন, সঙ্কটে আমরা একে অপরের হাত ধরে পাশাপাশি দাঁড়াতে পারি। আমরা এক যোগ এক সমান দুই হওয়ার চাইতে একের পাশে এক দাঁড়িয়ে এগারো হতে জানি।

এদেশে সঙ্কটকে পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফালোভী চোখ লোভাতুর চকচক করে, এদেশে ত্রাণের চাল-ডাল-তেল লুট হয়। কিন্তু এসব খারাপ মানুষের সংখ্যা এখনো অনেক কম। এদের খারাপ কাজগুলো আমাদের প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরা হয়- সেসব দেখে আমরা ধরেই নিই যে, দেশ পঁচে গেছে। কিন্তু আমাদের চারদিকে এতো এতো ইতিবাচক ও মানবিক মানুষ নিত্য কাজ করে চলেন অপর মানুষের জন্য, তাদের মোট সংখ্যা কি দুর্বৃত্তদের চেয়ে নিঃসন্দেহে বেশি নয়?

লেখার শুরুতে যে মনের সংক্রমণের কথা বলেছিলাম, সে সংক্রমণ ভাঙ্গার মতো বহু উদাহরন আছে আমাদের চারপাশে। আমি একাই যদি আমার জানাশোনা এতোগুলো ইতিবাচক ঘটনা আর ইতিবাচক মানুষের গল্প বলতে পারি, নিশ্চয়ই আমাদের সবার জানাশোনা মোট সংখ্যা দুর্বৃত্তদের মোট সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।

গোটা বিশেক চাল চোর চেয়ারম্যান-মেম্বারই বাংলাদেশ নয়, ঝিনাইগাতির নজিমুদ্দিন নামের যে অশীতিপর ভিক্ষুক তার ভিক্ষার উপার্জন থেকে জমানো দশ হাজার টাকা অন্য অসহায় মানুষের জন্য সরকারের তহবিলে তুলে দিতে পারেন, তিনিই বাংলাদেশ।

এক ক্ষুদে স্বপ্নবাজের গল্প বলে শেষ করবো। গত ২৬ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরাজ চৌধুরী তার টিফিনের পয়সা থেকে মাটির ব্যাংকে জমানো সঞ্চয় জেলা প্রশাসকের দপ্তরে উপস্থিত হয়ে তার ত্রাণ তহবিলে তুলে দিয়েছেন।

আসুন, আমরা এইসব মানবিক মানুষদের প্রতি, এইসব স্বপ্নবাজ তরুণদের প্রতি, আমাদের ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী-ফার্মাসিস্ট, পুলিশ-র‌্যাব-সেনাবাহিনী-বিজিবি, সরকারি কর্মকর্তা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ব্যাংকার, টেলিফোন-ইন্টারনেট-কেবল সঞ্চালক ও পরিবেশক, ব্যাংকার, স্বেচ্ছাসেবী, রক্তযোদ্ধা, ছাত্র রাজনীতির কর্মী, মানুষের পাশে দাঁড়ানো রাজনৈতিক কর্মী, সমাজকর্মী, ভিক্ষুক নজিমুদ্দিন কিংবা ক্ষুদে শিক্ষার্থী শাহরাজদের উদ্দেশ্যে একবার বলি- ধন্যবাদ, আপনারাই বাংলাদেশ।

 

লেখক: প্রাক্তন ছাত্রনেতা; সাধারণ সম্পাদক, ইয়ুথ ফর ডেমোক্রেসি এন্ড ডেভেলপমেন্ট

করোনা মহামারি করোনা সংক্রমণ গাজী গোলাম দস্তগীর বিদ্যানন্দ্য ফাউন্ডেশন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দশম গ্রেড দাবি করায় ৬৪ অডিটরকে বদলি
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৫

সম্পর্কিত খবর