Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাসংকট আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ব্যর্থতার গল্প


২৯ এপ্রিল ২০২০ ১৪:৪৬

মানুষ মৃত্যু ঠেকাতে পারে না। কিন্তু মৃত্যু থেকে বাঁচতে বা বাঁচাতে কেবল যুদ্ধ করতে পারে। এই যুদ্ধের ধরনটা ভিন্ন রকম। একটা বড় প্রস্তুতি লাগে। করোনা প্রমাণ করে দিয়েছে, বিশ্বের মহামারী মোকাবেলায় অনেক ধনী, শক্তিশালী দেশের প্রস্তুতিটাও খুবই দুর্বল।

এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৃত্যু সংখ্যা ৫৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগেই বলেছিলেন, আমেরিকায় মৃত্যু সংখ্যা এক লাখ হতে পারে! তবে পরে অবশ্য তিনি সেই কথা থেকে সরে এসেছেন। বলেছিলেন, ৬০ হাজার হতে পারে!

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই। মৃত্যুর মিছিল আগামী আগস্ট পর্যন্ত চলতে পারে বলে জানাচ্ছেন মেডিকেল বিশেষজ্ঞরা। আরও সংকটের কথা হলো, আগামী শীত মৌসুমে করোনা আবার ফিরে আসতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে!

চলতি বছরের মার্চ মাসে যখন আমেরিকায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়- তখন সেখানের প্রস্তুতি ছিল খুবই অপ্রতুল। যে দেশটি পারমাণবিক বোমার ‘বিশ্বগুরু’ দাবী করে নিজেদেরকে- তাদের হাতে কেন পর্যাপ্ত পরিমাণ মেডিকেল মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই, ভেন্টিলেটর ছিল না- প্রশ্নটি মিডিয়ায় এসেছে বারবার।
বলা হচ্ছে, আমেরিকার প্রস্তুতিটা জানুয়ারি থেকেই শুরু করা উচিৎ ছিল। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলছেন, ওই সময়ে আমেরিকায় মৃতের সংখ্যা একজনও ছিল না। আমি কেন আমেরিকা লকডাউন করবো!

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয় প্রতিদিন প্রায় দেড় দুই ঘণ্টা। হোয়াইট হাউসে সরকারি ব্রিফিং টিমের নেতৃত্ব দেন তিনি। সেখানে তাকে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে নাস্তানাবুদও হতে হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য খুলে দেওয়া এবং ম্যালেরিয়ার ওষুধকে করোনার ওষুধ বলে চালিয়ে দেওয়ার কারণে।

বিজ্ঞাপন

কয়েকদিন আগে ফুসফুসে ইনজেকশন দিয়ে করোনা সারানোর ফর্মুলা দিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের সেই মন্তব্যের আগে হোয়াইট হাউসের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দপ্তরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা উইলিয়াম ব্রায়ান বলেছিলেন, ‘মার্কিন প্রশাসনের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাস বধ করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিতে পারে অতিবেগুনি রশ্মি।’

উইলিয়াম ব্রায়ানের বক্তব্যের পরেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘ধরুন, অতিবেগুনি রশ্মি বা অত্যন্ত শক্তিশালী কোনো আলো আমাদের শরীরে পড়ল। তাতে যদি করোনায় উপকার হয়। তখন অবশ্য আপনারা বলবেন, পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। সেই আলো যদি ইনজেকশনের মাধ্যমে চামড়া ফুঁড়ে বা অন্য কোনো ভাবে আমাদের শরীরে ঢোকানো যায়, তবে করোনা নির্মূল হবে।

প্রেসিডেন্টের এমন বক্তব্যের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন হোয়াইট হাউসের করোনাভাইরাস টাস্কফোর্সের কো-অর্ডিনেটর ডা. ডেবরা ব্রিস্ক। প্রেসিডেন্টের কথা শুনে তিনি যে অবাক হয়ে গিয়েছেন, সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পরে অবশ্য ট্রাম্প বলেন, তিনি কৌতুক করে এমন কথা বলেছেন। এটা সিরিয়াসলি তিনি বলেন নি। কথা হচ্ছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কি ‘জোক’ করে এমন কথা বলতে পারেন? এটা বলা উচিৎ ছিল?

চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাসকে শরীরের ভেতরে ধ্বংস করতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জীবাণুনাশক পুশ করার যে পরামর্শ দিয়েছেন; তাতে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। শরীরে জীবাণুনাশক পুশ করা হলেও তা ভাইরাস পর্যন্ত পৌঁছাবে না। শরীরে ভাইরাস ঢুকে পরার পর ত্বকের ওপর অতিবেগুনী রশ্মি প্রয়োগ করা হলেও তাতে কোন কাজ হবে না।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া, ওকলাহোমা এবং অন্যান্য আরও কিছু রাজ্যে লকডাউন শিথিল করে খুলে দেয়া হয়েছে দোকানপাট। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, মানুষের সামাজিক দূরত্ব কমে গেলে আরেকটি ধাপে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ওই সব রাজ্যে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসন্ন গ্রীষ্মেও সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ বিধি বজায় রাখার দরকার আছে। সেসব অঙ্গরাজ্যের গভর্নররা বলছেন, লকডাউনের কড়াকড়ি তুলে নেওয়ার মানে এই নয় যে এখনই পুরোপুরি আগের মতো সব স্বাভাবিক হচ্ছে। ভাইরাস যাতে ছড়াতে না পারে, সে জন্য কিছু কিছু জায়গায় বিধিনিষেধ থাকবে।

কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাটিক গভর্নর জারেড পোলিস জানিয়েছেন, পিকআপ ভ্যানগুলো চলতে পারবে। এরপর সেলুন ও ট্যাটু পার্লারগুলোও নিয়ম মেনে খুলতে পারবে।

গত ২৭ এপ্রিল থেকে টেনেসি অঙ্গরাজ্যের রেস্তোরাঁগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। একই দিনে মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যের লকডাউন শেষ হয়েছে। মন্টানা অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ২৬ এপ্রিল থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে গির্জা চালু করার অনুমতি দিয়েছেন। আর আগামী ৭ মে থেকে স্কুল ও রেস্তোরাঁগুলো খুলবে।

অন্যদিকে, রিপাবলিকান গভর্নরদের পরিচালিত আটটি অঙ্গরাজ্য আরাকানসাস, আইওয়া, নেব্রাস্কা, নর্থ ডাকোটা, ওকলাহোমা, সাউথ ডাকোটা, উটাহ এবং ওয়েমিংয়ে ঘরে থাকার বাধ্যতামূলক লকডাউনের আদেশই জারি করেনি।

নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানেকটিকাট এই তিন অঙ্গরাজ্যকে ট্রাই-স্টেট বলা হয়ে থাকে। এই তিনটি অঙ্গরাজ্য কীভাবে খোলা হবে তা নিয়েই কথা হচ্ছে বেশি। কারণ নিউইয়র্ককে বিশ্বের রাজধানী বলা হয়ে থাকে। নিউইয়র্ক স্টেটেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। নিউইয়র্কই কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের প্রধান কেন্দ্র হয়েছে।
নিউইয়র্ক স্টেট গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো বলেছেন, সেখানকার ফার্মেসিতে এখন থেকে করোনাভাইরাস স্টেট করা যাবে। তিনি বলছেন, স্টেটের পাঁচ হাজার ফার্মেসি করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা করতে পারবে। তারা আশা করছেন, এর ফলে প্রতিদিন ৪০ হাজার টেস্ট করা সম্ভব হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত দশ লক্ষের বেশি নিশ্চিত রোগী পাওয়া গেছে। দেশটিতে মারা যাওয়াদের এক তৃতীয়াংশ নিউইয়র্কে মারা গেছেন।

গভর্নর কুমো ঘোষণা দিয়েছেন যে, অ্যান্টিবডি স্ক্রিনিং আরও চারটি হাসপাতালে শুরু করা হবে। যে চিকিৎসা কর্মীরা সরাসরি চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন, তাদের দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু হবে। ফার্মেসিগুলোও পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করতে পারবে।

মি. কুমো জানিয়েছেন, স্টেটের হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তির হার কমতে শুরু করেছে। একে তিনি সংকট কেটে যাওয়ার লক্ষণ বলে বর্ণনা করছেন। তারপরেও তিনি মানুষজনকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকা খুলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। গত ২৭ এপ্রিল বিকেলে তিনি আমেরিকার বড় বড় ফার্মেসী, ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোর প্রধানদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। কুয়েস্ট ডায়াগনোস্টিক, ওয়ালমার্ট, সিভিএস, রাইটএইড, ওয়ালগ্রীন- এমন সব বড় বড় ফার্মেসীগুলো প্রতিদিন লাখ লাখ সাধারণ মানুষের কোভিড-১৯ টেস্ট করছে। সাধারণ মানুষ চাইছেন টেস্ট করে নিশ্চিত হতে। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, একবার কেউ আক্রান্ত হয়ে করোনা মুক্ত হলে তিনি যে আবার আক্রান্ত হবেন না- এমন কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।

আমেরিকা করোনাভাইরাস মুক্ত হলেও পরবর্তী সংকটগুলো কি হবে- তা নিয়েই বেশি ভাবছেন অর্থনীতিবিদরা। বর্তমানে আমেরিকায় কাঁচামালজাত দ্রব্যগুলো বিক্রি করতে না পরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। দুগ্ধজাত দ্রব্য, ফলমূল, শাকসবজি পচছে ডাস্টবিনে।

নানা উদ্যোগ নিয়ে অন্ধকার কাটাতে চাচ্ছে আমেরিকা। সেই সাথে গোটা বিশ্ব। কিন্তু কেমন হবে আগামীর পৃথিবী! কেমন হবে সোশাল ডিসট্যান্স। কেমন হবে আগামী! এমন অনেক বিষয়ই এখন আলোচনায়, পর্যালোচনায়। আলোচনায় এই প্যানডেমিক সময়কে মোকাবেলা করতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ব্যর্থতার বিষয়ও। আগে রাজনীতি- না জীবন, এই কথাটি উচ্চারিত হচ্ছে বেশ মোটা দাগে।

নিউইয়র্কে লকডাউন থাকবে ১৫ মে পর্যন্ত। তারপরে কি খোলা সম্ভব হবে? সেই প্রশ্নটি আসছে বারবার। যে হোটেলগুলো পর্যটকরা মুখরিত রাখতো, সেগুলোতে এখন ডাক্তার, নার্সদের অস্থায়ী ঠিকানা।

করোনা সংকট পেরিয়ে আমেরিকা কবে পুরো সচল হবে- তা কেউই জানে না। কেউ জানে না, কবে গোটা বিশ্ব মুক্তি পাবে করোনা মহামারী থেকে।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, সংবাদকর্মী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর