করোনা সংক্রমণের ৬ মাস; কোথায় আছি আমরা?
৬ মে ২০২০ ১৭:২৮
করোনাভাইরাস নিয়ে প্রায় ২ সপ্তাহ কিছু লিখি না। সবার লেখা পড়ছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম। সবার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যার যার নিজের চেষ্টা দিয়ে উঠেপড়ে লাগার যে প্রচেষ্টা এটা আমার অভূতপূর্ব মনে হয়েছে। যারা জনস্বাস্থ্যের মানুষ নন, তারাও পড়ালেখা করে কিছু একটা দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন, তাদের এই চেষ্টা পুরোই যৌক্তিক। কেননা আমি আগেও বলেছি এখনও বলি, করোনাভাইরাস নিয়ে আমরা কেউই প্রায় কিছুই জানি না।
যারা এই বিষয়ে কথা বলছেন সবাই এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত নিয়ে নিজের জ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক ধারণা নিয়ে লিখছেন। তাই এমন না যে পৃথিবীতে ২০ জন করোনাভাইরাস বিশেষজ্ঞ আছেন, কেবল তারাই লিখবার অধিকার রাখেন, অন্যরা রাখেন না।
তবে যে হাজার হাজার সোশ্যাল আর্টিকেল লেখা হচ্ছে তার মধ্যে যাদের ধারণা বাস্তব হচ্ছে তারা নায়ক হচ্ছেন। যাদের ধারণা ভুল হচ্ছে তারা ভিলেন হয়ে যাচ্ছেন। তাই তথ্যের উপস্থাপনার সময় এটি বারবার বলা দরকার যে, যেকোন ধারণাই ভুল বা সঠিক হতে পারে। যারা লিখবেন তাদের এটি খেয়াল করে লেখা উচিত যে— লেখায় ধারণা থাকতে পারে, তবে যেসব ভুল তথ্য মানুষ অনুকরণ করবে সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য।
আজকে করোনাভাইরাসের এমন কিছু ধারণা নিয়ে লিখছি যা হয়তো সবার চিন্তার খোরাক যোগাতে পারে। গত দুই মাসের নিরবিচ্ছিন্ন পড়ালেখা, গবেষণা এবং আশেপাশের জানা-অজানা তথ্য বিশ্লেষণ করেই এই লেখাটি।
করোনাভাইরাস কি সহসা নির্মূল হবে?
সম্ভাবনা খুব কম। অনেকে বলতে পারেন ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হলেই তো হয়ে যাবে। আসলেই কী তাই? করোনাভাইরাসের ওষুধ বা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা অনেক হচ্ছে। করোনাভাইরাস চলে যাবে কিনা তা জানার আগে আসুন সংক্ষেপে করোনাভাইরাসের অতীতটা একটু জেনে আসি, যা আমাদের অনেকেরই হয়তো অজানা। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কারভাবে জানা জরুরী।
– করোনাভাইরাস প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৩০ সালে। পোষা মুরগীর শ্বাসনালীতে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ লক্ষ্য করা যায়।
– মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে এমন করোনাভাইরাস প্রথম চিহ্নিত হয় ১৯৬০ সালে।
– মুকুটের মতো আকৃতি বলে এই ভাইরাসের নাম করোনা দেন জুন এলমিডা এবং ডেভিড টাইরেল।
সুতরাং প্রায় শতবর্ষী এই ভাইরাস হঠাৎ করেই যেমন আসেনি, তেমনি হঠাৎ করেই চলে যাবে— এমনটি ভাবারও কোন কারণ নেই। উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না তো? পুরো লেখাটি পড়ুন তাহলে। শেষ লাইনে গিয়ে সন্তুষ্ট হলেও হতে পারেন, তবে না হবার সম্ভাবনা বেশি।
করোনাভাইরাস মৃত মানুষের দেহে বেঁচে থাকে?
মনে হয় না। ভাইরাস জীবটাই বেশ শৌখিন! সে চায় না তার আক্রমণে মানুষ বা অন্য প্রাণী মারা যাক। সে মনের আনন্দে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু কাউকে সাধারণত মারতে চায় না, কেননা যেই শরীরের দেহে ভাইরাসটি বাস করে, সেই শরীরের মৃত্যু হলে ভাইরাস নিজেও মরে যায়। ভাইরাস একাকী বাঁচতে পারে না, তার বাঁচার জন্য একটি জীবিত বাহক দরকার হয়। সে তার বাহককে অসুস্থ করে তার মধ্যে হাঁচি-কাশির তৈরি করে। তারপর সেই হাঁচি-কাশিকে বাহক বানিয়ে তার মাধ্যমে নানা জায়গায় ছড়িয়ে অন্য প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করে। দিন দিন তার আকার-আকৃতি-ধরণ পাল্টাতে থাকে। কিন্তু সে চায় না তার বসবাসের আবাসটি মরে যাক। কেননা আবাস্থলের মৃত্যু হলে ভাইরাস হিসেবে করোনাভাইরাসও মৃত মানুষের দেহে বাঁচতে পারবে না বেশিক্ষণ।
করোনায় মৃত মানুষের দাফনে অংশগ্রহণ না করা কতটা গ্রহণযোগ্য?
করোনাভাইরাস মৃতদেহে বাঁচতে পারে না। অজ্ঞাত যেসব অনলাইন নিউজে মাটির নিচের মৃতদেহ থেকে করোনা ছড়িয়েছে টাইপ নিউজ হয়েছে, সেগুলো আপনি চোখ বন্ধ না; চোখ খোলা রেখে অবিশ্বাস করতে পারেন। মারা যাওয়ার পর শরীরের যাবতীয় কাজ থেমে গেলে লাশ হিমাগারে রেখে, হাসপাতালের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে, অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করে, ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে, কবরস্থানের অনুমতি নিয়ে দাফন করা পর্যন্ত যেতে বাংলাদেশে এখন ২-৩ দিন ন্যূনতম লেগে যায়। ততদিনে করোনাভাইরাস মরে যাবার কথা।
হ্যাঁ, করোনাভাইরাস লাশের শরীরে না থাকলেও হাসপাতালে, হাসপাতাল থেকে বের হবার সময় ফুটপাথে জব্বার মিয়ার থুতুতে, কবরস্থানের গেইটের গায়ে, পথের মধ্যে আফজাল খানের হাঁচি থেকে উড়ে আসা ড্রপ্লেটের মাধ্যমে অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে অনেক জায়গায় থাকতে পারে। সেখান থেকে আপনার শরীরেও ছড়াতে পারে। তবে বাবা-মায়ের মৃত লাশ, যা মোড়ানো থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ লাশ ঢাকার নিশ্ছিদ্র কাভারে। সেখান থেকে আপনি করোনায় আক্রান্ত হবেন, এই ভয়ে জীবিত ও অসুস্থ বাবা-মাকে জঙ্গলে রেখে আসবেন না কিংবা তাদের দাফন না করে লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে যাবেন না।
করোনাভাইরাসে মৃত মানুষের লাশ দাফন হয় পুলিশ পাহারায়, সেই লাশ থেকে ১০ হাত দূরে দাঁড়িয়ে বাবা-মার জন্য দোয়া করবেন না, দাফন করবেন না, এতটা ভয়াবহ করোনাভাইরাস এখনও হয়নি। এ বছর করোনাভাইরাসে মানুষ মারা গেছে ২ লক্ষ ৫০ হাজারেরও কম। অথচ বিশুদ্ধ পানির অভাবজনিত কারণে মারা গেছে ২ লক্ষ ৯০ হাজার মানুষ। তাই নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকবেন। করোনার প্রকোপ একদিন কমে আসবে, কিন্তু বাবা-মার প্রতি দায়িত্বহীন আচরণ নিয়ে আপনি আর আপনার বিবেক এক শরীরে কীভাবে থাকবেন— সেই বোঝাপড়াটা এখনই করে নিন।
করোনাভাইরাস তো আবিষ্কার হলো গত সেপ্টেম্বরের দিকে, তাই না?
না। করোনাভাইরাস প্রথম ধরা পড়ে ১৯৩০ সালে মুরগীর মধ্যে, আর ১৯৬০ সালে মানুষের মধ্যে। এখন পর্যন্ত সাত ধরণের করোনাভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলো মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। এর মধ্যে বর্তমানে যে ভাইরাসটি ও মাধ্যমে সৃষ্ট রোগটি দেখা গেছে তার নাম ‘কোভিড-১৯’। কিন্তু এই নামটি মানুষের মুখে প্রচলিত হয়নি। এর আগে করোনাভাইরাস সৃষ্ট আরো দুটি রোগের নাম আমরা সবাই জানি— সার্স এবং মার্স।
সার্স এবং মার্সও ভয়াবহ রোগ। কিন্তু মূলত ধনী ও উন্নত বিশ্বের মানুষদের সার্স ও মার্স রোগ কম আক্রান্ত করায় এটির চাইতে বর্তমান করোনাভাইরাসের হাঁক-ডাক বেশি। আমি মনে করি, করোনাভাইরাস যদি আগের সার্স ও মার্সের মতোই আফ্রিকার কোন অজপাড়াগাঁয়ে বা অল্প কিছু উন্নত দেশের স্বল্পকিছু মানুষকে আক্রমণ করত, তাহলে এটি নিয়েও সম্ভবত এত হৈচৈ হতো না।
পৃথিবীর সব সর্দি কাশির তিনভাগের এক ভাগের জন্যই নাকি করোনাভাইরাস দায়ী?
একদম ঠিক। সার্স, মার্স ও কোভিড ১৯ এর আগের যে অন্য ৪টি করোনাভাইরাস, সেগুলোতে আক্রান্ত হয়ে মানুষ কম মরলেও সেগুলোতে আক্রান্ত হবার সংখ্যা অনেক বেশি। পৃথিবীতে যত মানুষ সাধারণ সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হয় তার প্রতি ১০ জনের ৩ জনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এই করোনা ভাইরাসগুলোর নাম জানা যাক তাহলে-
১) HCoV-OC43
২) HCoV-229E
৩) HCoV-NL63
৪) HCoV-HKU1
এই করোনাভাইরাসগুলো কিন্তু নির্মূল হয়নি। যদিও উন্নত দেশগুলোতে ফ্লু ভাইরাসের টিকা বের হয়েছে এদের প্রতিরোধ করতে, কিন্তু তা প্রতিবছরই দিতে হয়। এই ব্যাপারটা খুব ভালো করে খেয়াল করুন। যদিও এই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষের মধ্যে কিছুটা ইমিউনিটি গ্রো করে, কিন্তু পুরোপুরি প্রতিরক্ষা তৈরী হয় না। তাই ভ্যাকসিন তৈরি হবার পরও প্রতিবছর এই ৪টি করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য এখনও মানুষকে ভাইরাস দিয়ে যেতে হচ্ছে। অর্থাৎ একবার কোভিড-১৯ হলে আপনার হয়ত ইমিউনিটি হবে, আপনি হয়ত পরবর্তীতে মারা যাবেন না এর সংক্রমণে; কিন্তু তাই বলে এটি আর কখনই হবে না এমন নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে করোনা ভাইরাসের ভয়ে আধমরা হয়ে বাঁচলেও চলবে না, আবার আমাদের স্বাস্থ্যবিধিতে যে আচরণগত পরিবর্তন এসেছে, তা আর কখনো ভুলে যাবারও সুযোগ থাকছে না।
করোনাভাইরাস আর সার্সের অনালোচিত কিন্তু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য কী?
সার্সের সময় শুধুমাত্র যারা আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে যেত তারাই অন্যের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিত। কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে আপনার পাশের বাসার মানুষটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় বা রাস্তায় আপনার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া অজানা মানুষটিও কোন লক্ষণ ছাড়াই এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে। সুতরাং সার্সের সময় শুধুমাত্র যারা আক্রান্ত হয়েছিল তাদেরকে আলাদা করেই সার্স নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছিল। কিন্তু করোনায় যেহেতু কোনরকম লক্ষণ দেখানো ছাড়াই রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাই এদের পার্থক্য অনেক বড়।
সার্সে মৃত্যুর হার ছিল শতকরা ১০ শতাংশ, সেখানে করোনাভাইরাস ডিজিজে মৃত্যুর সংখ্যা শতকরা ১ ভাগেরও কম, এই কথাটি কি সঠিক? সার্স, করোনাভাইরাস ডিজিজের চাইতে অনেক বেশি ভয়ংকর ছিল মূলত মৃত্যুর শতকরা হিসেবে। পৃথিবীর প্রায় ২৯টা দেশের ৮০০০ মানুষ সার্সে আক্রান্ত হয়েছিল। মারা গিয়েছিল প্রায় ৮০০ মানুষ। অর্থাৎ মৃত্যুর হার ১০ শতাংশেরও বেশি। যেখানে করোনাভাইরাস ডিজিজে মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত ১ শতাংশেরও কম। এছাড়াও বিশ্বে যে কোটি কোটি মানুষকে কোন লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই এই ভাইরাসটি ইতিমধ্যেই সংক্রমিত করলেও তারা সুস্থ হয়ে গেছেন। সেই বিবেচনায় বলা যায় আসলে করোনাভাইরাস ডিজিজে মৃত্যুর হার শতকরা ১ ভাগেরও অনেক কম এখন পর্যন্ত।
খেয়াল করুন- পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা ৭৮০ কোটির মতো। এর ১ শতাংশ করোনাভাইরাস ডিজিজে মৃত্যুবরণ করলে সংখ্যাটি হতে হবে ৭ কোটি ৮০ লক্ষ। অথচ করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা এখনও ৩ লক্ষের কম। টেস্ট করে যে ৩৫ লক্ষ আক্রান্ত হিসেবে ধরা হচ্ছে, সেই গাণিতিক হিসেবেও মৃত্যুর হার ৯ শতাংশের মতো। কিন্তু জনস্বাস্থ্যে বিশেষজ্ঞরা কখনই লক্ষণ প্রকাশ না করে সুস্থ হয়ে যাওয়া কোটি কোটি মানুষকে এই হিসেবের বাইরে রাখছে না। তবে এটি সঠিক আরো বহুদিন পর, করোনার মহামারী যখন শেষ হবে, তখন মূল মৃত্যুর হার বোঝা যাবে, যা আমি আমার লেখাপড়া ও গবেষণা থেকে বলতে পারি, ১ শতাংশের কম হবার সম্ভাবনা নিশ্চিত প্রায়।
কিছু গবেষণায় মে মাসের প্রথমভাগেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে ৭ লক্ষ মানুষ মারা যেতে পারে বলে যে দাবি করা হয়েছিল, সেটির সত্যতা কতটুকু?
এই গবেষণার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য সেক্টরে মুখচেনা এবং প্রশংসিত গবেষক। আমি খুবই মনোযোগ দিয়ে তাদের গবেষণাপত্রটি পড়েছি। গবেষণাটিতে নির্দিষ্ট একটা মডেল ফলো করে ইউরোপের কেইস হিস্ট্রিকে ভিত্তি করে মূলত অংক কষে একটি সংখ্যা বলে দেয়া হয়েছে। এই অংকে কোন ভুল নাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শুধু অংক কষলেই তো হবে না। জনস্বাস্থ্যে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব আছে, কিন্তু সেটা সীমিত।
জনস্বাস্থ্যের মূল বিষয় হচ্ছে সামাজিক ও আচরণগত বিজ্ঞান, যা এই গবেষণায় ছিটেফোঁটাও ছিল না। তাই ইউরোপ, চীনের পরিস্থিতি বিবেচনায় যে হিসাব দেয়া হয়েছে তা যে কখনই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশে বাস্তবতার নিরিখে প্রযোজ্য হবে না— সেটি পড়লেই বোঝা যাচ্ছে।
আশা করা যায় ভবিষ্যতে এই ধরণের সংখ্যাগত কিংবা পরিসংখ্যানগত গবেষণা করার সময় সামাজিক ও আচরণগত বিজ্ঞানীদের পরামর্শ নিয়ে মডেল দাঁড় করানো হবে, যা বাস্তবতার নিরিখে তথ্য-উপাত্ত তৈরি করতে সহায়তা করবে। তবে গবেষকদের কাজের জন্য তাদেরকে কখনই সমালোচনার মুখোমুখি করানো ঠিক নয় যতক্ষণ পর্যন্ত তারা জ্ঞানের অন্বেষণে এই কাজটি করেন।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ২০০ জন, অথচ আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলেম সমাবেশ, কাওরান বাজারের বেচাকেনা কিংবা গত মাসে কাজে ফেরত আসা লাখো গার্মেন্টস শ্রমিকদের সম্মেলনের পর ধারণা করা হচ্ছিল লাখ লাখ বাংলাদেশী মারা যাবে। আসলে কী হলো?
দেখুন, এই বিষয়টি একটি রহস্যের মতো বলা যায়। এই তিনটি ঘটনায় মানুষের উদ্বেগ খুবই স্বাভাবিক ছিল। যদিও এখনও সময় আছে। তবুও বলা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কাওরান বাজার কিংবা গার্মেন্টসকেন্দ্রিক মহামিলনের পর যেই হারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর আশংকা করা হয়েছিল, বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এর সঠিক কারণ পৃথিবীর কারো পক্ষেই বলা সম্ভব না। তবে যে যে কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার কম বলে আমি মনে করি-
১) অনেকে ধারণা করছেন বাংলাদেশের করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ৮ মার্চ। কিন্তু আমার ধারণা, চীনের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক থাকার কারণে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে আরো আগে, সম্ভবত ফেব্রুয়ারিতেই। তাই অনেকেই আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন কোন লক্ষণ প্রকাশ না করেই। আর যারা মারা গেছেন তাদের অন্যরোগের ফলাফল হিসেবে ধরা হয়েছে।
২) ঘনবসতির কারণে আমরা অন্য দেশের তুলনায় দ্রুততম সময়ে হার্ড ইমিউনিটির দিকে যাচ্ছি।
৩) বাংলাদেশের অত্যাধিক তাপমাত্রা। অতি উচ্চ তাপমাত্রায় ড্রপলেট দ্রুত শুকিয়ে যায় ফলে করোনাভাইরাস ড্রপলেটে ভর করে ততটা ছড়াতে পারেনি। যতটা আশংকা করা হয়েছিল।
৪) করোনাভাইরাসের নানা ধরণ আছে। এটি আগের চাইতে নতুন নতুন ও ভিন্নরূপে প্রকাশ পাচ্ছে এবং নানা প্রকারের করোনা নানা দেশের মানুষকে আক্রান্ত করছে। বাংলাদেশে যে করোনাভাইরাস আক্রমণ করেছে, সেটি হয়ত অতটা বিধ্বংসী না।
৫) বাংলাদেশের খাবার, পরিবেশ, দূষণ ইত্যাদির সাথে অভ্যস্ততার কারণে আমাদের এই বিশেষ ভাইরাসের প্রতি ইমিউনিটির গভীরতা কি অন্য দেশের চাইতে বেশী? হতেও পারে।
৬) আমাদের প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করে কোয়ারেন্টাইন বজায় রাখতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন। একজন গরীব দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটাও তার জন্য অনেক বড় সিদ্ধান্ত ছিল।
এটি মনে রাখা দরকার, চীন ছাড়া পৃথিবীর কোন দেশ শতভাগ লকডাউন বা কমিউনিটি সংক্রমণ ঠেকাতে পারেনি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এটি করা সম্ভব না। কানাডাতেও অনেক মানুষ বাইরে গিয়েছেন, এখন অনেকেই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু বড় দেশ ও জনসংখ্যা কম হওয়ায় সেখানে না চাইলেও অনেক সময় ৬ ফিট দূরত্ব থেকেই যায়। তাই সেই তুলনা বাংলাদেশের সাথে করলে তো হবে না। যদিও মনে করছি মৃত্যুর হার কম, কিন্তু আমি মনে করছি না আমাদের সংক্রমনের হার কম। যেহেতু আমাদের টেস্টের পরিমাণ জনসংখ্যার অনুপাতে অনেক কম তবুও দেখবেন টেস্টের অনুপাতে পজিটিভ রোগীর সংখ্যা পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে অন্যতম বেশি। সেই হিসেবে আমাদের দ্রুত হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছে যাবার যে ধারণা, তা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
করোনাভাইরাসে মৃত্যু কম হবার পেছনে দেশের মানুষের ভূমিকা আছে কী?
অবশ্যই আছে। এতো ছোট একটি দেশে প্রায় ২০ কোটি মানুষের বসবাস, সেখানেও এই ভাইরাসকে রুখে দেবার জন্য জনগণের একটা বড় অংশের সদিচ্ছা ছিল দেখার মতো। কোটি কোটি মানুষ সপ্তাহর পর সপ্তাহ ঘরে বসে থেকেছেন। গরীব মানুষ বাধ্য হয়ে বাইরে গিয়েছে। কিছু সহজ সরল মানুষ আড্ডা ও চা খেতে বাইরে গেলেও মাস্ক পরার চেষ্টা করেছেন। অনেকের অনেক গাফেলতি ছিল, সচেতনতার অভাব ছিল। হয়ত অনেকের ইচ্ছার অভাবও ছিল, কিন্তু সার্বিকভাবে দেশের মানুষের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ দিতেই হবে। শতভাগ মানুষ টানা ১৪ দিন ঘরে থাকতে পারলে ভালো হতো, না হলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পুরোপুরি কোনভাবেই ঠেকানো যায় না। তাই অবশ্যই বাংলাদেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। কিন্তু আবার অনেক মানুষ ঘরে থেকে নিজে আক্রান্ত হননি এবং অন্যকে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন। একই সময়ে অনেকের করোনা হয়েছে, তারা ইমিউনিটি পেয়েছেন। এই সাফল্যের কৃতিত্বের ভাগীদার দেশের মানুষ তো বটেই। এত ঘনবহুল একটা দেশে আমরা তো কখনও এভাবে
গৃহবন্দি হবার পরিস্থিতিতে পড়িনি আগে কখনও।
করোনা পরিস্থিতিতে সামনে কী আসছে?
সত্য কথা হচ্ছে, আমরা যারা জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি, যারা পলিসি নিয়ে কাজ করেন, যারা গবেষণা করেন, যারা রাজনীতি করেন, যারা চিকিৎসা দেন, আমরা সবাই যদি আপনাদের কাছে সৎ থাকি, তাহলে বলতে হবে, সামনে কী হবে আমরা জানি। আমরা জানি এই ভাইরাসের আগের যে ৪টি ধরন, যার কারণে সর্দি কাশি হয়, সেগুলো কিন্তু পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, বরং বেশ ভালোভাবেই রাজত্ব করছে। তাই আমরা জানি না-
১) ভ্যাক্সিন বের করা যে প্রক্রিয়া তা কার্যকরী হবে কিনা?
২) হলে তা কি একজনকে আজীবনের জন্য ইমিউনিটি দিবে?
৩) সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষের সবাইকে কি এই ভ্যাক্সিন আদৌ দেয়া যাবে? গেলে কবে নাগাদ?
৪) কোন ঔষুধ আবিষ্কারে পথে নেই। আমেরিকায় যে ঔষধ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে (remdesivir), তাকে করোনার ঔষুধ কোনভাবেই বলা যায় না, এবং এর কার্যকারিতা খুব ভালো তো দূরের কথা, কেবলমাত্র ঠেকা দেবার উপযুক্ত বলা যায় হয়ত।
৫) পৃথিবীতে এখনো মাস্ক, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ বেড, হাই ফ্লো অক্সিজেন সরঞ্জাম প্রয়োজনের চাইতে অনেক কম।
৬) মহামারীতে সেকেন্ড ওয়েভ, থার্ড ওয়েভ স্বাভাবিক। আগামী শীতে আমাদের খুবই কড়া নজর রাখতে হবে করোনার আবার উপদ্রব হয় কিনা।
৭) পৃথিবীর অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। সামনে স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত দেশে দ্রুত ভালো হলেও বেশীরভাগ দেশে পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনেক কম। উপরন্তু ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্য উন্নত দেশের অর্থে নির্ভরশীল দেশের জন্য তেমন আশার বাণী নেই বললেই চলে।
এবার করোনাভাইরাসের রহস্য নিয়ে একটু বলি-
সার্স (SARS) একটি খুবই কম আলোচিত রোগের নাম যা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের রহস্য থেকেই গেছে! ২০০২ সালের শীতে প্রথম সংক্রমণ হয় সার্সের। তখন ধারণা করা হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লুর পর সার্সই হতে যাচ্ছে সবচেয়ে বড় মহামারী পৃথিবী জুড়ে। ২০০২ সালে প্রথম ধরা পড়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সার্সের কথা ঘোষণা করে এবং পৃথিবীকে বড় ধরণের দূর্যোগের জন্য সতর্ক করে। সারা পৃথিবীতে সার্স নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু মাত্র একবছরের মধ্যে ৫ জুলাই ২০০৩ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায় সার্সকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কেইস পাওয়া গেলেও ২০০৪ সালের পর আর কোন সার্স রোগী পাওয়া যায়নি। অথচ সার্সের জন্য কোন ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করে সারা পৃথিবীর মানুষকে সেই ভ্যাক্সিন দেয়াও হয়নি।
যদিও সার্স শুধুমাত্র লক্ষণ প্রকাশ পেলেই ছোঁয়াচে বলে জনস্বাস্থের সামাজিক ও আচরণগত বিজ্ঞানীদের নির্দেশনায় টেস্টের মাধ্যমে কেইস নির্ধারণ, আইসোলেসন, কোয়ারেন্টাইন, কন্টাক্ট ট্রেসিং (অর্থাৎ কার কার সাথে দেখা হয়েছিল, যাদের ছড়াতে পারে), কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ে প্রাপ্ত মানুষদের আলাদা করে রোগ ছড়ানোর চেইন ভেঙে দেয়ার মাধ্যমে সার্স আটকে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু কোন ম্যাস ভ্যাক্সিন ছাড়া এটি নির্মূল হয়ে যাওয়া এখন পর্যন্ত একটি রহস্য। আশার কথা হোক কিছুটা-
তাহলে করোনাভাইরাস নির্মূল হচ্ছে না, অন্তত সহসা। তাহলে কি কোন আশার বাণী নেই? আছে। কী সেগুলো?
১) পৃথিবী ইতোমধ্যেই হার্ড ইমিউনিটির দিকে এগিয়েছে।
২) আশংকার চাইতে সারা বিশ্বে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক কম এখন পর্যন্ত।
৩) মানুষ অনেক বেশী সচেতন হয়েছে, সরকারগুলো যার যার সামর্থ্য নিয়ে যে ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে পৃথিবীর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও মানুষের জীবন যে তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখে তা প্রমাণিত হয়েছে।
৪) করোনা প্রতিরোধের মূলমন্ত্র এখনও মানুষের কাছে। নিয়মিত হাত ধুয়ে, দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিকতা বজায় রাখলে, পুষ্টিকর খাবার খেলে, প্রতিবেশীর চাইতে পরিবারকে বেশী গুরুত্ব দিলে, স্বাস্থ্যাভ্যাস বজায় রাখলে ভালো থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশী বেড়ে যায়।
৫) পৃথিবীকে সারা জীবন আটকে রাখা সম্ভব না। সবকিছু আস্তে আস্তে খুলে যাবে। সেটি নিয়ে হৈচৈ না করে নিজের জীবন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা সম্ভব। বিলাসী আচরণ ত্যাগ করে সমাজ, দেশ ও সমাজের গরীব মানুষদের সহায়তায় স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে এগিয়ে এসে একে অপরকে বাঁচতে সহায়তা করা যায়।
৬) সরকার সব খুলে দিলেও আপনি পরিমিত জীবনযাপন করলে সব জায়গায় যাওয়া আপনার জন্য জরুরী নয়।
৭) যাদের বয়স বেশী কিংবা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, যকৃতে প্রদাহ আছে তাদের ঘরে রেখে অন্যরা সতর্কতার সাথে প্রয়োজনীয় কাজে সংশ্লিষ্ট হতে পারেন।
৮) করোনা একেবারে যাবে না। ক্যানাডার মতো উন্নত দেশে এতো কিছু করার পরেও ২ মাস পরেও একটা প্রদেশে প্রায় প্রতিদিনই ৫০০ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছেন ৫০ জন করে। এটি স্বাভাবিক। বাংলাদেশেও কিছু মানুষ মারা যেতে থাকবেন, অনেক মানুষ আক্রান্ত হতে থাকবেন, এটি ঠেকানো যাবে না লকডাউন করে, বরং ব্যক্তিগত ও এলাকাভিত্তিক সতর্কতা এই সংক্রমণ কমিয়ে দিতে পারে অনেকাংশে।
তাই সার্বিকভাবে মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকুন। স্বাস্থ্যাভ্যাস যা গড়ে উঠেছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। আশেপাশের পরিবর্তনে, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে অহেতুক হতাশ না হয়ে নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নিয়ে সুস্থ রাখা যায় সেই চিন্তা করতে হবে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। অল্প খেতে হবে, অহেতুক ব্যয় কমাতে হবে দেশে ভবিষ্যতের জন্য।
আগামী কয়েকবছর বিদেশে পর্যটনের টাকা নষ্ট করবেন না। বিদেশী পণ্য কিনবেন না। আপনার সামর্থ্য থাকলে সেই টাকা আপনার বাসার কাজের মানুষ, ড্রাইভার, বুয়া, রিকশাওয়ালাকে প্রয়োজনের চাইতে বেশি দিয়ে উপকার করুন। শুধু অনলাইনে বা অজানা অচেনা দাতব্য সংগঠনে টাকা দিয়ে সাহায্য করার চাইতে সবাই যদি নিজের চারপাশের মানুষগুলোকে সুস্থ রাখেন তাতে সবাই ভালো থাকবে। ইতিবাচক থাকুন। ইতিবাচক আলাপ করুন। সুস্থ্য জীবনযাপন করুন।
লেখক: সোশাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো