Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লকডাউন নয়, `ফোর-টি পদ্ধতিতে’ বাজিমাত দক্ষিণ কোরিয়ার


১২ মে ২০২০ ১৪:৫৮

উত্তর-পূর্ব এশিয়ার গবেষনা ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। এখানকার সবচেয়ে মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং গবেষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পিএইচডি এবং পোষ্টডক্টরালসহ ভালো গবেষণাপত্র এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। দেশটির বড় কোন পরিকল্পনা বা সংকটকালীন স্ট্র‍্যাটেজিক প্ল্যানের জন্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইসব মেধাবী শিক্ষক এবং গবেষকদের মতামতকে গ্রহন করে, কোন আমলা কিংবা রাজনৈতিক নেতার মতামত নয়। মূলত শিক্ষক-গবেষকরাই সরকারকে সংকট মোকাবেলার মডেল তৈরি করে দেয়, সরকার শুধু সেই অনুযায়ী বাস্তবায়ন করে।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কোন প্রকার লকডাউন ছাড়াই দেশটি এখন পর্যন্ত অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কিছুদিন আগেও যেখানে প্রতিদিন দেশটিতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি ছিলো, চীনের পরে করোনাভাইরাসের এপিসেন্টার হতে বসেছিলো, সেই দেশটিতে এখন নতুন করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা শুণ্য! মোট আক্রান্তের বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এই অসামান্য অবদানের জন্য দেশটির রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান জাং ইউন কেইয়ংকে জাতীয় বীরের খেতাব দেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্ব যেখানে করোনাভাইরাসের ছোবলে বিপর্যস্ত, সেখানে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রনে দক্ষিন কোরিয়ার এই সফলতার রহস্য কি?

বিজ্ঞাপন

প্রথমত, তাদের সফলতার মূল জায়গা ২০১৫ সালের মার্স (MERS) ভাইরাস থেকে শিক্ষা নেয়া। ২০১৫ সালে মার্স ভাইরাস সংক্রমনের সময় একজন কোরিয়ান ব্যবসায়ী মধ্যপ্রাচ্য থেকে কোরিয়াতে আসেন। পরে তিনি অসুস্থবোধ করায় তাকে তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপরে সনাক্ত করা যায় যে তিনি মার্স ভাইরাসে আক্রান্ত। ততদিনে তার থেকে মার্সের চেইন সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে। বিশেষত সেই হাসপাতালগুলোর ডাক্তার, নার্স, ষ্টাফ, অন্যান্য রোগী অনেকেই আক্রান্ত হয়। তখন সেই মার্স ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রন করতে দক্ষিন কোরিয়াকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিলো।

সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিটি হাসপাতালে সংক্রামক রোগ নির্নয় ও চিকিৎসার আলাদা ইউনিট করা হয়। তারা বুঝতে পারে সংক্রামক রোগ দমনের জন্য সর্বপ্রথম ডাক্তার, নার্স, হেলথ প্রফেশনালিষ্ট এবং হাসপাতালের সুরক্ষা প্রয়োজন। কারন এদের কেউ আক্রান্ত হলে তাদের মাধ্যমে সেটি আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এছাড়া তারা উপলব্ধি করে যে সংক্রামক রোগীকে যত দ্রুত
সম্ভব বেশি বেশি পরীক্ষা করে সনাক্ত করে আলাদা করতে পারবে, তত দ্রুত সংক্রামক রোগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে।

তাই করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দক্ষিন কোরিয়া লকডাউন স্ট্র‍্যাটেজিতে না গিয়ে ‘ফোর টি’ স্ট্র‍্যাটেজিতে যায়। পরীক্ষা, খোঁজ, সনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা। চীনের উহানে যখন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছিলো, তখন তাদের গবেষকরা করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষনা করতে শুরু করে।

প্রথমেই দেশটির সকল ডাক্তার, নার্স, হেলথ প্রফেশনালিষ্টদের জন্য শতভাগ সুরক্ষা পোষাক নিশ্চিত করা হয়। তাদেরকে উৎসাহ প্রদান করা হয়। কোরিয়া সরকার ডাক্তারদের এতটাই সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে যে, দাবি করা হচ্ছে এখনো পর্যন্ত কোরিয়াতে কোন ডাক্তার কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি!

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের যোদ্ধাদের ঢাল-তলোয়ার দিয়ে প্রস্তুত করার পর তারা দ্রুত করোনাভাইরাস সনাক্তকরণ কিট তৈরিতে মনোযোগী হয়। গবেষনানির্ভর দেশ হওয়াতে তাদের অনেক বিশ্ববিখ্যাত বায়োটেকনোলজি কোম্পানি আছে। চীনের উন্মুক্ত করে দেয়া করোনাভাইরাসের কমপ্লিট জিনোম সিকুয়েন্স থেকে তারা দ্রুত করোনাভাইরাস সনাক্তকরণ কিট তৈরি করে ফেলে।

সারাদেশে ৬০০ এর বেশি করোনাভাইরাস সনাক্তকরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয় যেখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০০০০ (বিশ হাজার) স্যাম্পল টেষ্ট করা সম্ভব! করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতাল, টেষ্ট কিট সম্বলিত যোদ্ধা এবং যুদ্ধের উপকরণ তৈরি করা শেষে দক্ষিন কোরিয়া শুরু করে আসল যুদ্ধ। প্রথমেই তারা চীন ফেরত এবং করোনার লক্ষন প্রকাশ পাওয়াদের টেষ্ট শুরু করে। এর মাঝে যাদের করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়, তাদের কন্টাক্ট ট্র‍্যাকিং এবং ট্রেসিং করে বিগত ১৪ দিনে তারা যাদের সংস্পর্শে এসেছে তাদের সবাইকে দ্রুত টেষ্ট করে। সবকিছু কন্ট্রোলে থাকলেও ৩১ তম রোগী হাসপাতাল থেকে চার্চ গমনের মাধ্যমে ক্লাস্টার সংক্রমন শুরু হয়। সেটিকে কন্ট্রোলে আনতে সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।

তবুও সরকার লকডাউনে না গিয়ে দ্রুত আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে করোনা টেষ্ট করে। লোকেশন ট্র‍্যাকিং এবং ট্রেসিং এর জন্য সরকার আইডি কার্ড, ব্যাংক কার্ড, মোবাইল সিম, সিসিটিভি ফুটেজ ইত্যাদি তথ্য ব্যবহার করে। খুব দ্রুত বেশিরভাগ সন্দেহভাজনদের করোনা টেষ্ট করিয়ে তাদের আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইন করে ফেলে। কোনপ্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কিংবা তথ্যগোপন ছাড়াই প্রতিদিনের নতুন আক্রান্ত, মৃত এবং সুস্থ সংখ্যা নিয়মিত ব্রিফিং করে জানানো হয়। করোনা রোগীর অবস্থান জানার জন্য ‘করোনা হান্ড্রেড এম’ নামে মোবাইল এপস চালু করে। করোনা আক্রান্ত কোন ব্যক্তির ১০০ মিটারের মধ্যে আসলেই এপস আপনাকে এলার্ম দেবে।

আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রতিটি ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট গাইডলাইন দেয়া হয়। তাদের প্রত্যেকের ব্যবহার করা টিস্যু এবং বর্জ্য ফেলার জন্য আলাদা ব্যাগ দেয়া হয় যেটি স্বাস্থ্যকর্মীরা নির্দিষ্ট সময় পরপর গিয়ে সবার বাসা থেকে নিয়ে এসে ভালোভাবে পুড়িয়ে ফেলে। এছাড়া তাদের সার্বক্ষণিক অবস্থান জানার জন্য এবং তারা কখনো নির্দিষ্ট রুমের বাহিরে যাচ্ছে কিনা সেটি জানার জন্য মোবাইলের জিপিএস চালু রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রয়োজনে তাদের খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ঘরে পৌছে দেয়া হয়।

করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ক্যাটাগরি করা হয়। রাজনৈতিক কিংবা আর্থিক প্রাধান্য নয়, অসুস্থতার ভিত্তিতে সেবাদান নিশ্চিত করা হয়। বেশি অসুস্থদের ভালো হাসপাতালে এবং অপেক্ষাকৃত কম অসুস্থদের সাধারন হাসপাতাল এবং ডরমিটরিতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে কোরিয়ার স্যামসাং, হুন্দাইয়ের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ডরমিটরিকে আইসোলেশন কেন্দ্র হিসেবে সরকারকে দেয়। উন্নত চিকিৎসা সেবার কারনে কোরিয়ার সুস্থ হবার হার ৭০ ভাগের বেশি যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি দেশের সকল জনগনও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা করে। নিয়মিত মাস্ক পরিধান, সামাজিক দুরত্ব মেনে চলা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার, স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টাইনে থাকাসহ সকল প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন করে। সরকার এবং জনগনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাত্র দুই মাসের মধ্যে কোরিয়ায় নতুন করোনা রোগীর সংখ্যা এখন শুন্য।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কোরিয়ান ফোর টি স্ট্র‍্যাটেজি সারা বিশ্বে এখন প্রশংসিত। জাতিসংঘের মহাসচিব কোরিয়াকে মডেল দেশ উল্লেখ করে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সকল দেশকে কোরিয়াকে অনুসরনের আহবান জানান। বাংলাদেশের করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় নীতিনির্ধারকরা দক্ষিন কোরিয়াকে অনুসরন করে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে পারে।

লেখক: পোষ্টডক্টরাল গবেষক, সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর