Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনার দাওয়াই!


১২ মে ২০২০ ১৭:৪১

নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ অসুখের জন্য ওষুধের আশায় সারা পৃথিবীর মানুষ যখন অপেক্ষা করে আছে চাতকের মতো, তখনই একটা বড় উচ্ছাস তৈরি করল বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম। তারা বলতে শুরু করেছে, করোনার অব্যর্থ দাওয়াই তৈরি করে ফেলেছে বাংলাদেশের কয়েকটি ঔষধ কোম্পানি। অবশ্য খোঁজ নিলে দেখা যাবে এইসব পত্রিকা বা চ্যানেলের মাতৃ কোম্পানির মালিকানাধীন ঔষধ কোম্পানিগুলোই এই ওষুধ প্রস্তুত করছে। এসব গণমাধ্যম তাদের মালিকপক্ষের জন্য যে পিআর বা জনসংযোগ সেবা দিচ্ছে সেটা এসব খবর দেখে বোঝার উপায় নেই।

বিজ্ঞাপন

ওষুধের নাম রেমডিসিভির। বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমে রেমডিসিভিরকে নিয়ে যেভাবে খবর প্রচারিত হয়েছে তাতে মনে হবে পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই করোনা চিকিৎসায় কার্যকর ওষুধ চলে এসেছে। অথচ কিছুদিন আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ গবেষণার বিশেষ দূত ডেভিড নাবারো বলেছেন, ‘‘এমন কিছু ভাইরাস আছে, যাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর টিকা এখনও আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। কোভিড-১৯ এর টিকা আদৌ বেরবে কি না, সে ব্যাপারে আমরা মোটেই নিশ্চিত নই। না-ও বের হতে পারে। যদি কোন টিকা বের হয়ও, তা হলে সেটা বাজারে আসার আগে সব পরীক্ষায় পাশ করবে কি না, তারও কোনও গ্যারান্টি দেয়া সম্ভব নয়।’’

বিজ্ঞাপন

ঠিক এ জায়গাতেই আসল প্রশ্ন। নিশ্চিত কোন ঔষধ না থাকায় মুলত উপসর্গের উপর ভিত্তি করে এ রোগের চিকিৎসা চলছে সারা পৃথিবীতে। এই তালিকায় প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের আ্যন্টিবায়োটিক, আ্যন্টি ভাইরাল, আ্যন্টি ম্যালেরিয়াল ঔষধের প্রয়োগও চলছে। কোনটিকেই বলা হয়নি এটাই অব্যর্থ দাওয়াই। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (FDA) জিলিয়াদ সায়েন্স (Gilead Sciences Inc) নামে একটি কোম্পানীর অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডেসিভির (Remdesivir) কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহার করার জন্য অনুমোদন দেয়ার পর দ্রুত বাংলাদেশের কিছু ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি এই ওষুধ বাজারে আসার অনুমোদন পেয়ে যায়। এত দ্রুত এমন অনুমোদন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

কিন্তু রেমডেসিভির উৎপাদনের জন্য প্রথম অনুমোদন পাওয়া মার্কিন কেম্পানি জিলিয়াদ সায়েন্স নিজেরাই এখন পর্যন্ত সংশয়মুক্ত হতে পারেনি এই ওষুধ কতটা কার্যকরী হবে তা নিয়ে। বলে রাখা ভালো যে, এর আগে চীনেও কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় রেমডেসিভির ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু চীনা বিজ্ঞানীরা সন্তোষজনক ফল পাননি।

জিলিয়াদ কোম্পানি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি এবং সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গবেষণার ফলাফল জানিয়েছে, তবে একইসাথে তারা এই বিষয়ে আরো গবেষণা করার সুপারিশও করেছে। এই গবেষণার উপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ঔষধটির জরুরি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যারা এর ব্যাপক প্রচার করছে, তাদের কাছ থেকে এ ধরণের তথ্য আসছে না।

এ বিষয়ে যারা ওয়াকিবহাল তাদের এতটা উচ্ছাস নেই এই রেমডেসিভির নিয়ে। অষ্ট্রেলিয়ায় কর্মরত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সাইফুদ্দিন একরাম বলছেন, 'রেমডেসিভির শুধুমাত্র জরুরি ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যেসব রোগীর ক্ষেত্রে আশঙ্কাজনক লক্ষণ দেখা যাবে, বিশেষ করে তীব্র শ্বাসকষ্ট এবং শরীরে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এটা ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু, এটার দীর্ঘ মেয়াদী নিরাপত্তা এবং কার্যকারীতা সম্পর্কে এখনও যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি, তাই শুধু করোনা পজিটিভ হলেই এটা ব্যবহার করা সমীচীন নয়।

ত্বক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এম আর করিম রেজা বলছেন, আমেরিকার কারণেই বিশ্বজুড়ে ম্যালেরিয়ার ঔষধ হাইড্রক্সিক্লোরকুইন নিয়ে অতিমাত্রায় উৎসাহিত দেখা যাচ্ছিল এবং উৎপাদনের হিড়িক লেগে গিয়েছিল। পরবর্তীতে গবেষণায় কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় এটির ক্ষতিকর প্রভাব প্রমাণিত হয়েছে।

এর পরের প্রশ্ন হলো- এই ওষুধের দাম। কেন এতো বেশি দাম রাখছে বাংলাদেশের প্রস্তুতকারকরা, সেই উত্তরটা কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। এই লিংকটা (https://www.npr.org/sections/health-shots/2020/05/08/851632704/putting-a-price-on-covid-19-treatment-remdesivir?

fbclid=IwAR2muHuhAfLmEgdHQP7BcVlsdjHevAAI0I1080xEwci3kCgWDX0ZFnjQSc) পড়লে দেখা যায়, জিলিয়াদ সায়েন্স নিজেরাই এখনও এই ওষুধের দাম ঠিক করতে পারেনি। তাহলে করোনাতে এই ওষুধের ক্লিনিক্যাল কার্যকারিতা নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়েই বাংলাদেশে কেন প্রতি ডোজ ৫/৬ হাজার টাকা ঠিক করা হল? কিসের ভিত্তিতে এই দাম নির্ধারিত হলো তার একটা স্বচ্ছ উত্তর দরকার।

ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামালসহ অন্যান্য খরচের যে হিসেব আসছে এতে করে কোন ভাবেই এই ওষুধের একেকটি ডোজের দাম এক হাজার থেকে ১২০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা না। তবুও বাড়িয়ে যদি বলি তাহলে ২০০০ টাকা। তাহলে কেন পাঁচ বা ছয় হাজার টাকা বলা হচ্ছে?

যদি ৫০০০ টাকাও ধরা হয় তাহলে একেকজন রোগীর খরচ পড়বে ১০ ডোজের জন্য ৫০,০০০ টাকা। নির্ধারিত এই ঔষধ কোম্পানি কাদের সহায়তায় এমন একটি বানিজ্য করছে সেই উত্তরটা কর্তৃপক্ষ থেকে আসা প্রয়োজন। আমরা হয়তো বলবো, এই ওষুধের ব্যবহার সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কেউ যেন এই ওষুধ সংগ্রহ না করেন, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবটা আমরা জানি। ঔষধ কোম্পানি কিভাবে তাদের ওষুধ প্রমোট করে, কিভাবে চিকিৎসকদের প্রভাবিত করে রোগীদের ওষুধ নিতে বাধ্য করে, সেই ফর্মূলা সবার জানা।

তাই আশংকা আছে অনেক। রেমডেসিভির শিরায় প্রয়োগ করতে হয়। রোগীর অবস্থাভেদে ১০-১৫টি ভায়ালের প্রয়োজন হতে পারে। এ ধরনের একটি ঔষধ উৎপাদন করা গেলেও সেটি বাংলাদেশের মতো একটি দেশে বহুলভাবে প্রয়োগ করার আগে অনেক দিক ভেবে দেখা দরকার। কাজেই শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে নয়, বরং যথাযথ এবং যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করেই এই ঔষধটির বাজারজাত করার অনুমোদন দেয়া উচিত।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর