Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্মৃতিতে ১৭ই মে: ঐক্য ও অস্তিত্বের প্রতীক শেখ হাসিনা


১৭ মে ২০২০ ১৯:৪২

উনিশশো পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ নিপতিত হয় গভীর অন্ধকারে। বিদেশে অবস্থান করায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বাবা-মা-ভাইসহ স্বজন হারানোর অসহনীয় বেদনা বুকে নিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বিদেশে নির্বাসনে কাটাতে হয় অর্ধযুগেরও বেশী সময়।

বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে চিরতরে ধ্বংস করা। সেই লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্যে দিয়ে সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগসহ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও গুম-খুনের নির্দয়তার মাত্রা প্রতিদিন বেড়ে চলছিল। সেই দুঃসময়ে প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গভীর রাতে ‘মুজিব হত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম’ শ্লোগান দিয়ে মিছিল করে প্রতিবাদ হতে থাকে। এই প্রতিবাদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল।

বিজ্ঞাপন

এভাবে, কয়েক বছরে সেই বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হলেও তা বারবার বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। কারণ সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার রক্তচক্ষু, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, প্রলোভন ও নষ্ট রাজনীতির পরিণতিতে আওয়ামী লীগে ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। মাতৃভূমির সেই ঘোরতর সংকটকালে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে মুক্তির নতুন বারতা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে তাঁর নেতৃত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট তৈরি হতে থাকে দলের ১৯৭৮ সালের সম্মেলন ও কাউন্সিল অধিবেশন থেকে, আর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তা অনিবার্য হয়ে পড়ে ১৯৮১ সালের সম্মেলনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে এই দুটি সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য; বিশেষত ১৯৮১ সালের সম্মেলন ও ১৭ মে’র স্মৃতির আলোকে সেই সময়ের কিছু কথা তুলে ধরতেই এই ক্ষুদ্র লেখাটির অবতারণা।

বিজ্ঞাপন

ঐক্যের সংকটে আওয়ামী লীগ

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ এবং ১৯৮০ সাল নাগাদ একদিকে নেতা-কর্মীদের ত্যাগ-তিতিক্ষায় গড়ে ওঠা আন্দোলনের গতি বেগবান হয়, অন্যদিকে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব বা উচ্চাভিলাষের কারণে দলীয় ঐক্যে সংকট শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় ৩-৫ মার্চ। সেই সম্মেলনে দেখেছি, সারা দেশে দল গোছানোর দায়িত্ব পালন করে দলের আহ্বায়ক ও সম্মেলনের সভাপতি বেগম জোহরা তাজউদ্দিন কিছুটা সামলে উঠলেও, শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সহধর্মিণী বেগম আমেনা মনসুর তখনও বেদনাভারে গভীরভাবে শোকার্ত, বিধ্বস্ত। তিনি কাতর কণ্ঠে দলের ঐক্য ধরে রাখার আকুল আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান বেঁচে থাকুক। সবার মধ্যে ঐক্য থাকুক, কোনো বিভেদ যেন না আসে।’

তবে নেতৃত্বের কোন্দল নিয়ে পত্রপত্রিকায় তখন আওয়ামী লীগ ভেঙে যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। কাউন্সিলে আবদুল মালেক উকিল ও সদ্য কারামুক্ত নেতা আবদুর রাজ্জাককে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ণাঙ্গ নতুন কমিটি নির্বাচন করা হয়। কিন্তু সম্মেলনের কয়েক মাসের মাথায় মিজানুর রহমান চৌধুরী তার অনুসারীদের নিয়ে পাল্টা কমিটি গঠন করেন এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। অর্থাৎ ঐক্যের সংকট প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করে।

শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি

এভাবে ভিতরে ভিতরে কোন্দল-কলহে দলের ঐক্য টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মূলত সভাপতি পদ নিয়ে দলে অনৈক্য চরমে পৌঁছে। এহেন পরিস্থিতিতে সামনে আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১৯৮১ সালের সম্মেলন। বরাবরের মতো হোটেল ইডেনে ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ই ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ অফিস ৯১ নবাবপুর থেকে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এসেছে। তখন প্রায় নিয়মিত অফিসে যাই আমি। কোনো কোনো দিন দফতর সম্পাদক অগ্রজতুল্য সৈয়দ আহমদের ডিক্টেশনে আওয়ামী লীগের প্রেস রিলিজ লিখেছি। টাইপিস্ট না এলে মূল কপির নিচে কার্বন দিয়ে লিখতে হয়েছে। ৯১ নবাবপুরের অফিস থেকে সৈয়দ ভাই সেই কার্বনকপি স্বাক্ষর করে দুঃসময়ের অফিস সহায়ক রফিককে দিয়ে পত্রিকায় পাঠিয়ে দিতেন। আমার হস্তাক্ষর পত্রিকায় মূদ্রিত দেখে খুব ভালো লাগতো।

দল তখন চরম আর্থিক সংকটে। নেতাদের বলাবলি করতে শুনেছি, সম্মেলনের সময় বঙ্গবন্ধু নেতাকর্মীদের কখনো না খাইয়ে ছাড়তেন না। তাই ঐতিহ্য মেনে চলতে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয় সম্মেলনস্থলেই। দুপুরের পরে সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনের সময় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হোটেল ইডেন আর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আমাদের যাওয়া-আসা চলে। নেতা নির্বাচন করা নিয়ে দফায় দফায় কখনো আওয়ামী লীগ অফিসে, আবার কখনো নেতাদের বাসায় বাসায় মিটিং হচ্ছে। নেতারা আসছেন। মিটিং করছেন। বের হওয়ার সময় আমরা উন্মুখ হয়ে ঘিরে ধরছি। সকল নেতাই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। অফিসে বসার জায়গা নেই। এভাবে ১৬ই ফেব্রুয়ারি সারাদিন, সন্ধ্যা কেটে যায়।

অফিসের সামনের রাস্তায় বসে মুহূর্তে মুহূর্তে নানান গুজব শুনি, নেতারা একমত হতে পারছেন না। দল ভাগ হয়ে যাচ্ছে। নেতাদের ওপরে মনে মনে ক্ষুব্ধ হই। ভিতরে ভিতরে বিষণ্ণতা বোধ করি। হতাশ হয়ে পড়ি। হঠাৎ খবর ছড়িয়ে পড়ে, দিল্লিতে টেলিফোনে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা হচ্ছে, শীঘ্রই একটা সমাধান হবে। আবার কিছুক্ষণ পর শোনা যায়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সভাপতি করার প্রস্তাব করা হয়েছে, কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। মনে সংশয় নিয়েও শেখ হাসিনার নাম সবার ভিতরে মুহূর্তেই নতুন আশার সঞ্চার করলো। অনেককে হাত তুলে আল্লাহ আল্লাহ করতে দেখেছি, যাতে শেখ হাসিনা রাজি হন, যাতে দল ভেঙে না যায়। কর্মীদের মধ্যে ঐক্যের কী সেই আকুতি! এখানে, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্বৃত করা অত্যাবশক যে, ‘… নেতা নেওয়া যায়, কর্মী নেওয়া যায় না, তাদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক’। আজ শেখ হাসিনার বেলায়ও হুবহু তাই দেখলাম।

মাটিতে পত্রিকা বিছিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বসেই আছি। রাত তখন গভীর। হঠাৎ সবাই নড়েচড়ে উঠলো, শেখ হাসিনা সভাপতি হতে রাজি হয়েছেন! আবদুর রাজ্জাক সেক্রেটারি। সে কী উল্লাস, সে কী উত্তেজনা, সে কী আনন্দের বন্যা! জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে মুখরিত ও উদ্বেলিত হয়ে ওঠলো পুরো বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। নেতারা হোটেল ইডেনে চলে গেলেন কাউন্সিলরদের কাছে। আমরা খুশিতে, ‘শেখ হাসিনা এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে/মুজিব হত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম/জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিতে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফিরে আসি।

স্মৃতির পাতায় ১৭ই মে

জার্মানি থেকে ব্রাসেলস হয়ে শেখ হাসিনা তখন দিল্লিতে দুঃসহ নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ সকল নেতাকর্মীর ভিতরে গভীরে উৎকণ্ঠা- কবে আসবেন সভাপতি শেখ হাসিনা? তিন মাস যেতে না যেতেই সারাদেশ আবার আনন্দে উথলে উঠলো, ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে প্রতিরাতে মিছিল চলছে। পোস্টার লাগানো হচ্ছে। সারা দেশ থেকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা ঢাকায় আসছেন। বিভিন্ন জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হলে হলে মিছিলে যোগ দিচ্ছেন। কলাভবনে, কার্জন হলে প্রতিদিন মিছিল হচ্ছে। অবশেষে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে’র এক নতুন ভোরের আলো দেখলো বাংলাদেশ!

দুপুরে আসবেন শেখ হাসিনা। সকাল দশটার মধ্যে সব হল থেকে মিছিলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্ররা  জমায়েত হলো। জহুরুল হক হলের ছাত্র সংসদের ভিপি খলিলুর রহমান মোহনের নেতৃত্বে আমরা বটতলায় পৌঁছলাম। তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ওবায়দুল কাদের (আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক) ও সাধারণ সম্পাদক বাহালুল মজনুন চুন্নুর নেতৃত্বে ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ শ্লোগান দিতে দিতে আমরা বাসে করে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে (বর্তমান হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) রওয়ানা হলাম। সারাপথ মানুষের শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত। দুপুরের আগেই চারদিক থেকে বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েছে। বেলা তিনটার দিকে শেখ হাসিনার বিমান বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করলো। বিমান মাটিতে নামার আগেই আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা ব্যুহ ভেঙে জনতা ছুটে গেল বিমানের রানওয়েতে। বিমানবন্দরের ভিতর থেকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে বহনকারী মঞ্চসজ্জিত ট্রাক রাজপথে এলো সাড়ে তিনটার দিকে। সামনে পেছনে আনন্দে উদ্বেলিত লক্ষ জনতা। স্বজন হারানোর শোকে ও বেদনায় মুহ্যমান বঙ্গবন্ধুকন্যা সামান্য হাত নেড়ে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আনন্দ-বেদনায় কান্নার রোল পড়ে গেল বিশাল জনসমুদ্রে। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না আর কান্না! এ যেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কর্মীদের সেই রক্তের সম্পর্কের চিরন্তন ধারাবাহিকতা! সেই রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়তায় সবাই চোখের জলে বরণ করলো জাতির পিতার আদরের কন্যা শেখ হাসিনাকে। অঝোর ধারায় কান্নায় ভেঙে পড়লো বাংলার আকাশও। অশ্রুতে বৃষ্টিতে একাকার হয়ে গেল আকাশ বাতাস মাটি।

বর্ষণমুখর বিকেলে এগিয়ে চললো বাংলার মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধুর ১০ই জানুয়ারির মতোন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বাঁধভাঙা জনস্রোত। যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা পায়ে পায়ে পথ চলার এতোটুকু জায়গা নেই কোথাও! মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজে, ঝড়-বাদলে হেঁটে হেঁটে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে আমরা মানিক মিয়া এভিনিউতে এলাম বঙ্গবন্ধুকন্যার ভাষণ শুনতে। শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্যে অনেকে সেদিন বিমানবন্দরে না গিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউতে সমবেত হয়েছিলেন। তিল ধারণের জায়গা ছিল না। বৃষ্টি আর অশ্রুভেজা মানুষের ঢল, মানুষের মহাসমুদ্র। কোনো কুল কিনারা নেই যেন এই এভিনিউর। আমরা মানিক মিয়া এভিনিউর ফার্মগেটের দিকের মাথায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শেখ হাসিনার কান্নাভেজা মৃদু কণ্ঠের ছোঁয়া পেলাম মাত্র, কিন্তু কথা বুঝতে হলো পরের দিনের পত্রিকা পড়ে।

মানিক মিয়া এভিনিউতে সেদিনের ভাষণে শেখ হাসিনা বলেছিলেন: ‘বাংলার জনগণের পাশে থাকার জন্য আমি এসেছি, মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য আমি এসেছি; আমি আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আমি আপনাদের বোন হিসেবে, কন্যা হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। …বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবন দান করতে চাই। পিতা-মাতা, ছোট ভাই রাসেলসহ সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাঁদের ফিরে পেতে চাই। …আমি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’

আজ ভুলে গেলে চলবে না যে, জননেত্রী শেখ হাসিনার চলার পথ কখনো মসৃণ হয় ছিল না, আজও নয়। দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনাকে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয় নি। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে দেয়া হয় নি। রাস্তায় বসে বাবা-মা-ভাইদের জন্যে দোয়া ও মিলাদ পড়তে হয়েছে। মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সারা বিশ্বে যারা রাজনীতি করছেন, তাদের মধ্যে হাতে গোনা একজন রাষ্ট্রনায়ক হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ষড়যন্ত্রকারীরা ক্রমাগত তাকে হত্যার অপচেষ্টা করে চলেছে। ১৯৯৮ সালে কোটালীপাড়ায় ছিয়াত্তর কেজি ওজনের বোমা পেতে রেখে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট রক্ত আর বারুদের অগ্নিকুন্ড থেকে সৃষ্টিকর্তা তাঁকে নিজ হাতে তুলে এনেছেন। ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা ১/১১ এর ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের গণমানুষের নেত্রী শেখ হাসিনাকে অসংখ্য মিথ্যা মামলায় কারাগারে নিক্ষেপ করেও তাঁর আলোর পথের যাত্রা স্তব্ধ করতে পারেনি। বাংলার মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিন মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এগিয়ে চলেছেন অকুতভয়ে, দৃঢ়চিত্তে।

জননেত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা এখন জনগণমননন্দিত নেত্রী ও বিশ্বস্বীকৃত সফল রাষ্ট্রনায়ক। শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে উন্নয়নের অনুকরণীয় মডেল। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জনশক্তি রপ্তানী, ব্যাংকিং, প্রশাসন থেকে শুরু সকল সেবা বিস্তৃত ও সহজলভ্য করে জনগণের দোর গোড়ায় পৌঁছে দিয়ে তিনি এক অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধন করেছেন। প্রায় দেড় হাজার মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলেছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল জুড়ে আমাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিচারহীনতার কলঙ্ক ঘুচিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। তাঁর অসম সাহসী ভুমিকার ফলেই একাত্তরের নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে ও বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অনমনীয় ও দৃঢ় অবস্থানের ফলে অন্যান্য পরাশক্তিসহ সম্প্রতি বৃটিশ সরকারকে মাঠপর্যায়ে জঙ্গীবাদ দমনে অধিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে একজন প্রকৃত বিশ্বনেতার ভূমিকাই স্পষ্ট করেছেন শেখ হাসিনা।

গণতন্ত্র, শিক্ষা, শান্তি ও দারিদ্র্য হ্রাসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি স্বরূপ জাতিসংঘ, ইউনেস্কো, এফএওসহ বিভিন্ন বিশ্বসংস্থা কর্তৃক অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। বিশ্বের ছয়টি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। জলবায়ূ পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা এবং পরিবেশ উন্নয়নে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্যা আর্থ’ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে।

২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় দফা ভিত্তিক একটি বহুমাত্রিক শান্তির মডেল জাতিসংঘে উপস্থাপন করেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র দূরীকরণ, বৈষম্য হ্রাস, বঞ্চনা প্রশমন, বাদপড়া মানুষের অন্তর্ভূক্তি, মানব উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ ও সন্ত্রাস নির্মূলের মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই মডেলটি আজকের অস্থির ও বিপদসংকুল বিশ্বে এক তাৎপর্যপূর্ণ দলিল হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তাই নিজের কবিতায় বলি-

মুজিব অভয়পুষ্ট তোমার প্রশান্ত
আঁচলের ছায়া প্রতিদিন দীর্ঘতর হয়ে
সমতল ভূমি আর লামার পাহাড় ছুঁয়ে
সস্নেহে ছড়িয়ে পড়ে জাপানের ফুকুশিমা থেকে
সোমালিয়া-সুদানের খরাপীড়িত শিশুর মুখে।

জাতিসংঘে, অগণিত বিশ্বসভায়
তোমার সাহস আর শৌর্যের প্রভায়
সাম্য মুক্তি শান্তির আকাক্ষায়
এশিয়া আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকায়
সংগ্রামরত মানুষেরা জেগে ওঠে।

১৯৮১ সালের ১৭ই মে জাতির পিতার রক্তেভেজা মাটিতে পা রেখে, মেঘলা আকাশের ছায়ায়, অশ্রুভরা ভালোবাসার সাগরে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা সেদিন যে অঙ্গীকার করেছিলেন, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম আর দীর্ঘ তিন দশক ধরে প্রজ্ঞাময় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলার মানুষকে, আমাদেরকে, বাংলাদেশকে নিরলস নিষ্ঠায় সেই পথেই এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা চেতনায় আমাদের ঐক্য, সাহস ও বর্তমান বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক শেখ হাসিনা। জয় হোক শেখ হাসিনার।

লেখক: প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর