Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনার সঙ্গে যুদ্ধে টেলিভিশন নাটক


১৮ মে ২০২০ ১৬:২৮

‘তুই রাজাকার’। কালজয়ী এই সংলাপটি আমরা আবার শুনতে পেলাম বাংলাদেশ টেলিভিশনের বদৌলতে। বন্দীজীবনে আমাদের বিনোদিত করার তাগিদে বিটিভি আর্কাইভ থেকে জনপ্রিয় নাটকগুলো প্রচার করছে। কেন? যাতে দর্শক বিনোদিত হয়। বন্দী সময়টা যেন তারা সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারেন। এমনিতেই করোনাভাইরাসের কারণে বিনোদনের সকল মাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। সেই জায়গায় বিটিভির এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন এই নির্দিষ্ট নাটক এই সময়ে আবার প্রচার করা হচ্ছে? বিনোদন মাধ্যমে টেলিভিশন নাটকের ভূমিকা বেশ জোরালো। এই টেলিভিশন নাটক দেখেই দর্শকরা রাস্তায় নেমেছিল। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বাতিলের দাবীতে। যা এখনো পর্যন্ত ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সাক্ষী আমরা সবাই। বা যখন ‘রাজাকার’ শব্দটি বলা বারণ ছিল তখন টেলিভিশন নাটকেই প্রথম ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি শোনা যায় টিয়া পাখির মুখে। টেলিভিশন নাটক সেই অসাধ্যকে সাধন করেছিল। বা ‘ছি: ছি: ছি: তুমি এতো খারাপ’ এই রকম জনপ্রিয় সংলাপ এসেছে টেলিভিশন নাটক থেকে। একজন খারাপ মানুষের মন্দ দিকটা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এই সংলাপের মধ্যদিয়ে। এইরকম অসংখ্য গল্প বা ইতিহাস রয়েছে টেলিভিশন নাটকে।

টেলিভিশন নাটকের আলাদা সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই দীর্ঘ ইতিহাসের মধ্যদিয়ে একদিকে যেমন দর্শক বিনোদন পেয়েছেন অন্যদিকে সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রেখেছে টেলিভিশন নাটক। মূলত এইসকল প্রশংসার দাবীদার আসলে নাট্যকাররা। যাদের রচনায় এইসব চরিত্র বা সংলাপ বা কাহিনী উঠে এসেছে। অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক, কলাকুশলীদের অবদান অবশ্যই আছে। কিন্তু মূল রাজমুকুট আসে নাট্যকারের মাথায়। তার লেখা গল্প, সংলাপ, চরিত্র জলজ্যান্ত হয়ে উঠছে পর্দায়।

যে মানুষগুলো দর্শকদের বিনোদন দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে, সেই মানুষগুলো আসলে কেমন আছেন এই পরিস্থিতিতে? বা যে ঈদকে কেন্দ্র করে শত শত নাটক নির্মিত হতো সেই মাধ্যমের সকল কলাকুশলী কেমন আছেন এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে? আমরা কি তাদের কথা ভেবেছি? হয়তো ভেবেছি, হয়তো ভাবিনি। হয়তো কখনো ভাববো না। কারণ দর্শক হিসেবে আমাদের বিনোদন প্রয়োজন। কারা কিভাবে কাজ করছেন, কাজের পিছনে কি গল্প জড়িত তা আসলে দর্শকরা কখনো দেখেন না। কিন্তু আমার বিবেচনায় তা দেখার এবং জানার সময়ও এসেছে। যে দর্শক প্রতিনিয়ত টেলিভিশন নাটক দেখে বিনোদন পাচ্ছেন, সেই দর্শক নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক সহ সকল কলাকুশলীর গল্পটাও জানতে পারেন চাইলে। আদৌ কি দর্শক সেই গল্প শুনতে চান? প্রশ্নটা আমাদের কাছে।

খ্যাতিমান সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্প্রতি তার বন্দীজীবন নিয়ে একটি লেখা প্রকাশ করেন। তাতে তিনি লিখেছেন, …করোনার বন্দিশালায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি হয়ে ল্যাপটপ- কোলে ঢাকার নাটক, টেলিফিল্ম দেখে দেখে মনে হয়েছে অভিনয়ের বিশ্বমানের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারেন নতুন প্রজন্মের এমন অভিনয়শিল্পীদের দেখা পেয়েছি।

শুধু সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী নন, প্রবাসী বাংলাদেশির অন্যতম বিনোদনের খোরাক এই বাংলাদেশে টেলিভিশন নাটক! বিশ্বাস হচ্ছে না? অবিশ্বাস্য মনে হলেও কথাটা সত্যি। আমি ব্যক্তিগত দুটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি তখন বেসকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করছি। তাদের অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান বেশ জনপ্রিয়। সেই অনুষ্ঠানে শেষে একটি মুঠোফোন নম্বর দেয়া হয়। সেই নম্বরে পঁচানব্বই শতাংশ ফোন কল আসে প্রবাস থেকে। কারা ফোন করেন? প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারা দেশের প্রতিটি অনুষ্ঠান দেখেন এবং দেখার চেষ্টা করেন।

আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক কারা দেখেন এই নিয়ে একটি জরিপ করা হয়। সেই কাজে আমিও সক্রিয় ভূমিকা নেই। আমরা অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করি টেলিভিশন নাটক যখন মুক্তমাধ্যমে অর্থাৎ ইউটিউবে দেয়া হয় তখন এই নাটকের আশি শতাংশ দর্শক হলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ও বৈদেশিক জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার ২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ।

এরমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৫০ লাখ প্রবাসী কাজ করেন। ২০১৯ সালে বিদেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। এই বিশাল অংকের শ্রমিকরা বাংলাদেশের অর্থনীতি চালিত করেন। আমরা কি তাদের জন্য আলাদা কোনো বিনোদনের কথা ভেবেছি? না। তবে তাদের বিনোদনের মাধ্যম কি? তাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হলো বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক। যা তারা ইউটিউবে বসে বসে দেখেন। সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রমের পর তারা এই টেলিভিশন নাটক দেখেই দেশের কথা মনে করেন। নিজেদের কষ্ট ভুলে যান।

মানুষ এখন গৃহবন্দী। ইচ্ছেকৃত নয়, অনিচ্ছাকৃত। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না কারণ করোনা পরিস্থিতি আমাদের স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নিয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে মানুষ যতটুকু বিনোদন উপভোগ করতো এখন সেই অবস্থা এবং পরিস্থিতি নেই। এই বন্দী জীবনে মানুষ কি করছে? টেলিভিশন বা মুঠোফোনে বিনোদন খুঁজে নিচ্ছে। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ করার পর যে বিষয়টি প্রথমে আসে তা হলো বিনোদন। তাই সমাজবিজ্ঞানীরা বিনোদনকে মৌলিক চাহিদার ছয় নম্বর উপাদান হিসেবে ধরেন।

মানুষকে বিনোদিত করা খুব কি সহজ কোনো কাজ? নিঃসন্দেহে নয়। এই কঠিন কাজটি সবাই নিরলসভাবে করে যাচ্ছে এই মাধ্যমকে ভালোবেসে। ধরুন, পোশাক শ্রমিক। তাদের বিশাল অবদানের কথা আমরা জানি। বা নির্মাণ শ্রমিকদের অবদানের কথাও আমরা জানি। বা ধরুন, পুলিশ, চিকিৎসক, সাংবাদিক সবার অবদানের কথাও আমরা জানি। টেলিভিশন নাটকে কাজ করা অসংখ্য মানুষের কথা আমরা কি জানি? না। এদের বিষয়টাও এখন জানা উচিত।

প্রতি ঈদে দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেল এবং ইউটিউবে প্রায় চারশ নাটক নির্মিত হয়। এই চারশ নাটক নির্মাণ ব্যয়, কলাকুশলী সম্মানী, টেলিভিশনের রাজস্ব আয়, বিজ্ঞাপন সব মিলিয়ে প্রায় কয়েকশো কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এই সকল ব্যবসা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। প্রশ্ন আসে, তাহলে এই মাধ্যম থেকে যাদের রুটিরুজি জোটে তাদের কি হবে? বা তারা কিভাবে চলবে? করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সরকারি সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কিন্তু সঠিকভাবে হচ্ছে বা অনেক বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও হচ্ছে। টেলিভিশন নাটক বা বিনোদন মাধ্যমে কাজ করা সৃজনশীল মানুষগুলো তো কারো বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, তাহলে তাদের কিভাবে চলছে? তাদের আসলেই চলছে না। তারা বেঁচে আছে এখনো মনের জোরে।

সম্প্রতি প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশন, ডিরেক্টরস গিল্ডস, অভিনয় শিল্পীসংঘ ও নাট্যকার সংঘ এই মাধ্যমে জড়িত সবাইকে অর্থনৈতিক এবং মানসিকভাবে বাঁচানোর জন্য মনোবল দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাও সীমিত তাই চাইলেও বেশি কিছু করা সম্ভব হয়ে উঠছে। তাহলে উপায়? উপায় হলো সরকারি প্রণোদনা। শব্দটা অনেকের কাছে আপত্তিকর মনে হলেও এখন আসলে এই মাধ্যমে কাজ করা সবাইকে প্রাথমিকভাবে বেঁচে থাকতে হবে। সেই প্রক্রিয়াটি যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।

সংস্কৃতির ক্রমবিকাশে টেলিভিশন নাটক আগে যেমন ভূমিকা রেখেছে এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে। সেই ধারা ভবিষ্যতে থাকবে কি না তা এখনই বলা মুশকিল। প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশন, ডিরেক্টরস গিল্ডস, অভিনয় শিল্পীসংঘ ও নাট্যকার সংঘের পাশাপাশি বর্তমানে ১৫টি সংগঠন সক্রিয়। আমরা ইতোমধ্যে অনেক সদস্যের অভাব-অনটনের কথা শুনতে পারছি। এই অভাব অনটনেও তারা কষ্ট করে কোনোভাবে চলছেন। এই চেষ্টা কতদিন তারা অব্যাহত রাখতে পারবেন তা বলা মুশকিল। এখন
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা পারে তাদের বাঁচাতে। এই শিল্পীরা বাঁচলেই বাঁচবে শিল্প, বাঁচবে টেলিভিশন নাটক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর