Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ঈদ’ নাকি ‘ইদ’ কোনটি সঠিক?


২৫ মে ২০২০ ০০:১১

রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ‘ঈদ’ জাতীয় কবির গানে রমজানের রোজার শেষে ‘ঈদ’ এলেও বাংলা একাডেমির নতুন বানানে এসেছে ‘ইদ’! বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের বাংলাভাষী মুসলিম বাঙালির বহু বছরের ঐতিহ্যের ধারক ‘ঈদ’ বানান কেন ‘ইদ’ হবে, সে বিতর্ক নিয়ে বিগত বছরগুলোতে বহু আলোচনা হলেও সমাধান হিসেবে একটি বানান স্থিরতা পায়নি । প্রতিবছর ঈদ এলেই যেন আবার ‘ইদ’-এর পক্ষ দল ও বিপক্ষ দল কিংবা ‘ঈদ’-এর পক্ষ ও বিপক্ষ দলের যুক্তির লড়াইয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়ে যায় বানান বিতর্ক যুদ্ধ! তাহলে মুসলিমদের একটি ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছাবাক্য আরবি ‘عيد مبارك‎‎’ ও বাংলা ‘ঈদ মোবারক’- এর ‘ঈদ’ এর বানান কোনটি সঠিক হবে?

বিজ্ঞাপন

‘ইদ’ বনাম ‘ঈদ’-এর বানান বিতর্ক যুদ্ধে পক্ষ ও বিপক্ষ দলের যুক্তিগুলো খণ্ডন করে আসা যাক। ঈদ শব্দের বানান নিয়ে নতুন এক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে যখন বাংলা একাডেমির বানান অভিধানে আগের প্রচলিত ‘ঈদ’ বানান থাকা সত্ত্বেও নতুন সংযোজন করা হল ‘ইদ’! খেয়াল করুন ‘সংযোজন’ শব্দটি! এটি নিয়ে পরে আবার আলোচনায় ফিরব। তার আগে ‘ইদ’ নিয়ে যুক্তিগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ভাষা বিশারদ থেকে শুরু করে জন্মের পর মায়ের থেকে অর্জিত উপহার হিসেবে যিনি বাংলাভাষী তাদের যুক্তি বাংলা একাডেমি প্রচলিত ‘ঈদ’–এর বদলে ‘ইদ’ বানানকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এতদিনের চল ‘ঈদ’ বানান থাকার পরও নতুন করে অভিধানে ‘ইদ’ বানানের সংযোজন মূলত তারই ইঙ্গিত করে!

বিজ্ঞাপন

এদিকে বাংলা একাডমির নিয়ম নিয়ে যে ব্যাখ্যাটি দেয়া হয় তা হলো ‘ঈদ’ লেখা যাবে না, লিখতে হবে ‘ইদ’এরকম কোনো আদেশ বাংলা একাডেমি জারি করেনি। বাংলা একাডেমির অভিধানে দুই বানানই আছে সেই ১৯৯৪ সাল থেকে। লক্ষ্য করুন, বাংলা একাডেমি বাংলা বানান অভিধানে ‘ইদ’ বানানকে সংযোজন করেছে কেবল, ‘ঈদ’ বানানের সংস্কার কিংবা বিয়োজন করেনি! তার মানে দাঁড়াচ্ছে বাংলাভাষী মুসলিমরা দীর্ঘ এক মাস রমজানের পর যে উৎসব পালন করে, তার নাম ‘ঈদ’ বা ‘ইদ’! অর্থাৎ ‘ইদ’ হলো ‘ঈদ’-এর বিকল্প বানান!

প্রসঙ্গত প্রশ্ন এসে যায়, যদি বাংলা একাডেমি ‘ঈদ’-কে ভুল বলে নাকচ করে না দেয়, তাহলে ‘ইদ’ বানানের সংযোজনের কী প্রয়োজন পড়লো? ‘ঈদ’ বানানের বিকল্প বানানের প্রস্তাবই কেন গৃহীত হলো, যেখানে একটি শব্দের দুই রকম বানান কোনো ভাষাভাষীর মনে বানান নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে শব্দের বুৎপত্তির ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে।

ঈদ বাংলা* শব্দ নয়। বাংলার পাশে তারকা চিহ্নের ব্যাখ্যা দেবো এ লেখার শেষে গিয়ে। আপাতত ‘ঈদ’ শব্দের উৎস ভাষা নিয়ে ভাবা যাক। ‘ঈদ’ একটি আরবি শব্দ। আরবি শব্দ হিসেবে বানানরীতির দিক থেকে ‘ঈদ’ বানানটি হবে দীর্ঘ ‘ঈ’ দিয়ে। আরবী বানানের উচ্চারণে দীর্ঘ টান ও ছোট টানের প্রয়োগ আছে। এমনকি আরবি ব্যাকরণে একই শব্দ দীর্ঘ টানে উচ্চারণ করলে এক অর্থ দাঁড়ায়, আর ছোট টানে উচ্চারণ করলে সম্পূর্ণ নতুন অর্থের অন্য কিছু বোঝায়। তাহলে আরবি এই দীর্ঘ ‘ঈ’ দিয়ে ঈদের উচ্চারণ নিয়ে বাংলা ভাষার বানান ব্যাকরণ কী বলে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়াও জরুরি হয়ে পড়ে!

বাংলা ভাষার ব্যাকরণে আরবির মত দীর্ঘ টানে (‘ঈ’) উচ্চারণ নেই। এখানে সব শব্দই ছোট টানের (‘ই’)। তাই শব্দটি বাংলা ভাষার উচ্চারণে সঠিক হয় ‘ইদ’। আমরা উচ্চারণও তাই করি। আর এই কারণেই আমাদের ব্যাকরণে বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে সংস্কৃতের নিয়ম না মেনে দীর্ঘ স্বর ব্যবহার হয় না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের বাংলা ভাষা পরিকল্পনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির কাঁধে বানান শুদ্ধিকরণের দায়টি এসে বর্তায়। যদিও তারা বলছে ‘ইদ’ আসলে ‘ঈদ’-এর বিকল্প একটি বানান। দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যগতভাবে এমন অনেক বানান রয়েছে যেখানে মানুষ দীর্ঘ ‘ই’ কার বা ‘উ’ কার ব্যবহার করে আসছে। তবে এতে কোনো আপত্তি বা সমস্যা নেই। শব্দগুলোর বিকল্প বানান ও একইসঙ্গে প্রচলিত বানানও থাকবে। কিন্তু অভিধানে নতুন বানান সংযোজনের ব্যাখ্যা দেওয়াটা সাদামাটা আর সরল হলেও ভাষা ব্যবহারকারীদের কাছে তার প্রভাব কিছুটা জটিল বটে! কারণ মন আর চোখ সায় দেয় ‘ঈদ’ বানানে, কিন্তু মস্তিষ্ক বলে ‘ইদ’ সঠিক। অবশ্য তা ভাষাবিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক বলে!

সহজ সরল বাংলাভাষী ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে তা পুরো বিপরীত। কারণ বহু বছরের ‘ঈদ’ কেবল শব্দে সীমাবদ্ধ নেই, এটি আবেগ এবং ধর্মীয় আচার! তাহলে ‘ঈদ’ শব্দের বানান দীর্ঘ ঈ-কার ও হ্রস্ব ই-কারের মধ্যে কোনটি গ্রহণযোগ্য, ইতিহাস না বানানবিধি— কোনটির গুরুত্ব বেশি?

ঈদকে দীর্ঘ ‘ঈ’ দিয়ে আবহমানকাল থেকেই লেখা হচ্ছে। যদিও এ নিয়ে বাংলা ভাষাবিজ্ঞানীরাও একমত হতে পারেননি। এক পক্ষ ব্যালট দিচ্ছেন ‘ঈদ’ বানানকে। তাদের মতে, ‘ঈদ’ বানানে কোনো সমস্যা নেই। বরং প্রচলিত ঈদের ‘ঈ’-কে ‘ই’ করার কোনো মানে হয় না। তাই চিরকালের ঈদের বানান যেমন ছিল, তেমনটাই রাখা উচিত।

কিন্তু আরেক পক্ষের যুক্তি হলো বাংলা বানানের বর্তমান রীতি ও প্রবণতা অনুযায়ী ‘ঈদ’ না লিখে ‘ইদ’ লেখা উচিত। ‘ঈদ’ লেখা যেতে পারে কেবল প্রচলনের অনুরোধে। কোনো যুক্তিতে নয়। যারা এরকম যুক্তি তালাশ করেন, তারা সাধারণত মূল উচ্চারণের দীর্ঘস্বরের যুক্তি দেখান। এই ‘যুক্তি’তেই একসময় ‘ঈদ’ বানানটি প্রচলিত হয়েছিল। কিন্তু বাংলায় কোনো নিয়মিত দীর্ঘস্বর না থাকায় ‘ঈদ’ বা ‘ইদ’ যা-ই লিখি না কেন, আমরা ‘ইদ’-ই উচ্চারণ করে থাকি।

কিন্তু বহু দশক ধরে, বিশেষত আমাদের ছাপা হরফের ব্যাপক প্রচলনের সময়জুড়ে আমরা ‘ঈদ’-ই লিখে আসছি। তার কার হলো উনিশ-বিশ শতকে যারা সংস্কৃতের অনুসরণে বাংলা বানানরীতি নির্ধারণ করেছিলেন, তারা এমন বহু শব্দেও ‘ঈ’ লিখছিলেন, যেগুলো তৎসম শব্দ নয়। ফলে বিশৃঙ্খলা বাড়ছিল। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরোক্ষ নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান কমিটি এ ব্যাপারে একটি ফয়সালা করেছিল। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে সমস্যা আমরা আজও বহন করে চলেছি।

তাবে, এই পাল্টাপাল্টি যুক্তির বাইরেও ‘ঈদ’ বনাম ‘ইদ’ নিয়ে কিছু আলোচনার অবকাশ রয়েছে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে! যেমন আমরা বিশ্বায়নের ভাষা ইংরেজি ভাষার সাথে বানান তুলনা করতে পারি। বাংলা এবং ইংরেজি উভয়ের জন্য আরবি ‘ঈদ’ একটি বিদেশি শব্দ। ইংরেজিতে ‘ঈদ’ শব্দটি লেখা হয় ‘Eid’। এখানে ‘E’-এর পর ওই ‘I’-টা লেখা হয় দীর্ঘ ‘ঈ’ স্বর বোঝানোর জন্যই। আর ইংরেজিতে দীর্ঘ স্বর হিসেবেই উচ্চারণ করা হচ্ছে, যেটি বাংলা ভাষায় দীর্ঘস্বর বর্ণমালায় থাকলেও উচ্চারণে নেই! কেন তবে বর্ণমালায় এমন বর্ণ রাখা হলো যেখানে প্রকৃতপক্ষে সে দীর্ঘ উচ্চারণ বাংলায় নেই? এটিকে বলে ধ্বনি ও বর্ণের প্রতিবর্ণীকরণের সমস্যা। সে আলোচনা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।

এবার ভাষাবিজ্ঞানের ধ্বনিতত্ত্বের আলোচনা থেকে সরে এসে একটু রূপতত্ত্বের আলোকে ভাবা যাক। ব্যাকরণের বাক্যাংশের (Parts of speech) দিক থেকে ঈদ একটি বিশেষ্য পদ। কারণ, বাংলাভাষী মুসলিমরা দীর্ঘ এক মাস রমজানের পর যে উৎসব পালন করে তার নাম ‘ঈদ’ বা ‘ইদ’। অর্থাৎ ভাষিক সম্প্রদায়ের কাছে সময়ের ধারাবাহিকতায় ‘ঈদ’ হল এক উৎসবের নাম। আমরা যদি কারও নাম বদলাই, তা ভুল। এতে তার প্রতি অসম্মান প্রকাশ করা হয়। যেভাবে হুট করেই কোনো ব্যক্তির নাম বদল করা যায় না, তেমনি একটি দেশের ৯৭ ভাগ মুসলিম ধর্মপ্রাণ মানুষের একটি বড় উৎসবের নামের বদল করাও ঠিক নয়। আর কোনো ভাষাতেই নাম ও ট্রেডমার্ক ইচ্ছামতো বদলানো বা মতাচ্ছন্নতা সমর্থন করা হয় না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বর্ণমালার আর ভাষিক বৈচিত্র্যে বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম একটি সমৃদ্ধ ভাষা। তথাপি কোনো ভাষা পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাকে পাশ কাটিয়ে এককভাবে চলতে পারে না। সে অন্যান্য ভাষা থেকে প্রতিনিয়ত পরিভাষা গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করে চলে। কোনো ঋণ করা শব্দই হুবহু ভাষায় আসে না, ঋণী ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব মেনেই তা গৃহীত হয়। ফলে বাংলা ভাষায় ‘ঈদ’ সংস্কারপন্থীদের দুর্বল সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় প্রস্তুত অনুকরণ বলে অনেকেই যুক্তি দিয়ে থাকেন। যদিও আমি নবীন ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে এটির সঙ্গে একমত নই। কারণ, ভাষার থিওরিগত বা প্রথাগত ভাষাবিজ্ঞানের বাইরে ভাষা ব্যবহারের একটি প্রায়োগিক অর্থ রয়েছে। ভারি ভারি নিয়ম আর তত্ত্বের আলোচনা করতে গিয়ে আমরা বেশিরভাগ সময়েই সেটি ভুলে যাই।

সেদিক থেকে দেখলে ভাষার নদীর বৈঠা বায় যে মাঝি, তাদের দলে আমি। মাঝিরূপী ভাষার ভাষিক সম্প্রদায় যে ভাষার মনের ভাব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তাই সঠিক হওয়া উচিত বলে আমার বিশ্বাস। একে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের বাঁধনে বেঁধে নদীর গতিপথ কৃত্রিমভাবে বদলে দিতে চাইলে নদী একদিন স্থবির হয়ে যাবে। তারপর একদিন কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে। অতীতে একই কারণে হারিয়ে গেছে সংস্কৃতের মতো বহু ভাষা। বহু বছর ধরে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম বাঙালি সম্প্রদায়ের কাছে তাই আজ ‘ঈদ’ কোনো আরবি* শব্দ নয়, বরং ধর্মীয় আবেগের প্রিয়জনের স্মৃতিতে মোড়া বাংলা শব্দ।

লেখার শুরু করেছিলাম- ‘ইদ’ বনাম ‘ঈদ’-এর বানান বিতর্ক যুদ্ধের বিষয় দিয়ে। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে কিছু কিছু বিতর্কের জয়-পরাজয় পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিখণ্ডনে নিশ্চিত হওয়ার দরকার হয় না। শেষ পর্যন্ত ‘ঈদ’ বানান টিকে যাবে নাকি ‘ইদ’ হবে? তা বাংলা ভাষা নদীর মাঝিরাই ঠিক করুক!

সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

লেখক: চেয়ারপারসন, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইদ ঈদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর