Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যাদের ঈদ আসেনি


২৫ মে ২০২০ ১৮:৩৩

১.
ঈদ সবসময়ই আনন্দের। এবার এই আনন্দ সবার মধ্যে দেখা যাবে এইটা বলা যাচ্ছে না। এর কারণ অজানা নয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান সবারই অর্থনৈতিক মন্দা দৃশ্যমান। মূলত যে কোনো ধরনের আনন্দ উদযাপনের জন্য প্রয়োজন অর্থ। যার কাছে টাকা নেই সে কিভাবে ঈদ উদযাপন করবে? কথাটা রূঢ় হলেও বাস্তবতা কিন্তু মানতেই হবে।

এই রূঢ় বাস্তবতার বলি হলো দৈনিক আয়ের মানুষগুলো। বাংলাদেশে দৈনিক আয় করে সংসার চলে এইরকম পেশার মানুষ অনেক। এই পেশার লোক সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকাতে। এর সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। কেন এতো মানুষ ঢাকাতে সেই আলোচনা এই লেখার অংশ নয়।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীতে আড়াই কোটি মানুষের বসবাস। ভাসমান মানুষের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কুলি, মজুর, পত্রিকা বিক্রেতা, নির্মাণ শ্রমিক, দুধ বিক্রেতা, নিরাপত্তাকর্মী, অটো চালক, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী,পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রিকশাচালক, কাঠের কারিগর, দোকানি, সবজিওয়ালা, নাপিত, মুচি, বাদামওয়ালা, পরিবহন শ্রমিক, ফুটপাতের হকার, গৃহকর্মী, পোশাক শ্রমিকসহ শত শত পেশার মানুষ এই শহরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এদের পরিশ্রমে এই শহর এতো সুন্দর।

এই মানুষগুলো এখন সীমাহীন অর্থসংকটে। তাদের না আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাজ, না আছে প্রাতিষ্ঠানিক মজুরি। বিষয়টা একটু পরিষ্কার করি। বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের ৮৫ শতাংশ কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে। আনুষ্ঠানিক খাতে মাত্র ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ এতোক্ষণ যেসব মানুষের কথা বললাম তারা আসলে অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। আর আনুষ্ঠানিক খাত যেমন, সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ কিন্তু তাদের বেতন-ভাতা চলছে। এইরকম কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আছে আনুষ্ঠানিক খাতে। এর বাইরে? এর বাইরে বাকিদের জীবনযাপন ভয়াবহ।

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহন বন্ধ। বন্ধ বলতে একদমই বন্ধ। এই পরিবহন খাতে প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক কাজ করে। ২৬ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত গাড়ির চাকা ঘুরেনি। তাদের আয়-রোজগার বন্ধ। এর মধ্যে পহেলা বৈশাখ ও ঈদের মতো বড় দুটি উৎসব পড়েছে। এই দীর্ঘসময়ে মানুষগুলো কিভাবে চলছে? কি খেয়েছে? কেউ কি খোঁজ নিয়েছে? হয়তো নিয়েছে। কিন্তু এর পরিমাণটা খুব কম। অর্থের অভাবে এই খাতের শ্রমিকরা এখন ভিন্ন পেশায় কাজ করছে।

শ্রমিক কল্যাণের কথা বলে এতো বছর যে টাকা তোলা হয়েছে তাও নেতাদের পকেটে। শাজাহান খান, মসিউর রহমান রাঙ্গা- যে নামগুলোর ইশারায় পরিবহন শ্রমিকরা গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়ে সাধারণ যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে ফেলেছিল আজ সেইসব বড় বড় নেতারা তাদের পাশে নেই। এরচেয়ে বড় বাস্তবতা নেই। ২৬ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত এইসব ভারী ভারী নেতারা শ্রমিকদের দিন কিভাবে চলবে তা নিয়ে একটা কথাও বলেনি। অথচ এখন যদি গণপরিবহন চলতো তাদের দেখা মিলতো সবার আগে।

সবচেয়ে বড় সংখ্যক শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও তাদের অসহায়ত্ব নিয়ে কেউ কথা বলছে না কারণ এইসব সংগঠন শাজাহান খান, মসিউর রহমান রাঙ্গাদের দখলে। ফলে প্রতিবাদ নয়, নীরবতায় কাম্য। এই নীরবতায় মুষড়ে পড়বে তাদের ঈদ আনন্দ। হয়তো কেউ সেমাই, চিনি বা দুধ দিয়ে সহযোগিতা করবেন, সেই সহযোগিতা দিয়ে একবেলা পার করা গেলেও একটি দিন পার হবে না।

২.
৩২ লাখ গৃহকর্মী কাজ করে বাংলাদেশ। বিশ্বাস করা যায়? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য এটি। এই ৩২ লাখ গৃহকর্মী, ৩২ লক্ষ পরিবারে কাজ করে। কত বিশাল সংখ্যক মানুষ, অথচ তাদের নেই কোনো সংগঠন, নেই কোনো প্রতিষ্ঠান। করোনাভাইরাস আক্রমণ করার পর থেকে ধীরে ধীরে গৃহকর্মীরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। কারণ করোনা যেহেতু ছোঁয়াচে রোগ তাই কেউই এই সময়ে বিপদ ঘাড়ে নিতে চাইছে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ৩২ লাখ গৃহকর্মীর সংসার চলবে কিভাবে? সরকারের কাছ থেকে কোনো প্রণোদনা তারা পায়নি।বেসরকারিভাবে তারা কিছু খাদ্য সহযোগিতা হয়তো পাচ্ছে, কোনো কোনো পরিবার তাদের কাজ বন্ধ রেখে হয়তো বেতনও দিচ্ছে কিন্তু এইটা তো সবজায়গায় হচ্ছে না। এই সংকটে তাদের ঈদ কি আনন্দের হবে? অবশ্যই নয়। ঈদ আসবে ঠিকই কিন্তু তাদের ঘরে নয়।

রাজধানীসহ গোটা দেশে আবাসন প্রতিষ্ঠান অক্টোপাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মাঠ, ঘাট, নালা, ডোবা ভরাট করে সবাই এখন বিল্ডিং তৈরি করছে। দেশের দুই বড় শহর ঢাকা এবং চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার বড় কারণ যত্রতত্র নালা, ডোবা ভরাট করে বিল্ডিং তৈরি। এই বিল্ডিং তৈরির পিছনে কাজ করে নির্মাণ শ্রমিকরা। যাদের সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ।

২৬ মার্চ সাধারণ ছুটির ঘোষণার পর থেকে তারা অবসরে! মানে তারা কাজ হারিয়েছে। যেহেতু তাদের আয় দৈনিক তাই এখন তারা অর্থহীন। জমানো টাকাই এখন তাদের সম্বল। প্রতিষ্ঠানগুলো তো তাদের পাশে নেই, সরকারি প্রণোদনাও তাদের সাথে নেই। তাদের ঈদের চাঁদ ফিকে হয়ে গেছে। যেকোনো উৎসব আনন্দঘন হয় পোশাক এবং সৌন্দর্যের উপর। যদি করোনাভাইরাস বাংলাদেশকে আক্রান্ত না করতো তবে ঈদের প্রাক্কালে ফ্যাশন হাউজ এবং বিউটি পার্লারের ভিড় থাকতো চোখে পড়ার মতো। যখন বিদেশি পোশাক গোটা দেশের মার্কেট দখল করে নিচ্ছিল তখন দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো নিজেদের অবস্থান ধীরে ধীরে
শক্ত করেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত ১৯৭৩ সালে। আজকে বাংলাদেশের ফ্যাশন হাউজগুলোর কথা গোটা পৃথিবী জানে। করোনা পরিস্থিতির কারণে বৈশাখ এবং ঈদের দুইটা বড় উৎসবের বাজার হারিয়েছে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো। এই ফ্যাশন হাউজগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য কর্মীর রুটি-রুজি। এই অসংখ্য কর্মীদের ঈদ এইবার আসবে না। শুধু ফ্যাশন হাউজ নয়, সারাদেশে বিউটি পার্লারগুলো বন্ধ হয়ে আছে অনেকদিন। প্রায় ১৫ হাজার নারী উদ্যোক্তার দেড় লাখ কর্মসংস্থানে জড়িত কর্মীদের ঈদও আসবে না এবার।

২০২০ সালে খাবারের অভাবে মারা যাওয়া প্রথম মানুষটির নাম আফরোজা (১০)। আফরোজার বাবা আলম শেখ একজন তাঁতী। আলম শেখের মতো অসংখ্য তাঁতীদের জন্য কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়নি। তাদের বাড়িতে কি ঈদ আসবে?

৩.

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ। এই দেশের সৌন্দর্যকে যারা তুলে ধরতো তারা মাঠে নেই। করোনার কারণে সেই পর্যটন খাত সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই খাতে সবমিলিয়ে ৪০ লাখ মানুষ জড়িত। তাদের কাছে ঈদের আনন্দ এখন ফিকে হয়ে আছে। কারণ তারা আছে অর্থকষ্টে।

২০১৩ সালে প্রথম বাংলাদেশ সরকার, হিজড়াদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী-পুরুষভিন্ন পৃথক লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাদের কোনো পেশা নেই। সরকার তাদের জন্য অনেক ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এখন হিজড়াদের অবস্থা খুব শোচনীয়।

ন্যাশনাল এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম সূত্র অনুযায়ী, হিজড়াদের সংখ্যা ১ লাখ ১৯৯ জন। তাদের অর্থকষ্টের পাশে কেউ কেউ দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি। ক্ষুধার কাছে তারা এখন অসহায়। ঈদের আনন্দ তো পরের বিষয়।

হিজড়াদের এক বা একাধিক সংগঠন আছে। কিন্তু যৌনকর্মী! তাদের না আছে সংগঠন, না আছে সামাজিক মর্যাদা, না আছে বাসস্থানের ঠিকানা। ন্যাশনাল এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম এবং ডিরেক্টরেট জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস এর তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে হোটেল, পথ, বাসা ও যৌনপল্লি মিলিয়ে মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ২৬০ জন। এদের অভাব সবচেয়ে বেশি। সরকার নির্দেশিত সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে তাদের না আছে কাজ, না আছে অর্থ। আর সমাজের রক্তচক্ষু তো আছেই তাদের উপড়ে নেওয়ার জন্য। জীবিকার তাগিদে এই পথে আসা যৌনকর্মীরা এখন ধার করে দিন চালাচ্ছে। কখনো কখনো ধার দেওয়ার লোকও পাওয়া যায় না। তাদের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। তাদের পাশে কিছু সামাজিক সংগঠন হয়তো কাজ করছে কিন্তু করোনাকালীন সহায়তা তাদের নেই বললেই চলে। তাদের না আছে ঈশ্বর, না আছে আল্লাহ। এইরকম ভয়ানক খাদ্য সংকটে কি ঈদ আনন্দ আসবে?

শিশুদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় আমরা সবসময় সতর্ক থাকি। কিন্তু ছিন্নমূল পথশিশুদের কথা আমরা কতজন ভাবি? নিজের সন্তান সবচেয়ে আপন, কিন্তু পথশিশু? তাদের না আছে অভিভাবক, না আছে পরিচয়। কখনো ফুটপাত, কখনো বস্তি বা রাস্তার পাশে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়। এদের নির্দিষ্ট কোনো কাজও নেই। যখন যা পায় তাই করে দিন চালায়। সেভ দ্য চিলড্রেন’র তথ্যানুযায়ী, দেশে আনুমানিক ৭-৮ লাখ পথশিশু আছে। এইসব শিশুরা ঠিকভাবে খেতেই পায় না আর ঈদের চাঁদ, সেতো ক্ষুধার রাজ্যে একটা তাজা রুটি।

৪.
বাংলাদেশে এতো এতো অভাবী মানুষ আছে যাদের কথা লিখেও শেষ করা যাবে না। এইখানে তুলনামূলক কম আলোচনায় আসা কিছু মানুষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে আছে অসংখ্য মানুষের গল্প, অসংখ্য মানুষের ক্ষুধার সাথে যুদ্ধ করে হার মানার কাহিনী।

২০১৪ সালের বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোক গণনা রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে মোট বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫। এখন তাদের দিন কাটে শুধু খাবারের আশায়। ভাবা যায়! এইসব মানুষের প্রয়োজন সাহায্য। অনেক বা বেশি কিছু নয়, শুধু খাবারের সাহায্য। সরকারি প্রণোদনা হোক আর খাদ্য সাহায্য হোক তাদের বাঁচিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার।

খুশির ঈদ তখনই আসবে যখন আপনার পাশের মানুষটি খেয়ে শান্তি পাবে। তার পরিচয় যাই হোক না কেন তাকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। আশা করি এই দায়িত্ব থেকে আমরা পিছিয়ে যাবো না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর