করোনাকাল: ‘স্বাস্থ্যবিধি’ ও ‘সীমিত পরিসরের’ নানা রূপ
৩০ মে ২০২০ ১৫:২৪
১৯১৯ সালে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন, ‘ পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’। মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক পৃথিবীর গভীরতর অসুখ চলছে। জানি না এই অসুখ কবে নির্মূল হবে? নাকি আদৌ মুক্তির সম্ভবনা নেই।
স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যেসব নিয়ম কানুন অনুসরণ করা হয় সেগুলোকেই স্বাস্থ্যবিধি হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘স্বাস্থ্যবিধি বলা হয় সেসব নিয়মাবলি ও অনুশীলনকে যেগুলো সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করে।’ ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বলতে দৈহিক পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতাকে বোঝানো হয়।
অনেকে স্বাস্থ্যবিধি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এ দুটো বিষয়কে একই মনে করেন। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি একটি ব্যাপক বিষয়। এতে যেমনিভাবে ব্যক্তিগত বিষয়াবলি অন্তর্ভুক্ত যেমন- গোসল করা, হাত ধোওয়া, নখ কাটা, কাপড় ধোওয়া ও পরিবর্তন করা ইত্যাদি। তেমনি ঘর, কর্মস্থল এমনকি শৌচাগার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখাও এর অন্তর্ভুক্ত।
গবেষণা বলছে, সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার প্রচলন যদি ব্যাপকভাবে করা যায় তাহলে ডায়রিয়ায় মৃত্যুর হার শতকরা ৫০ ভাগ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের রোগ প্রায় ২৫ ভাগ কমানো সম্ভব। সাবান দিয়ে হাত ধুলে ত্বকের ইনফেকশন, চোখ ও কৃমির সংক্রমণও প্রতিরোধ করা যায়।
অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন যেমন- নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার জায়গায় ময়লা ফেলা, মেঝে বা দেয়াল পরিষ্কার রাখা, গৃহপালিত পশুর যত্ন নেওয়া ইত্যাদি। স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোতে রোগ সংক্রমণ ও পরিবারে একজন থেকে রোগ অন্যজনের শরীরে বিস্তারের ধারা প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ। আমাদের প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যবিধির বিষয়গুলো যাপিত জীবনে ছিল। এখনকার নাগরিক সভ্যতায় স্বাস্থ্যবিধির বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছে।
কোভিড-১৯ কি আমাদের দেখিয়ে দিলো- না, এটি পৃথিবীর অসুখ না। এটি মানুষের অসুখ, মানুষের ভেতরের অসুখ; বোধের অসুখ। আমরা গত এক শতাব্দীতে পৃথিবীর ওপর কত অত্যাচারই না করেছি। ১৭৫০ সালের পর থেকে বাতাসে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়েছে তার অধের্কের বেশি বেড়েছে গত ৫০ বছরে। বিজ্ঞান প্রতি মূহুর্তে এগোচ্ছে; কিন্তু বিশ্বসংসারের সব কিছুর সমাধান দিতে পারেনি। আর আমরা কি বিজ্ঞানের কথা মতো চলেছি? অনেক রোগের টিকা আবিষ্কার করা গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি রোগের টিকা আবিষ্কার করা যায়নি।
আগামীকাল ঢাকা মহানগরের কয়েকটি সুপারশপে একটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে স্বাস্থ্যবিধি আসলে ‘নাম কা ওয়াস্তে’। ইউনিমার্ট ধানমন্ডি, গুলশান সেন্টারে গেলেই বুঝতে পারা যায় স্বাস্থ্যবিধি বলতে কিছুই নেই। বিত্তবান, উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তের কি ভয়ংকর আচরণ। শারীরিক দূরত্ব বলতে কিছু নেই। যেমন ক্রেতা তেমন সুপারমলের কর্তৃপক্ষ; কারোরই কোন দায়িত্ব নেই। প্রবেশ ও বর্হিগমনের একটাই পথ। ঢোকার মুখে এক ফোঁটা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র দিয়ে তাপমাত্রা মাপা। এখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার নামে যা বিক্রি হচ্ছে তার কতোটাতে ৭০ শতাংশ ‘আইসোপ্রোপাইল এ্যালকোহল’ আছে? যথেষ্ট সন্দেহ আছে এবং সন্দেহ করার কারণও আছে। ইথানল, কারবোমার, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইকল ইত্যাদি দিয়েও হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরীর কথা আছে। অথচ গত ৮ মার্চের পর থেকে যত্রতত্র হ্যান্ড স্যানিটিইজার নামে মানহীন রঙ্গিন তরল বিক্রি করা হয়েছে।
ভারতের কেরালা রাজ্যে লকডাউনের প্রথম মাসেই ‘কুদুমবাশরি’ নামের এক স্থানীয় পর্যায়ের তৃণমূল সংগঠনের নেটওয়ার্ক ২ মিলিয়ন মাস্ক ও ৫ হাজার লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরকারের হাতে তুলে দিয়ে রাজ্যের করোনা মোকাবিলা কার্যক্রমকে সফল করার ভূমিকা রেখেছে। আমাদের পোড়া কপাল আমরা এমন কিছু দেখতে পাইনি। আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলো, বাম ধারার দু’একটি ছাত্র সংগঠন ছাড়া সামাজিক সংগঠন কিংবা এনজিওদের ভূমিকা দেখা যায়নি।
এবার ফিরে যাই বাংলাদেশে হঠাৎ করে ব্যাপকহারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুত করা নিয়ে। যে সময়টার কথা বলছি তখন এতো পরিমাণ আইসোপ্রোপাইল এ্যালকোহল বাজারে ছিল না। থাকার কথাও না। বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুতির অনুমতি নিয়েও কাঁচামালের অভাবে শেষ পর্যন্ত বাজারজাত করতে পারেনি।
আবার একটু স্বাস্থ্যবিধির দিকে নজর দেওয়া যাক। ঢাকা শহরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ঠিকমতো করতে দেখা যায় না। বেসরকারি বেশ কয়েকটি ক্লিনিকের সামনে বেসিন লাগানো হয়েছে ঠিকই; সেখানে সাবান নেই, এমনকি পানিও নেই। মাস্ক নিয়েও কম কাণ্ডকারখানা হয়নি। এই পরিসরে সেটা আর আলাপ নাই বা করলাম। একজন সিনিয়র সিটিজেনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমাদের দেশে অতি ধনীরাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। এটার কারণ কী? তারাতো অনেকটা সুরক্ষিত পরিবেশে বসবাস করেন। তিনি বললেন, ‘আগের দিনের বনেদী ধনীদের বাড়ির সীমানার ভিতরেই চাকরবাকরা থাকতো, ড্রাইভারদের জন্যে আলাদা থাকার ব্যবস্থা ছিল। এখন সেরকমটা নেই, কাজের লোক সব বাইরে থাকে। কাজের লোকের বয়স কম, হয়তো তার ডায়াবেটিস নেই, উচ্চ রক্তচাপ নেই আক্রান্ত হয়নি। কিংবা সে নিজে আক্রান্ত হয়নি, ভাইরাস শরীরে বহন করছে। অন্যকে আক্রান্ত করেছে।’
অতএব করোনাকালের স্বাস্থ্যবিধি বহুপাক্ষিক। গোটা বাংলাদেশে যত্রতত্র মোটরবাইক চলছে। অনেকক্ষেত্রে না আছে হেলমেট, না আছে মাস্ক। যে পরিবারের ছেলেগুলো প্রতিদিন এভাবে হেলমেট, মাস্ক ছাড়া দুজন-তিনজন করে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে তাদের অভিবাবকরা এগুলো কি দেখেন না? নাকি সবই আওয়ামী লীগ সরকার দেখবে!
সর্বত্রই ভিক্ষুকরা বিশেষ করে মার্কেটগুলোর সমানে জড়ো হয়ে নিজেদের বিশ্রন্তালাপ করে, গাড়িওয়ালা মানুষ দেখলেই ছুটে এসে ঘিরে ধরে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলে কিছুটা হলেও সমাধান করতে পারবে। কেরালার ‘কুদুমবাশরি’ এক হাজার ২০০ টি কমিউনিটি কিচেন চালু করেছে, একটি সংগঠনই প্রতিদিন ৩ লাখ লোকের আহারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে।
আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, শুধু একটি বা দু’টি মন্ত্রণালয় এই মরণঘাতী ভাইরাস মোকাবেলা করতে পারবে না। সমন্বিত ব্যবস্থাপনা এখানে খুবই জরুরি। শুধু ডাক্তার, নার্স এই রোগের চিকিৎসা করতে পারবে না। তার চেয়ে বেশি জরুরি রোগের বিস্তার রোধ করা। সেই কারণেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আমরাও মেনে চলছি। কিন্তু অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানছি, অনেকেই মানছি না।
প্রতিবছর ডায়রিয়া রোগে প্রায় ২ মিলিয়ন (২০ লাখ) মানুষ মারা যায়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ৫ বছরের নিচের শিশু। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি আক্রান্ত হয় দুস্থ, মফস্বলের কিংবা গ্রামীণ পরিবারগুলো। এইসব পরিবারে রোগ-ব্যাধির নির্মূল করতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা, উন্নত স্যানিটারি পায়খানার ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং সুস্বাস্থ্যবিধির নিয়মাবলি শিক্ষা দান প্রয়োজন।
বলা হয়েছে, শর্তসাপেক্ষে সীমিত পরিসরে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানো যাবে। লঞ্চ, রেললাইন, বাস, উড়োজাহাজ সবই চলবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে। সীমিত পরিসরের সীমাটা কতদূর; তা বলা মুশকিল। বোঝাও মুশকিল। আমাদের এখানে শুভ প্রতিযোগিতার চেয়ে অশুভ প্রতিযোগিতা বেশি।
বলা হলো, অল্প কিছু গার্মেন্টস খোলা হবে যাতে পিপিই তৈরি করা হবে। সবাই যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো এতে। খবর দিয়ে সহজসরল দরিদ্র মানুষগুলোকে ঢাকায় আসতে বলা হলো। জানি না কত মিলিয়ন পিপিই তারা জাতিকে উপহার দিয়েছে। সেখানেও বলা হয়েছিল, যা করা হবে তা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই। সেটার নমুনাও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে।
জানি না আগামীকাল থেকে ‘স্বাস্থ্যবিধি’ ও ‘সীমিত পরিসরের’ কি রূপ দেখবো? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ‘প্রাণ’ আমরা প্রায় সবাই পাঠ করেছি। ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে বাঁচিবারে চাই।’ কিন্তু মানুষ কীভাবে বাঁচতে চায়? সে চায় আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু। সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকাই প্রকৃত বেঁচে থাকা। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে বাঁচতে হলে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বাঁচতে হবে।
লেখক: সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক