করোনা সংকট মোকাবেলা, নীতি প্রণয়নের ত্রিশঙ্কু দশা
১ জুন ২০২০ ১৬:২১
সরকারি নীতিমালা বা জননীতি তৈরির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো— এটি সবসময় উদ্দেশ্যমূলক বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ওপর নির্ভর করতে পারে না। আমরা ‘প্রমাণভিত্তিক নীতি’ শব্দটি ব্যবহার করতে ভালোবাসি এবং কোনো সমস্যা সমাধানে নজির প্রতিষ্ঠা করার যুক্তি দেখাই। তবে এই নজির প্রতিষ্ঠার যুক্তিতে কোনো কল্পরাজ্যে কাজ হতেও পারে, তবে বাস্তবজীবনে এই তত্ত্ব একেবারেই অকার্যকর।
বাস্তবের দুনিয়ায় নীতিমালা তৈরিতে মূল্যবোধের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রায়শই রাজনীতি জননীতি নির্ধারণে একটা বড় ভূমিকা রাখে। এসব কিছুর পরও নীতি প্রণয়নের বিষয়টি অবশ্যই এমন হতে হবে যা সমস্যার সমাধান করবে, বৈজ্ঞানিকভাবে যুক্তিগ্রাহ্য ও পদ্ধতিগতভাবে সঠিক হবে এবং আপাতদৃষ্টিতে বিপরীত মনে হলেও তা একটি মানদণ্ড তৈরি করবে। বলা বাহুল্য, নতুন নীতি প্রণয়নের ধাঁধার মুখোমুখি বিশ্বের প্রতিটি দেশই হয় এবং কেউই এটাকে ঠিকঠাকভাবে মোকাবিলা করতে পারে না।
নীতিমালা প্রণয়নে জননীতি তৈরির সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং এগুলোকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সাদাচোখে সমস্যা ‘দেখতে’ পারি তবে সেটাকে ‘নীতি প্রণয়নের যোগ্য’ করে তুলতে সমস্যাকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, তার বিভিন্ন দিক বুঝতে হবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো সমাধানের সহজ রাস্তা বের করতে হবে। এই সমাধানের জন্য আবার অনেকগুলো বিকল্প রাখা যাবে না। অন্যথায় নীতিমালার উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত, কোন লক্ষ্যে নীতিগত বিষয়গুলোতে জোর দিতে হবে, কোন উপায়গুলো বিবেচনা করতে হবে— তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
নীতিশাস্ত্রে প্রায় সমাধানের অযোগ্য সমস্যা হিসেবে, ‘উইকেড প্রবলেম’ শব্দটি বেশ পরিচিত। একে বাংলায় ‘সমস্যার দুষ্টচক্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই ‘দুষ্ট’ সমস্যাগুলো প্রতিদিনের নিয়মিত সমস্যা নয়, অথচ বহুমাত্রিক। এটি প্রচলিত স্থিতাবস্থাকে নষ্ট করে দেয় এবং যা আর বাড়তে না দেওয়ার কারণে বহুমাত্রিক উদ্ভাবনক্ষমতার বিশ্লেষণী সমাধানের প্রয়োজন হয়। ‘দুষ্ট সমস্যাগুলো’ সরকারি নৈমত্তিক কাজের সমান্তরাল প্রক্রিয়া থেকে ‘অনুক্রমিক প্রক্রিয়ায়’ ঠেলে সরিয়ে নিয়ে যায় যেখানে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে যৌথভাবে সহায়ক পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজন হয়।
কোভিড-১৯ বা করোনা সংকট সম্ভবত আমাদের জীবদ্দশায় মোকাবিলা করা ‘দুষ্টতম’ সমস্যা, যেখানে তথ্য সংগ্রহ ও সংযোগের সূত্র খুঁজে সমস্যাটিকে দ্রুত সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে তা এখনো ঘটেনি।
এ প্রসঙ্গে একই সংকটে হাবুডুবু খেতে থাকা বিশ্বের দিকে একটু তাকাই। করোনাসংকট মোকাবিলায় অধিকাংশ দেশ ব্যর্থ হলেও তারা সমস্যাটিকে প্রাথমিকভাবে ভালোভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছিল। আমেরিকা, কানাডা এমনকি ইতালিও সমস্যাটিকে স্বাস্থ্যখাতের প্রস্তুতির অভাব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিল। এই শব্দগুচ্ছকে প্রায় সব দেশ গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত বিকল্প হিসেবে নিয়েছিল, যা সামাজিক দূরত্ব বা লকডাউনের সময়েও ব্যবহৃত হয়েছে। সুইডেন এবং যুক্তরাজ্য প্রাথমিকভাবে সমস্যাটিকে ভিন্ন উপায়ে সংজ্ঞায়িত করেছিল এবং বেলারুশও তাই করেছিল।
এখন প্রশ্ন হলো— বাংলাদেশ কীভাবে সমস্যাটিকে সংজ্ঞায়িত করেছে? সত্যি বলতে, আমরা এ বিষয়ে সত্যিই কিছু জানি না। সমস্যার শুরুতেই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতারা উভয়ই একমত হয়েছিলেন, আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই এবং আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী। এমনকি দেশে করোনা রোগী শনাক্ত অব্যাহত থাকার পরও এই অস্বীকার পর্ব চলমান ছিল।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়টি হলো, বাংলাদেশে আমরা প্রথমে ‘সমাধানের উপায়’ বেছে নিয়েছি এবং সেই অনুযায়ী সমাধানের চেষ্টা করেছি। কেন আমরা সেই উপায়টিই বেছে নিয়েছি, তা না জেনেই আমরা ‘লম্বা ছুটি’তে গেছি। যখন আমরা বুঝতে পেরেছি যে ‘লকডাউন প্রয়োগে ব্যর্থ’ হয়েছি, তখন আমরা স্পষ্টভাবে আমাদের সমস্যার সংজ্ঞাই বদলে ফেলেছি! নীতি প্রণয়নের সমস্যা সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রটিকে সম্ভবত আমরা একটি হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করে ফেলেছি।
একবার ভাবুন, সমস্যাটি যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যর্থ হওয়ায় কী ঘটেছে! সরকার ব্যাখ্যা করতে পারেনি কেন তারা লকডাউনেই মনযোগ দিলো। জনগণ বুঝতে পারেনি যে কী চলছে এবং কী ঘটতে চলেছে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি খাত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট সংকেত পায়নি।
তাছাড়া, যেহেতু সমস্যাটি দুষ্টতম, এর বিভিন্ন মাত্রা ছিল এবং আছে। মহামারি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে বেশি মনোযোগ ছিল, অর্থনৈতিক দিকটি ছিল দরিদ্রদের সাহায্য করা বা বাজার উন্মুক্ত করার ওপর জোর দেওয়া। নাগরিকের দিক থেকে বোঝার অভাব বা বিশ্বাসের অভাব ছিল প্রকট। আর প্রশাসনিক পদক্ষেপের নজর ছিল প্রায়োগিক ক্ষমতার ওপর। আমাদের দরকার ছিল সমস্যা সমাধানে এইসব ক্ষেত্রগুলোর সমন্বয়ে বিস্তৃত পরিকল্পনা করা।
করোনাসংকট মোকাবিলায় আমরা যা করতে পারতাম তা হলো—
সমস্যার সংজ্ঞা: স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতা— এই দু’টি বিষয় দিয়ে আমরা সমস্যাটিকে সংজ্ঞায়িত করতে পারতাম। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নীতিগত সমস্যাটি হতে পারে— ‘সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের সহায়তার জন্য স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অপর্যাপ্ত সক্ষমতা’। সমস্যাটিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করার মাধ্যমে সরকার লক্ষ্য শনাক্ত করার পাশাপাশি সমাধানের সন্ধানে সহযোগী পদ্ধতির দিকে যেতে পারত। একই সাথে সবার কাছে স্পষ্ট করে দেওয়া উচিত ছিল, সরকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা গড়ে তোলার বা পুনঃনির্মাণে মনোনিবেশ করছে এবং কঠিন সময়ে দরিদ্রদের সাহায্য সহযোগিতা করার কৌশল তৈরি করার চেষ্টা করছে।
উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নির্ধারণ: সরকারের সামনে প্রাথমিকভাবে তিনটি উপায় ছিল— সংকট নির্মূল (যা সম্ভব নয়), দমন (এটাই সবচেয়ে যৌক্তিক যা সরকার বেছে নিয়েছে) এবং স্থিতাবস্থা (সম্ভব নয়)। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার করা জরুরি ছিল যে করোনা সমস্যা সমাধানের কৌশল নিয়ে কাজ চলছে, যার উদ্দেশ্য দমন করা। এটার মাধ্যমে জনগণের কাছে বার্তা যেত যে সরকার সমস্যাটির সমাধান করবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা তৈরিতে কাজ করবে (শেষ ফলাফল এটি) এবং এর জন্য বিভিন্ন উপায় বিবেচনা করবে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, সরকার কর্মপদ্ধতিগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে আর জনগণ ভেবে নিয়েছে ‘ছুটি বা লকডাউন-ই’ সমস্যার সমাধান । সরকারের সেই ভুলে গার্মেন্টস শিল্প ভুল সংকেত পেয়েছে, শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে গ্রামে চলে গেছে, আবার মালিকরা শ্রমিকদের ফিরে আসতে বাধ্য করেছে। এরপর আবার শ্রমিকরা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অথচ সমস্যাটি শুরুর পরপরই লক্ষ্য স্থির করে সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করে বলে দেওয়া উচিত ছিল করোনা সংকট মোকাবিলায় আমরা তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছি। প্রথমত, আমাদের সক্ষমতার ওপর জোর দিয়েছি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে অগ্রাধিকার দিয়েছি। দ্বিতীয়ত, ন্যায্যতার ওপর জোর দিয়েছি এর মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত সহযোগিতা ও বণ্টন নিশ্চিত করব। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি, হোক সেটা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মূল্যে। যদিও সেটা ব্যয়বহুল হবে। আমরা লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব কার্যকর নিশ্চিত করব। কিন্তু দুঃখজনক এটিই যে, আমরা শুরুতে আমাদের লক্ষ্য সুচিন্তিতভাবে স্থির করতে পারিনি।
উপায় নির্বাচন: কোভিড-১৯ ভাইরাসের ফলে উদ্ভুত সংকট মোকাবিলায় হয়তো আমরা সঠিক বিকল্পটিই বেছে নিয়েছি। তবে স্বাস্থ্য খাত, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ না করে, লক্ষ্যগুলো বিবেচনা না করে এবং পরিণতি হিসাব নিকাশ না করেই সমস্যা সমাধানের উপায় নির্বাচন করেছিলাম। আসলে আমরা সম্মিলিত উপায়গুলোর দিকে যাওয়ার চেষ্টা করিনি এবং সমাধানের বিভিন্ন উপায় অনর্থকভাবে প্রয়োগ করেছি।
উপকরণ নির্বাচন: আশ্চর্যের বিষয় হলো— করোনাকালে নীতিগত সরঞ্জাম/উপকরণগুলো বাছাই এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারের গড়বড় করে ফেলার বিষয়টি ছিল লক্ষ্যণীয়। যেমন— তথ্য সংগ্রহ, প্রচার, পরামর্শ ও প্রেরণাদানের কাজটি সঠিকভাবে করা হয়নি, প্রয়োগ করা হয়নি এবং এখনো তা করা হচ্ছে না। এসব বিষয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিশ্র ফলও দেখা গেছে আর কিছু ক্ষেত্রে বেশ ভালো কাজে দিয়েছে। যেমন— প্রাশাসনিক আদেশে জনগণকে ঘরে থাকতে বলার বিষয়টিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আবার স্থানীয় পর্যায়ে অনেক কর্মকর্তাই নিজ নিজ উদ্ভাবনী দক্ষতায় সফল হয়েছেন। তবে শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারক যারা সংকট মোকাবিলায় সঠিক সরঞ্জামটি শনাক্তই করতে পারেননি, তাদের ব্যর্থতায় সংকটকালীন সময়ে সম্মুখসারির প্রশাসকদের সাফল্যের ফল ঘরে তুলতে পারেনি সরকার ও জনগণ।
করোনা সংকটের শেষ দেখতে অনেক দেরি, এই সময়ে আমাদের শিখতে হবে দ্রুত। আমাদেরকে দ্রুতই দুই পর্যায়ে সমস্যাটিকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। জানার চেষ্টা করতে হবে আগামী তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় নীতিগত সমস্যা কী হবে! আর যদি করোনার দ্বিতীয় স্রোত চলেই আসে, সেই সময়ে কীভাবে আমরা এর সমাধান করতে পারব। আমাদের এখনই ভাবতে শুরু করতে হবে। বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য খাতের পেশাদারদের সাথে পরামর্শ করতে হবে এবং সেই ভিত্তিতে উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। ঝুঁকিতে থাকা জনগণকে চিহ্নিত করতে হবে, আন্ধকারে না হাতড়ে সংকট মোকাবিলায় আমাদের জন্য কার্যকর সঠিক উপায়গুলো নির্ধারণ করতে হবে এবং নীতিমালার বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের হাতে কিন্তু সময় খুব বেশি নেই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভাষান্তর: সন্দীপন বসু