‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’
৪ জুন ২০২০ ১২:২৮
ডাউনটাউনের যেই জায়গাটাতে চারটা বড় রাস্তা এসে এক হয়েছে সেখানে হাজার হাজার লোক আজ একত্র হয়েছে। ঢেউয়ের মত মিছিল আসছে আশেপাশের ছোট ছোট শহরগুলো থেকেও। আমেরিকার ‘বাইবেল বেল্ট’ বলে খ্যাত স্টেটগুলোর একটি ক্যানসাস যেখানে প্রচুর কনজারভেটিভ সমর্থকের বসবাস। সেই স্টেটের একটা শহরের চৌরাস্তার মোড়ে রবিবার (৩১ মে) রাতে হাজার হাজার মানুষ পিচঢালা রাস্তায় নীরবে মাথা নিচু করে হাঁটুগেড়ে বসে আছে তাদের একহাত আকাশের দিকে তোলা, মুষ্টিবদ্ধ। গোটা দুই কি তিন মিনিট, সব চুপচাপ; শুধু একটা রাতের পাখি সবার মাথার উপর ঘুরে ঘুরে বিচিত্র শব্দে কী যেন বলে যাচ্ছে। আমিও সেইখানে ছিলাম। আমরা এই দুনিয়ায় যতদিন বাঁচি বলে ভাবি ঠিক ততদিন আসলে বাঁচা হয়না। কোন কোন দিন, কিছু কিছু মুহূর্তে সত্যিকারের বেঁচে থাকি আমরা। সে রাতে পিচঢালা পথে হাঁটু মুড়ে বসে থেকে মনে হলো আমি বেঁচে আছি, এই প্রতিবাদে অংশ নিতে পেরে বেঁচে উঠলাম।
কঠিন রাস্তার কর্কশ স্পর্শে তখন হাঁটুর চামড়া জ্বলছে। গত ২৫ তারিখ জর্জ ফ্লয়েড নামের ৪৬ বছর বয়েসী মানুষটাকে মেনিয়াপোলিসের একটা রাস্তার সাথে চেপে ধরে রেখেছিলো ডেরেক শভিন নামের এক রেসিস্ট পুলিশ। পাক্কা ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড নিজের দুই হাত পকেটে রেখে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মানুষটার গলায় হাঁটু চেপে বসেছিলো দানবটা। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ তখন তার মা কে ডাকতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বিপদে আমরা মা-কেই তো ডাকি। মা কাছে থাকুক চাই না থাকুক, মা কেই মনে পড়ে সবার আগে। ফ্লয়েডেরও হয়তো মনে হয়েছিলো, মা থাকলে ঠিক এই দানবটাকে তার গলার উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতো। তখন আশেপাশে আরো তিনজন খুনী পুলিশ এই ঘটনাটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। আমেরিকান পুলিশদেরকে কাছ থেকে যারা দেখেছেন তারাই জানেন এই পুলিশরা কী পরিমান অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ঘোরাফেরা করে। চারজন ইয়া মুশকো মুশকো পুলিশ, যাদের সবার কাছে আছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র, তাদের কাছে একজন নিরস্ত্র মানুষ যার গত কয়েকমাস ধরে চাকরি নাই, টাকা পয়সা নাই সেই লোকটাকে এত ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী মনে হলো যে তার দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধেও তাদের শান্তি হলো না। তাই তাকে রাস্তায় পিষে ধরে তার ঘাড়ে চেপে বসলো তারা।
ফ্লয়েড তখন মা কে ডাকছে, পানি চাইছে। মেনিয়াপোলিসের রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ফ্লয়েডের শেষ কথা ছিলো, ‘আই কান্ট ব্রিদ’- যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না। ’ লরেন্সের রাস্তায় হাঁটু মুড়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মনে হলো,
আমরা কতজন শ্বাস নিতে পারছি ঠিক মত? আমার নিজের দেশে নিজের সমাজে একজন নারী হয়ে নারীর অধিকারের কথা বলতে গিয়ে কতবার মনে হয়েছে কেউ আমার গলা চেপে ধরেছে। আমরা নিজেরা কি কখনো এভাবে এক হয়ে নিজের দেশে সংখ্যালঘু এবং নির্যাতিতদের জন্য দাঁড়াতে পেরেছি?
ফ্লয়েড যখন তার ফুসফুসে জমে থাকা শেষ দমটুকু দিয়ে মরিয়া হয়ে বলে উঠে, “আমি শ্বাস নিতে পারছি না”। তখন ডাকাত পুলিশটা বলে উঠে, “তুমি এখনো ঠিকঠাক কথা বলতে পারছো”। এর মানে হলো যতক্ষন সে কথা বলতে পারছে ততক্ষন সে বেঁচে আছে। তারপর ফ্লয়েড নিশ্চুপ হয়ে যায়। তার শরীরে আর দম অবশিষ্ট ছিলো না কথা বলতে পারার মতন। তার জবান বন্ধ হয়েছে নিশ্চিত হবার পর পুলিশ তার গলার ওপর থেকে হাঁটু সরিয়ে নেয়। সেদিন লরেন্সের রাজপথে হাঁটু গেড়ে বসে ভাবছি, আমার নিজের অঞ্চলসহ সারা পৃথিবীতে বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের জবান বন্ধ করার জন্য কত শত আইন-নিয়ম-প্রথার হুশিয়ারি বাণী প্রয়োগ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
একেকটা আইন এবং নীতি প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আমাদের চোখের সামনে জালিমের হাতিয়ার হয়ে মজলুমের গলা টিপে ধরছে কেউ যেন কথা বলতে না পারে। নানান ভাবে সেসব প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষিত করে রাখবার পরেও মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে যে নিপীড়িত-বঞ্চিত লোকেদের কথা বলার সুযোগ দিলেই এইসব প্রতিষ্ঠান ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়বে। বলা হচ্ছে বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে, ইন্সটিটিউশন রক্ষার তাগিদে নিপীড়িতের আর্তনাদকে লুকিয়ে রাখতে হবে। ধর্ম, রাষ্ট্র, পরিবার-ইত্যাদি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে বোঝাচ্ছে যে বর্ণবাদবিরোধিরা, নারীবাদিরা, সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বলতে চাওয়া লোকেরা, বিচার বহির্ভূত হত্যার বিপক্ষে কথা বলতে চাওয়া সব লোকেরা আসলে ষড়যন্ত্রকারী এবং ভিলেন। তাদেরকে আর মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছেনা। যেই মুহূর্তে একজন মানুষকে আর মানুষ মনে হয়না তখন তাকে যেভাবে খুশি মেরে ফেলা যায়, তাকে যেভাবে খুশি পায়ের নিচে পিষে ফেলা যায়, তার শ্বাসরোধ করে ফেলা যায়। কেউ প্রতিবাদ করতেও এগিয়ে আসেনা।
এদিকে নীরবে মুষ্টিবদ্ধ প্রতিজ্ঞা শেষে লরেন্স ডাউনটাউনের জনসমাবেশ এবার স্লোগানে মুখর হলো। একজন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘সে হিজ নেইম’ (তার নাম বলো)। সবাই উত্তরে গর্জে উঠলো- ‘জর্জ ফ্লয়েড’। তারপর একে একে স্লোগান ঢেউয়ের মতো শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় আছড়ে পড়লো।
অদ্ভুত সুন্দর সব স্লোগান- নো জাস্টিস, নো পিস, নো রেসিস্ট পুলিশ ( ন্যায়বিচার নাই, তাই শান্তিও নাই; রেসিস্ট পুলিশ চাই না)। তারপর আবার দুই হাত উঁচু করে সবাই চিৎকার করে উঠলো- হ্যান্ডস আপ, ডোন্ট শুট (আমার হাতে অস্ত্র নাই, আমাকে গুলি করো না)। এই স্লোগানটি মূলত শুরু হয়েছিলো ২০১৪ সালের অগাস্টের ৯ তারিখে। সেদিন মাইকেল ব্রাউন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে পুলিশ গুলি করে। মৃত্যুর আগে ব্রাউন তার দুই হাত তুলে বলেছিলো, “ডোন্ট শুট” (আমাকে মেরো না)। এরপরেও থেমে থাকেনি কালোদের ওপর পুলিশি নির্যাতন। ফ্লয়েড হত্যাকান্ডের ঘটনাটি এতদিনের সব অন্যায় অবিচারের কথা আবার মনে করিয়ে দিলো সবাইকে। এর আগে নানান শহরে খণ্ড খণ্ড ভাবে প্রতিবাদ হলেও, ১৯৬০ সালের পরে এই প্রথম গোটা আমেরিকা জুড়ে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকার একটা খুব উল্লেখযোগ্য অংশ একসাথে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। একসাথে সবাই মিলে বলছে, “আই কান্ট ব্রিদ” – আমি শ্বাস নিতে পারছিনা। তাদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার”- কালোদের জীবন মূল্যবান, “হোয়াইট সাইলেন্স ইজ হোয়াইট ভায়োলেন্স”- শাদাদের নীরবতাই শাদাদের নিষ্ঠুরতা।
হ্যাঁ, শাদাদের নীরবতাই শাদাদের নিষ্ঠুরতা। সংখ্যাগরিষ্টদের নীরবতাই সংখ্যাগরিষ্ঠের নিষ্ঠুরতা। সুবিধাপ্রাপ্তদের নিষ্ক্রিয়তাই অত্যাচারীদের হাতে অত্যাচারের ম্যান্ডেট তুলে দেয়। এইসব আমরা জানি। জেনে বুঝেও চুপ করে থাকি, কথা বলি না, প্রতিবাদ করি না। কথা বলতে পারাটা তো বেঁচে থাকার লক্ষণ। আমরা কি সত্যিই বেঁচে আছি? আমরা কি শ্বাস নিতে পারছি?
লেখক: গবেষক, রিলিজিয়াস স্টাডিজ