Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বর্ণবাদের আধিপত্য ও নিগৃহীতের কাতরতা


৬ জুন ২০২০ ১৫:৩৬

এই সময়ে বিশ্বে একটি শব্দ খুবই ব্যবহৃত। ‘শ্রেষ্ঠত্ব’- শব্দটির দাবিদার হতে চাইছেন আবারও কেউ কেউ! এতে আমার প্রবল আপত্তি আছে। মানুষই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। কোনো গোত্র, বর্ণ, সম্প্রদায় এই শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে না। করা উচিৎও নয়। যদি করে, তবে তারা মিথ্যাবাদিতা করছে এবং সমাজে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সময়ে সামাজিক আন্দোলন চলছে। প্রতিবাদ চলছে। মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়েপোলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েড নামের একজন আমেরিকান পুলিশের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। জর্জ একজন কৃষ্ণাঙ্গ। আর যে পুলিশরা তার হত্যার সাথে জড়িত এরা শ্বেতাঙ্গ বলেই বিবেচিত। একজন এশিয়ান আমেরিকান। ডেরেক শোভিন নামের পুলিশ অফিসার জর্জ ফ্লয়েডকে সড়কে মাথা উপুড় করে ফেলে ঘাড়ে হাঁটু গেড়ে থেকেছিলেন প্রায় নয় মিনিট। পরে জর্জকে যখন এম্বুলেন্সে তোলা হয়, তখনই তাঁর দেহ প্রায় নিথর ছিল। এটাই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে। এটি এমন একটি বর্বর দৃশ্য- যা একবার দেখলে দুবার দেখার মতো মানসিকতা কোনো সুস্থ মানুষের থাকতে পারে না! কী বিষাদ ঘেরা এই পুলিশ ব্রুটালিটি!

বিজ্ঞাপন

জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডে কেঁপে উঠেছে পুরো আমেরিকা। বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। এই প্রতিবাদের মহাস্রোতে ঢুকে পড়েছে কিছু লুটেরাও। যারা ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা এখন খুবই শংকটাপন্ন। ইতোমধ্যে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত চারজন পুলিশের বিরুদ্ধেই চার্জ গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের পুলিশ বাহিনী মাটিতে হাঁটু গেড়ে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তারপরও বিক্ষোভ থামছে না।

বিজ্ঞাপন

এরমাঝেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন চারজন প্রেসিডেন্ট-জিমি কর্টার, জর্জ বুশ, বিল ক্লিন্টন ও বারাক ওবামা জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদ করেছেন। বারাক ওবামা দেশজুড়ে আন্দোলনকারীদের ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন। জিমি কার্টার ক্ষমতা, সুবিধাজনক অবস্থা আর নৈতিক সচেতনতা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিল ক্লিনটন বলেছেন, জর্জ ফ্লয়েডের মতো মৃত্যু কারও কাম্য নয়। সত্যি কথা হল, সাদা চামড়ার হলে এমন মৃত্যুর সম্ভাবনা কম। জর্জ ডব্লিউ বুশ ও প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি লরা বুশ ফ্লয়েডকে নির্মমভাবে শ্বাসরোধে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন। তারা আমেরিকায় পুলিশের দমনপীড়নের ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সেইসঙ্গে জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে যারা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছেন, তাদের সমর্থনও দিয়েছেন।

এমনকি, পুলিশ হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছোট মেয়ে টিফেনি ট্রাম্পও। ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদ ও সামাজিক সাম্যের দাবিতে দেশটিতে চলমান বিক্ষোভ-আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন তিনি। শুধু টিফেনি নন, তার মা ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় স্ত্রী মার্লা ম্যাপলসও বিক্ষোভকারীদের প্রতি সংহতি জানাতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কালো স্ক্রিনের ছবি পোস্ট করেছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, যারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলোন করছেন তারা আমাদের মিত্র। কিন্তু কোনো লুটতরাজ তার সরকার মেনে নেবে না। তুষের অনলের মতো এই যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে- তা কবে প্রশমিত হবে, তা এই মুহুর্তেই বলা যাচ্ছে না।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আজ আইন পরিবর্তন, সমান অধিকার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা এই যে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টরা বলছেন, তারা নিজেরা ক্ষমতায় থাকাকালে কেন এর পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন নি? আমেরিকার ইতিহাসে একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা। যুগ যুগ থেকে আমেরিকায় যে কৃষ্ণাঙ্গরা নিগৃহীত হচ্ছেন- এই নিপীড়িত মানুষদের একটা বিশেষ চাওয়া ছিল বারাক ওবামার কাছে। ২০০৮ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দুই মেয়াদে মার্কিন মুলুকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি বিদায় নেন। বিদায়ী ভাষণে মার্কিনি গণতন্ত্রের জন্য যে তিনটি হুমকির কথা তিনি বলেছিলেন সেগুলো ছিল, বর্ণবাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভক্তি ও অসঙ্গতি। তার প্রেসিডেন্সির সময়ে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ‘পুলিশ ব্রুটালিটি’ আমি মনে করিয়ে দিতে চাই। ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই নিউইয়র্ক পুলিশের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন এরিক গার্নার। ০৬ জুলাই ২০১৬ নিহত হন ফিলান্ডো কাস্ট্যেল (৩২) সেন্ট এন্থনি, মিনিসোটা অঙ্গরাজ্যে। ০৫ জুলাই ২০১৬ এলটন স্টার্লিং (৩৭) নিহত হন, ব্যাটন রোজ, লুজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে। এরকম উদাহরণ আরও অনেক দেয়া যাবে। বারাক ওবামা কেন মার্কিন পুলিশি সংস্কার’টা করে গেলেন না ? তিনি কেন এই তিনটি বিষয়ে বড় পরিসরে কাজ করে গেলেন না- সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায়? এসব প্রশ্নের জবাব কে দেবে ?

ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১০১৪ জন। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। ‘ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার চালানো জরিপে দাবি করা হয়েছে যে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তিনগুণ বেশি মারা যায় কৃষ্ণাঙ্গরা। ‘কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান’- আন্দোলনটি শুরু হয় ২০১২ সালে। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ২০১২ ট্রেইভন মার্টিন নামে একজন ১৭ বছর বয়সী কিশোর নিহত হন। ফ্লোরিডার স্যানফোর্ডে জর্জ জিমারম্যান নামে একজনের গুলিতে তিনি প্রাণ হারান। মার্টিন একটি ঘেরা এলাকায় তার আত্মীয়দের সঙ্গে যখন দেখা করতে ঢোকেন। তখন ওই এলাকার একজন স্বেচ্ছাসেবক চৌকিদার হিসপ্যানিক জর্জ জিমারম্যান তাকে বাধা দেন। জুরি ২০১৩ সালে মি. জিমারম্যানকে নির্দোষ বলে রায় দেয়। আমেরিকান আইনে জিমারম্যান বলতে পেরেছিল যে আত্মরক্ষার স্বার্থে সে তিনি চালিয়েছিলেন। সেটাই এই মামলায় তার পক্ষে যায়। কিন্তু তরুণ ট্রেইভনের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবরা সবসময় বলে এসেছেন জিমারম্যান তাকে খুন করেছেন। ১৭ই জুলাই ২০১৪ এরিক গার্নার মারা যান নিউইয়র্কে পুলিশের হাতে দম বন্ধ হয়ে। খুচরা সিগারেট অবৈধভাবে বিক্রি করছেন এই সন্দেহে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই ঘটনার ফুটেজে দেখা যায় মি. গার্নার বারবার কান্নাজড়ানো গলায় আকুতি করছিলেন, ‘আমি নি:শ্বাস নিতে পারছি না’ আর একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ, ড্যানিয়েল পান্টালিওকে দেখা যায় তার হাত দিয়ে গার্নারের গলা টিপে ধরে আছেন এমনভাবে যাতে তিনি দম নিতে না পারেন। দুজনেই মাটিতে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। নিউইয়র্কের গ্র্যান্ড জুরি রায় দেয় পুলিশ অফিসার পান্টালিও-র বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আনা হবে না। এ ঘটনার পর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়। ঘটনার পাঁচ বছর পর নিউ ইয়র্কের পুলিশ বিভাগ থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

বিচারিক বৈষম্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বড় ফ্যাক্টর। এই ফ্যাক্টরের বেড়াজালটি ভেদ করা যাচ্ছে না! কেন যাচ্ছে না? আমেরিকায় এই সময়ে যেসব প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে তার একটা বড় অংশই ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু কিন্তু কোন কোন বিক্ষোভে সহিংসতা ও দাঙ্গা হয়েছে এবং বেশ কিছু শহরে এ কারণে কারফিউ জারি করতে হয়েছে। নিউইয়র্ক, নিউজার্সিতে লুটপাটের দৃশ্য মানুষকে হতবাক করেছে। শিশুরা ভয়ে তাকাতে পারছে না টিভির পর্দার দিকে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের আরেকটি বড় শহর বাফেলোতে দুজন পুলিশ অফিসারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। একটি ভিডিওতে তাদের একজন শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিতে দেখা গেছে। যার পর তদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিউইয়র্ক শহরেও, ছুটে পালানো বিক্ষোভকারীদের প্রতি পুলিশের নির্দয় আচরণের ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে। মিনিয়াপোলিসে যেখানে জর্জ ফ্লয়েড পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান, সেই শহরে তার স্মরণে একটি অনুষ্ঠান শেষ হবার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এসব পুলিশি নির্মমতার ঘটনা ঘটে।

পুলিশ ও বিক্ষোভকারী ইস্যুতে প্রশাসন এখন পক্ষ নিতে শুরু করেছে। বিশেষ করে নিউইয়র্কে ব্যাপক লুটপাটের পর, নিউইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো পুলিশের পক্ষ সমর্থন করে বলেছেন তারা ‘বিনা কারণে’ কোন নাগরিককে মারধর করেনি। তিনি বলেছেন ‘তারা যদি তা করে থাকে সেটা অন্যায়’। শহরের মেয়র বিল ডে ব্লাজিও বলেছেন কর্তৃপক্ষ যা করছে তার- ‘সবই করা হচ্ছে বিক্ষোভ দমনের প্রয়োজন থেকে।’

আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং এই বৈষম্যমূলক আইনের বিরূদ্ধে আন্দোলন ঘোষনা করেন। কিং তার অনুসারীদের নিয়ে দুইমাস ব্যাপি আন্দোলন চালিয়ে যান। সেই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল আলাবামাতে কৃষ্ণাঙ্গদেরও শ্বেতাঙ্গদের সমান অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গদের সর্বত্র প্রবেশাধিকার থাকতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। এমনি এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে আলাবামার পুলিশ সেই সমবেত জনতার উপর দমনমূলক নীপিড়ন চালায়। পুলিশ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জলকামান, টিয়ার গ্যাস, কুকুর লেলিয়ে দেয়াসহ সব রকম অত্যাচার করে সেই শান্তিকামী জনতার উপর। শিশুরাও রেহাই পায়নি এর থেকে। মার্টিন লুথার কিংসহ আরও অনেকেই গ্রেফতার হন। এই ঘটনা তখন ব্যাপক সাড়া জাগায় সারা বিশ্বব্যাপী।

সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান ওই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬৪ সালের ২৮ শে অগাস্ট দাসপ্রথা বিলুপ্তির ১০০ বছর পূর্তিতে অগুনতি মানুষের সমাগম হয় ওয়াশিংটন ডিসির লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে। সকল বর্ণের মানুষ এসেছিলেন সেদিন ঐ শান্তিপূর্ন প্রতিবাদ সমাবেশে কারণ এই সমাবেশ ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতা, মুক্তি এবং চাকুরীর নিশ্চয়তা সম্পর্কিত। এই সমাবেশে আমেরিকার দক্ষিনী রাজ্যের দুঃখী কালো মানুষদের হয়ে বক্তৃতা করেছিলেন মার্টিন লুথার কিং। ড. মার্টিন লুথার কিং ঐদিন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ, পৃথিবীশ্রেষ্ঠ বক্তৃতা করেন। যা ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ নামে পরে মানবতার ইতিহাসে বিশেষ খ্যাতি পায়।

বৈষম্যের কালো পাহাড় উপড়ে ফেলতে হলে, রাজনৈতিকভাবেই তা করতে হবে। আইনী বৈষম্য দূর করতে হবে। এর জন্য সকল দল ও মতের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এখন আমেরিকার অনেক অঙ্গরাজ্যেই শীর্ষপদে কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতিকরা রয়েছেন। তাদের আইনীভাবেই সোচ্চার হতে হবে। গায়ের রং যাই হোক- রক্তের রং লাল, এই সত্য প্রতিষ্ঠা করা না গেলে বিশ্বে বর্ণবৈষম্য দূরীভূত হবে না। এটাই পরম সত্য। কাজ করতে হবে, এই সত্যের পক্ষে।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর