Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা ও বাজেট ভাবনা


১০ জুন ২০২০ ১৮:১৪

করোনা (কোভিড-১৯) বিশ্বের ধনী দরিদ্র সকল দেশকেই ফেলে দিয়েছে জীবন-জীবিকার কঠিন বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যে। বিশ্বের তাবদ অর্থনীতি, জীবনযাত্রা, সামাজিকতা, শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য সবক্ষেত্রকে এক অদৃশ্য ভাইরাস তছনছ করে ক্রমাগত থাবা বিস্তার করে চলেছে।

বিশ্বে ইতোমধ্যে মৃতের সংখ্যা ৪ লক্ষ ছাড়িয়েছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লক্ষ। দুঃশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এর প্রতিষেধক টিকা বা কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। শুধুমাত্র গত ২৪ ঘন্টায় বিশ্বে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার আদম সন্তান। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আছে চরম ঝুঁকির মধ্যে।

বিজ্ঞাপন

এমন বাস্তবতায় আগামী বাজেট প্রণয়ন সরকারের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি, শিল্প, সেবা সব ক্ষেত্রই যাচ্ছে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রেমিটেন্স, বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক সৃজনশীল উদ্ভাবন এবং গার্মেন্টসসহ ব্যবসা বান্ধব পরিস্থিতির উন্নতি করা ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করে জনগণকে রক্ষা করাই সরকারের জরূরী করণীয়।

অর্থ বিভাগের এক প্রক্ষেপন (Projection) অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি (GDP) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮.২০ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮.৩০ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮.৪ শতাংশ।

রাজস্ব টার্গেট

অর্থবছর মোট রাজস্ব টার্গেট কর রাজস্ব টার্গেট

২০২০-২১ ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা ৩ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা
২০২১-২২ ৪ লক্ষ ৩২ হাজার কোটি টাকা ৩ লক্ষ ৯৩ হাজার কোটি টাকা
২০২২-২৩ ৪ লক্ষ ৯২.৭ হাজার কোটি টাকা ৪ লক্ষ ৯২.৭ হাজার কোটি টাকা

অর্থবছর রপ্তানী আমদানি

২০২০-২১ ৪১.৯৫ বিলিয়ন ডলার ৫৪.৮৮ বিলিয়ন ডলার
২০২১-২২ ৪৬.৪৮ বিলিয়ন ডলার ৫৯.২৮ বিলিয়ন ডলার
২০২২-২৩ ৫১.৫৭ বিলিয়ন ডলার ৬৩.৪২ বিলিয়ন ডলার

বিজ্ঞাপন

২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা যা চলতি বছরের চেয়ে ৪৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকা বেশি। রাজস্ব ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। যা জিডিপির’র (GDP) প্রায় ৫.৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে আদর্শ ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। এই ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে মূলত নির্ভর করতে হবে ব্যাংক ঋণের উপর। অভ্যন্তরীন খাত থেকে ঋণ ১ লক্ষ ৯ হাজার এবং বৈদেশিক ঋণ ৭৬ হাজার কোটি টাকার উর্দ্ধে। অথচ চলতি অর্থ বছরে বৈদেশিক ঋণ ছিল ৫২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে বাজেটে বৈদেশিক ঋণের নির্ভরতা বাড়ছে।

করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সর্বোচ্চ প্রস্তাবনা দিয়ে বাজেট প্রস্তুত করা বাঞ্ছনীয়। চলতি বছরের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে এ বছর স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ ২৫ হাজার ৭২৩ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা। ৫ হাজার ৭৭৮ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আরও ১০ হাজার কোটি টাকা থোপ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, বড় বাজেট করলেই চলবে না। প্রয়োজন হবে বাজেটের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয়ের সক্ষমতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেলেও বৃদ্ধি পায়নি বাস্তবায়ন সক্ষমতা বা গতি। মূল বাজেটকে অনেক কাটছাট করে প্রস্তুত করা হয় সংশোধিত বাজেট আর সে ক্ষেত্রেও বাস্তবায়নের হার ৭০ শতাংশের নিচে। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক দক্ষতা ও মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

সরকার যখন প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের উপরে ধরে প্রজেকশন (Projection) করেছে তখন  আইএমএফ (IMF) বলেছে প্রবৃদ্ধি ৩.৫০ শতাংশের মধ্যে থাকবে। সিপিডি (CPD) বলেছে, প্রবৃদ্ধি হবে ২.৫ শতাংশ এবং রাজস্ব আদায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকার অধিক হবে না। শুধুমাত্র মে ২০২০ মাসে রপ্তানী কমেছে ৬৮.৩৪ শতাংশ। তাই অর্থ বিভাগের প্রদর্শিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর বিপরীত চিত্র হচ্ছে সবকিছুর পরেও আইএমএফ (IMF) এর ঋণসহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার (যা সর্বোচ্চ রেকর্ড)।

বাংলাদেশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশ ঋণ দিতে পিছুপা হয় না কারন বাংলাদেশ কখনও ঋণ খেলাপী হয়নি। চীন থেকে যেসব জাপানি বিনিয়োগ বের হয়ে আসছে সেটা বাংলাদেশের কাজে লাগাতে পারলে একটি নতুন সম্ভাবনা থাকবে।

প্রবৃদ্ধি কি হবে সেটা নিয়ে এখন ভাবনার বিষয় নয়। এখন মূল ভাবনার বিষয় হচ্ছে মানুষের জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করে বৃহত্তর অর্থনীতির স্বার্থে কিভাবে লকডাউন পরিস্থিতিকে সর্বোচ্চ জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে বের হয়ে আসা যায়। অর্থনীতির গতি ফেরাতে পণ্যের চাহিদা ও যোগানের সাপ্লাই চেইন স্বাভাবিক রাখতে হবে। করোনার অভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী কি হতে পারে তার প্রজেকশন (Projection) থেকে বাস্তব পরিকল্পনা করতে হবে।

তেলের দাম কমে যাওয়ার মধ্যেপ্রাচ্যে অনেক পরিবর্তন হবে (যেখানে আমাদের মূল রেমিট্যান্সের স্থল)। তাই মধ্যেপ্রাচ্যে থেকে শ্রমিক ফেরত আসলে যে সামাজিক চাপ বাড়বে তা মোকাবিলা এবং প্রতিবছর শ্রমবাজারে যে ২০ থেকে ২২ লক্ষ শ্রমিক যুক্ত হয় তাদেরকে বিকল্প বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে নাহলে সামাজিক চাপ বাড়বে এবং অর্থনিতিও দূর্বল হয়ে পড়বে।

পোশাক শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের ধারণা বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বড় চ্যালেঞ্জও হবে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। সিপিডি (CPD) এ বিষয়ে তাদের একটি প্রজেকশনে (Projection) দারিদ্র্যের হার ২৪ থেকে ৩৫-এ উন্নীত হওয়ার কথা বলেছে।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিগত ১০০ বছরে এত বড় বিপদ আসেনি। এই ভাইরাস সারা বিশ্বের জীবন জীবিকা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ড সবই এলোমেলো করে দিয়েছে। উন্নত বিশ্ব নিজেদের সামাল দিতে হিমশীম খাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারায় নেমে এসেছে।

এমন বাস্তবতায় আমাদের করোনা মহামারীতে বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে-

১. স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
২. ত্রাণ ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়
৩. কৃষি ও কৃষিজাত পন্যের ব্যবস্থাপনা
৪. রপ্তানী ও বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা
৫. জরুরী সেবা নিশ্চিতকরণ
৬. উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা
৭. আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও আঞ্চলিক সহোযোগীতা
৮. আইন শৃঙ্খলা ও  সার্বিক সমন্বয়

উল্লেখিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বাজেটে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। বাজেটে যে ২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে তা হলো, কোথায় অর্থ খরচ করা হবে আর সেই অর্থ আসবে কোথা থেকে অর্থাৎ করোনার এই মহামারীতে খরচ ও যোগানের অগ্রাধিকার ঠিক করাই বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। করোনার এই মহামারী সময় এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অন্যান্য কৌশলের সাথে বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ এবং বিদেশে ফ্লাই (পাচার) করে চলে যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে বিনা প্রশ্নে যেকোন খাতে বিনিয়োগের সুবিধা হতে পারে একটি বিশেষ কৌশল।

লেখক: সাবেক সচিব ও যুগ্ম আহবায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর