শেখ হাসিনার ৩৩১ দিনের সেই কারাবরণ ও একটি চিঠির শক্তি
১১ জুন ২০২০ ১৩:৫০
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই। বাঙালির ইতিহাসে একটি কালো দিন। প্রিয় বাংলাদেশের বুকে তখন চেপে বসেছে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ নামের এক অপশক্তি। অবরুদ্ধ গণতন্ত্রের সেই সময়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তাকে থামাতে গ্রেফতার কৌশল নিলেন ওয়ান-ইলেভেনে চেপে বসা তত্ত্বাবধায়ক নামের ত্রাসরা।
ব্যস্ত নগরী ঢাকায় তখন রাত পৌনে ৪টা। সূর্য উঠার আগেই যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে সুধাসদন- শেখ হাসিনার বাড়ি। সেদিন প্রবল বৃষ্টি ছিল। ভোর ৬টায় বৃষ্টি উপেক্ষা করে সুধাসদনে প্রবেশ করে যৌথবাহিনী। সকাল ৭টা ৩২ মিনিটে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকন্যা এর আগেই ফজরের নামাজ আদায় করেন। যৌথবাহিনীর কাছে তিনি জানতে চান, কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। দেশে সামরিক শাসন জারি হয়েছে কিনা জানতে চান। কোনো উত্তর দিতে পারেনি যৌথবাহিনীর লোকজন।
প্রথমে শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সিএমএম আদালতে। সেখানে আদালত বসার দুই ঘণ্টা বাকি থাকতে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী জামিন নামঞ্জুর করা হয়। পরে সংসদ ভবনে অস্থায়ী সাব-জেলে পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধু কন্যাকে। তবে সিএমএম আদালতে দাঁড়িয়ে জাতির পিতার কন্যা সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আইনি ভাষায় ৩৬ মিনিটের একটি বক্তব্য রাখেন।
এদিকে গ্রেফতারের ঠিক আগেই শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে যান। এই চিঠি ইতিহাসের অনন্য দলিল। এই চিঠির শক্তিতে মানুষ আশার আলো দেখতে পায়। গণতন্ত্র প্রিয় বাঙালি প্রতিবাদী হয়ে উঠে। চিঠিতে দেশবাসীর প্রতি শেখ হাসিনার আস্থার কথা ফুটে উঠে। এছাড়া সেই চিঠিতে নেতা-কর্মীদের করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা ছিল। চিঠিটি হুবহু তুলে ধরছি-
প্রিয় দেশবাসী!
আমার ছালাম নিবেন। আমাকে সরকার গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় জানি না। আমি আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই সারাজীবন সংগ্রাম করেছি। জীবনে কোন অন্যায় করিনি। তারপরও মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও আপনারা দেশবাসী আপনাদের ওপর আমার ভরসা। আমার প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছে আবেদন কখনও মনোবল হারাবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই।
আমি আছি আপনাদের সাথে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যাহাই ঘটুক না কেন আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। জয় জনগণের হবেই। জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবোই।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
শেখ হাসিনা
১৬.০৭.২০০৭
বঙ্গবন্ধুকন্যার এই চিঠিতে আবেগ রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি ৩৩১ দিন জেলে থাকা অবস্থায় এই চিঠি দেশের মানুষকে শক্তি ও প্রেরণা দিয়েছে। সেই সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হয়েছে। কারাগারে মানসিক যন্ত্রণা দেয়ার চেষ্টা চলেছে। তবে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসবে সফল হয়নি। উল্টো এসব কারণে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আরও চাঙ্গা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্য ছিল- সেই সময়ের গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়া। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে বাধাগ্রস্ত করা। বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। ষড়যন্ত্রকারীরা এটা জানতো- শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস না করলে তাদের অশুভ ইচ্ছে সফল হবে না। তাই জাতির পিতার কন্যাকে গ্রেফতার করা হয়।
তখন ‘মাইনাস টু’ নামে একটি ফর্মুলা বাজারজাত করা হয়। তবে আসল উদ্দেশ্য ছিল একটাই- শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করা। কেননা দেশি-বিদেশি অপশক্তি পিছনে থেকে পঁচাত্তরের পনের আগস্টের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে চেয়েছিল।
তবে তারা বুঝতে পারেনি, শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা মানে তাদের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়া। পরে গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে ২০০৮ সালের ১১ জুন সংসদ ভবন চত্বরে স্থাপিত বিশেষ কারাগার থেকে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর থেকে এখনও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে চলছেন শেখ হাসিনা।
জয়তু শেখের বেটি।
লেখক: গবেষক, সংবাদকর্মী