লেন্দুপ দর্জি জুজু বনাম একজন শেখ হাসিনা
১১ জুন ২০২০ ২১:৪১
স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যে সংখ্যাটি ৩০ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে, তারা মনেই করে— এই দেশটি স্বাধীনই ছিল না কখনোই। কখনো কথিত ‘গোলামি চুক্তি’ নিয়ে, কখনো পানি ইস্যু নিয়ে, কখনো সীমান্ত বিরোধ নিয়ে, কখনো সীমান্তে বিদেশি মানুষ ঢুকে পড়া নিয়ে, কখনো বা আমাদের সিকিম হয়ে যাওয়া নিয়ে এই শ্রেণির লোকের বাহাস চলমান।
বছর দুয়েক আগে লেন্দুপ দর্জি নামে একজনকে নিয়ে গণমাধ্যমে তুমুল হৈ চৈ! কারণটা কী! কারণ আমাদেরই এক শীর্ষ নেতা বাংলাদেশ সিকিম হয়ে যাবে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনাকে কাজী লেন্দুপ দর্জির সাথে তুলনা করছিলেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, জাতীয় চার নেতার নাম বলতে না পারা এই প্রজন্মের অনেকেই লেন্দুপ দর্জিকে ঠিকই চিনেছেন। কিন্তু এর প্রেক্ষাপটটা কী, তা কখনো ভেবেছি আমরা!
কেন ইসলামিক স্টেট ইরাকের মত পরাক্রমশালী দেশকে ভেঙে চুরমার করে! আমেরিকা ইরাক দখল করে বসে থাকে? কুয়েতকে আবার ইরাক দখল করে, ফিলিস্তিন আর ইসরায়েলিরা ‘আমার দেশ, আমার দেশ’ বলেও নিজেদের দেশ পায় না! সৌদি আরবে সুদানের শিয়া মারতে যেতে হয়! সিরিয়াতে কেন পুতিন আর আইএস দু’টোর খেলাই চলতে থাকে?
আর ইরান— এদের বাইরে থেকেও স্বতন্ত্র শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়? ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কখনো বানানোই হয়নি। দীর্ঘদিন দেশটির ওপর অস্ত্র আর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল, কিন্ত তারপরও ইরান কিন্ত ইরান হয়েই টিকে রইল, পশ্চিমা বিশ্বের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই! কেন হয়েছে এমন?
‘মাথা গরম’, ‘কূটনীতি না জানা’ গাদ্দাফি নির্মমভাবে ক্ষমতাচ্যুত হলেন। অন্য সব জায়গায় তো ‘আরব বসন্ত’ নাম নিয়ে যা খেলা হওয়ার, তাই হলো। ব্রাদারহুডকে দাবার বড়ে হিসেবে ব্যবহার করে আইএস নামের সাম্রাজ্য তৈরি হলো। এটা শুরু সবে, কাবা শরীফ মক্কা থেকে সরানোর কথাও শুরু হয়েছে! জটিল কুটিল ধ্বংসযজ্ঞ সমাগতপ্রায়!
ইরান তবু এগুচ্ছে। পশ্চিমাদের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। তাদের পারমাণবিক গবেষণাও চলছে। কিভাবে এটা সম্ভব হলো?
মিশর, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন— এসব দেশেরও হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য আছে ইরানিয়ানদের পূর্বপুরুষ পার্সিয়ানদের মতো। কিন্তু তাদের মতো একক জাতিসত্তা, একই সংস্কৃতি আর প্রায় একই ধরনের হুবহু নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বাকিদের নেই। যাদের কাছাকাছি আছে, তারা সেসব ফেলে ‘গ্লোবাল মুসলিম’ বা ‘ব্রাদারহুড’ হতে চেয়েছে। ফলাফল তো দেখলেনই।
জি-৭ দেশগুলোতে একটা দেশও খুঁজে পাওয়া কঠিন যার সমুদ্রসীমায় বা ভূমিতে মার্কিন সেনাঘাঁটি বা অন্য স্থাপনা নেই। চলতি বিশ্বের তাত্ত্বিকভাবে ইসলামের শত্রুদের ঘাঁটি কি না ইসলামেরই একদম মূল ভূমিতে! ইসরাইলের আর কী লাগে!
বাংলাদেশ নামক দেশটাতে একই ভাষার লোক ৯৯ ভাগ। নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এক। আমাদের আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি। আমরাই ধারণ করে চলেছি এবং চলবো বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। আমরা মুসলিম হয়েও তাই অন্য ধর্মে সহনশীল— অন্তত তাই ছিলাম মুঘল, পাঠান এমনকি ব্রিটিশ আমলেও হাজার বছর ধরে।
আমরাও ইরানিদের মতোই একটু অন্যরকম। মুসলিম সংখ্যাগুরু হয়েও ছিলাম না মৌলবাদী, ছিলাম না চরমপন্থীদের আখড়া, ছিলাম না সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নক। যেমনটা ইরানিরা কঠোরভাবে ধর্মালম্বী কিন্তু নিজের দেশ ও জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে, নারীদের কাজ করা, সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতা আর বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক স্থাপেনে গোঁড়া নয় একদমই।
বাঙালি পশ্চিমা শক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছি বরাবরই। খোয়াব দেখিয়েও গ্যাস দেয়নি। প্রতিরোধের মুখে চট্টগ্রাম বন্দরের দখল দেয়নি। ‘ডিপ সি পোর্ট’ হবে হবে করেও নোবেল দালালিতে হয়নি।
ভারত ব্যবসা করেছে বাংলাদেশে। করবেও। ব্যবসা বাংলাদেশও করবে। কিন্ত সিকিমের মতো বাংলাদেশকে ভারত প্রজাতন্ত্র কখনোই তাদের ইউনিয়নে ঢুকাবার সাহস করেনি। একই সময় একই নেতৃত্বের একই স্ট্র্যাটেজিতে করা প্ল্যানে সিকিম হয়ে গেছে ইন্ডিয়ার অংশ। আর বাংলাদেশ লাল-সবুজ পতাকার গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র।
ঠিক এসব কারণেই বাংলাদেশ সবার জন্য একটি থ্রেট এবং ঠিকমতো চললে একটি গ্রোয়িং থ্রেট। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সেই থ্রেটকে স্বীকার জ্ঞান করার সূচনা। আর শেখ হাসিনার আমলে ডেভিড বার্গম্যানদের আন্তর্জাতিক তৎপরতা সেই থ্রেটের নতুন ধাপ। গোলাম আজম আর কাদের মোল্লা আমেরিকান সিনেটের আত্মীয় নন। তখনকার জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনেরও না। জামাতিদের টাকা আছে। এত টাকা নেই যে প্রায় পুরো সিনেট আর জাতিসংঘ তাদের লবিতে নামবে। তাই হলে পুতিন টাকা দিয়েই সব সিনেটর কিনে ফেলতেন। এই তৎপরতা খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা কারণে— বাংলাদেশ যেন রাষ্ট্র হিসেবে না দাঁড়ায়।
আপনি অনেক বড় গলায় বলেন আইএস মুসলিম না। ওরা খুনি। কিন্ত বাংলাদেশে তাদের প্রতিনিধিদেরকেই আপনি ভোট দেন। খাবার পাঠান। আপনি বলেন পশ্চিমা গণতন্ত্র ভালো নয়। মাহাথির রোল মডেল। কিন্ত আপনিই আবার সেই গণতন্ত্রে দেশের সব চেয়ে বড় শত্রুদের অংশগ্রহণ চান। মাহাথিরের ‘ডেভেলপমেন্ট ফার্স্ট’ থিওরিকে ব্যঙ্গ করেন।
আপনি আসলে কী চান? অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের কথা বলছি না। রাষ্ট্র হিসেবে কই দেখতে চান আপনার দেশকে?
বাকি থাকে ভারত। ছাড় না দিয়ে, দ্বিপাক্ষিক কূটনীতি দিয়ে দেশ না চালিয়ে, বশ্যতা স্বীকার করে ভারতের সঙ্গে সেই একই শক্তিই করবে যাদের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থের কোনো মূল্য নেই। সাম্প্রতিক ঘটনায় লক্ষণগুলো অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে স্পষ্ট।
যারা বঙ্গবন্ধু ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলেছিলেন বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন, এদের মুখেই ‘জয় হিন্দ’ শুনলে অবাক হবেন না যেন!
লড়াইটা তাই খুব পরিষ্কার— বাংলাদেশ আর বাংলাদেশবিরোধীদের লড়াই। এখানে ভারত, পশ্চিমা, ইসলাম, চায়না— সবাই আছে। কিন্ত এরা সাইড প্লেয়ার। খেলোয়াড় আসলে আমরাই, আমাদের ভেতরেই। একই ভাষা, প্রায় একই ধর্ম, বিশাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়েও আবার আমরাই আমাদের বিরুদ্ধ শক্তি। বাংলাদেশ আর অ্যান্টি বাংলাদেশ— দুই ভাগে ভাগ হয়ে!
দেশে অবশ্যই আওয়ামী লীগের প্রায় অন্ধ সাপোর্টার আছেন। নৌকা মার্কার ব্র্যান্ডেড ভোটার আছেন। এরা সবাই বাংলাদেশের পক্ষে নন। কিন্ত শেখ হাসিনার বাইরে আর কেউই বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেই এই মুহূর্তে। তিনি কি রাজনৈতিকভাবে অনেক ম্যাচিউরড বা জনপ্রিয় কি না, সেটি আর মুখ্য বিষয় নয়। তিনিই দেশপ্রেমের শেষ আশা। আমাদের লাস্ট হোপ।
আমাদের এখানে তাই ফেনী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত দেশ বিক্রি হবার শোরগোল উঠবে, একই দেশ বিভিন্ন দামে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হবার ময়নাতদন্ত হবে, চীন ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানরা দেশের মাটিতে পা দিলেই খবর হয়ে যাবে বিভিন্ন “গোপন চুক্তি” নিয়ে, কিন্ত এই সব কিছুর মধ্যেও বাংলাদেশ টিকে থাকবে মাথা উঁচু করে পূর্ণ মর্যাদায়।
আজ শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবস। সাফল্য-ব্যর্থতার সঙ্গে এই নেত্রীর ‘বিকল্প’ নিয়ে বহু চর্চিত আলোচনা আছে। বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাস বিবেচনায় যদি রাষ্ট্র পরিচালনার কেপিআই (কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) নিয়ে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ হয়, তবে তার আশপাশে রাষ্ট্রনেতা পাওয়া কঠিন। অর্থনৈতিক মানদণ্ড আর ‘উন্নয়ন’ নিয়ে মিলেনিয়াল জনগণের যে টিটকিরি রয়েছে, তার বিপরীতে এই আলোচনা হওয়া জরুরি— যেই বাংলাদেশ ভারত-চায়না-ইঙ্গ মার্কিন বিভিন্ন ব্লকে আটকে থাকার দুর্নাম নিয়ে ঘুরত, প্যারিস কনসোর্টিয়ামে স্যুট-টাই পড়ে ভিক্ষার ব্রিফকেস নিয়ে দাঁড়াত, সেনা শাসন আর সিউডো সেনাশাসনে দেশকে আবদ্ধ রেখে গণতন্ত্রের আবরণে দেশকে শোষণ করত, আর ‘দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে’ বিধায় দেশের মধ্য দিয়ে সাইবার ব্যাকবোন যাওয়া বন্ধ করে দিত— সেই বাংলাদেশ থেকে আজকের বাংলাদেশের উত্থান কিভাবে? কী করে? আজকের এই পাশ্চাত্য ধারার গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা করার অবস্থায়, সমসুযোগ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় আমরা যে উপনীত হয়েছি— এই রাস্তাটিতে আমরা কবে কী করে কার নেতৃত্বে উপনীত হয়েছি, সেটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণার দাবি রাখে। জনমত ভিন্ন হতেই পারে। সেই আলোচনা আরেকদিন।
লেখক: ম্যানেজিং এডিটর, সারাবাংলা ডটনেট
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক রাষ্ট্র পরিচালনা রাষ্ট্রনেতা লেন্দুপ দর্জি শেখ হাসিনা সিকিম